সম্প্রতি ‘৭ মার্চ’সহ বেশ কয়েকটি ‘জাতীয় দিবস’ বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সবগুলোই ‘জাতীয় দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল বিগত ফ্যাসিবাদী শাসনামলে। এসব দিবসের কয়েকটি নিয়ে বেশ আলোচনা, নানারকম প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গায়। এরমধ্যে সামাজিক মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে ‘৭ মার্চ’ বাতিলের বিষয়ে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ দিনটি এই জনগোষ্ঠীর ইতিহাসে সত্যিকার অর্থেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিন। কিন্তু এই দিনটিকে ‘জাতীয় ঐতিহাসিক দিবস’ বানানোর ঘটনা ‘কোর্টরুম পলিটিক্স’-এর এক ক্লাসিক্যাল উদাহরণ। বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোর্টের ব্যবহার একদম শুরু থেকেই চলছে। যেটাকে কোর্টরুম পলিটিক্স কিংবা জুডিশিয়াল ক্যুও বলা যায়। আর এই কোর্টরুমের সম্ভবত সবচেয়ে ভালো 'ব্যবহার' করে গেছেন পলাতক ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা।
তার বহু রাজনৈতিক ইচ্ছা পূরণের হাতিয়ার হিসেবে সে কোর্টকে ব্যবহার করেছে। আপাতত তেমন কোনো লিস্ট নেই, তবে স্মরণ করা যেতে পারে বিগত দেড় দশকে প্রায়ই তার অনুগত লোকজন তার পক্ষে যায় এমন বিষয়ে আদালতে রিট করতো। তারপর তারই অনুগত আরেকদল বিচারক তার পক্ষেই রুল দিতো। এরপর সেই রুল 'পালন' এর জন্য সরকারের আমলারা বেশ সক্রিয় হয়ে সকল এন্তেজাম করতেন। শেষমেশ মন্ত্রিসভার বৈঠকে চূড়ান্ত নির্দেশ আসতো আদালতের রুল বাস্তবায়নের। দেখা যেতো কখনো কখনো এর কিছু কিছু রিট জনপ্রিয়ও হতো!
মজার ব্যাপার হলো, সম্প্রতি সরকারের বাতিল করা দিবসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত '৭ মার্চ' ও একটা কোর্টরুম পলিটিক্সের ঘটনা। নিউজ ঘাটতে গিয়ে জানা যায়, ২০১৭ সালে ৭ মার্চকে ‘জাতীয় ঐতিহাসিক দিবস’ হিসেবে ঘোষণার ব্যবস্থা নিতে রিট আবেদন করা হয়। 'আওয়ামী লীগের মনোনয়নে' সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সম্পাদক ড. বশির আহমেদ ‘৭ মার্চকে ঐতিহাসিক দিবস ঘোষণা ও যে মঞ্চে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন, সেখানে মঞ্চে তার আবক্ষ ভাস্কর্য নির্মাণ’ করাসহ প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে রিটটি করেন।
এরপর ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারিতে ৭ মার্চকে ‘জাতীয় ঐতিহাসিক দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে এক মাসের মধ্যে সরকারকে গেজেট প্রকাশের নির্দেশ দেয় হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ (বেঞ্চের বিচারকদ্বয়; এফ আর এম নাজমুল হাসান এবং কে এম কামরুল কাদের। হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে উনাদের নিয়োগ যথাক্রমে, ২০১০ ও ২০১১ সালে। তাদের দুজনের বেঞ্চের আরও দুইটা গুরুত্বপূর্ণ রায় হচ্ছে, 'দেশের সকল আদালতে বঙ্গবন্ধুর ছবি প্রদর্শন' এবং 'জয় বাংলা'-কে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ব্যবহারের নির্দেশ ইত্যাদি)।
