ছবি: বাংলা আউটলুক গ্রাফিক্স
১৯৬১ সালে জেরুজালেমের আদালতে বিচার চলছিল হিটলারের অন্যতম সহযোগী অটো এডলফ আইখম্যানের। আদালতে তার মনোভাব ছিলো