একই আদেশে 'প্রত্যেক উপজেলাতে যেন বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল নির্মাণ করা হয়' তাও বলা হয়। ওই বছরের ১৩ জুলাই 'রিটের রুলে প্রদত্ত নির্দেশনাসমূহ জন-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বিধায় ৭ মার্চকে জাতীয় ঐতিহাসিক দিবস ঘোষণার বিষয়ে মতামত চেয়ে সকল মন্ত্রণালয় ও বিভাগে প্রেরিত পত্রের অনাপত্তি পাওয়া গিয়েছে’ জানিয়ে মন্ত্রীপরিষদ সভায় ৭ মার্চকে 'জাতীয় ঐতিহাসিক দিবস' ঘোষণা করে মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করা হয়। দিবসটিকে 'ক' শ্রেণিভুক্ত করে ওই বছরের ১৫ অক্টোবর পরিপত্র জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
হাইকোর্টে রিট করছে কে? শেখ হাসিনার মনোনীত বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সম্পাদক। রুল দিচ্ছেন কারা? শেখ হাসিনার 'পরামর্শে' তার রাষ্ট্রপতি যাদের বিচারক নিয়োগ দিচ্ছেন। অনুমোদন আসতেছে কোথা থেকে? শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে হওয়া মন্ত্রিসভার বৈঠক থেকে। পরিপত্র জারি করছে কোন দপ্তর? সরাসরি শেখ হাসিনার অধীনস্থ দপ্তর। এই দিবসের ঘোষণা আসে কোন বছর? 'মুজিব শতবর্ষ' পালনের বছর। যে বছরের শুরুতে দেশের কোটি কোটি মানুষের জন্য 'করোনা মহামারি' মোকাবিলায় ন্যূনতম নিরাপত্তা ব্যবস্থা না করে নির্লজ্জের মতো শত শত কোটি টাকার আতশবাজি ফোটানো হয়েছিল, সেই বছর।
হিসেব মেলে তো? শেখ মুজিবকে যখন ফ্যাসিবাদের আইকন বানানোর চূড়ান্ত বন্দোবস্ত চলছে, তার জন্মবার্ষিকী পালনের নাম করে রাষ্ট্রের শতশত কোটি টাকার শ্রাদ্ধ করে। তখনই তার ভাষণকে এই জনগোষ্ঠীর লড়াইয়ের ইতিহাস থেকে কেড়ে নিয়ে 'জাতীয় ঐতিহাসিক দিবস' বানানো হচ্ছে। তার মুর্যাল উপজেলায় উপজেলায় নির্মাণের আদেশ দেওয়া হচ্ছে। আর এই পুরো এন্তেজাম করা হচ্ছে, শেখ হাসিনার একক ইচ্ছায়। এই প্রক্রিয়ায় শেখ হাসিনার একক ইচ্ছায় তার ফ্যাসিবাদী শাসনের অ্যাপারেটাস হিসেবে ৭ মার্চকে ‘জাতীয় ঐতিহাসিক দিবস’ ঘোষণা দেওয়া, তারপর সেই দিবস কীভাবে পালন হবে? ওই দিবসে কি কি আলোচনা হবে? কারা কারা কোথায় আলোচক থাকবেন? ‘ইতিহাসের’ কি কি বিষয় হাইলাইটস করা হবে আর কি কি বিষয় ঢেকে রাখা? হবে তার সবই ঠিক করা হতো হাসিনা কি চাইবেন কিংবা কোনটা করলে/বললে উনি খুশি হবেন আর কোনটা করলে উনি বেজার হবেন সেটা মাথায় রেখে।
ফ্যাসিবাদের অ্যাপারেটাস হিসেবে ফ্যাসিস্ট শাসকের ব্যবহারের জন্য কোর্টরুম পলিটিক্স করে বানানো 'জাতীয় দিবস', 'জাতীয় স্লোগান' কোনোভাবেই সত্যিকার অর্থে 'জাতীয়' নয়। বরং এই সবই করা হয়েছে এই জনগোষ্ঠীর অর্জিত ইতিহাস ছিনতাই করার জন্য। জনগোষ্ঠীর ইতিহাস ছিনতাই করে যা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে, তা বাতিল করা আদতে জনগোষ্ঠীর কাছেই তার ইতিহাস ফিরিয়ে দেয়া। ইতিহাসের চূড়ান্ত অথরিটি জনতা, কোনো ফ্যাসিস্ট শাসক নয়!
ফরিদুল হক, রাজনৈতিক সমন্বয়ক, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন।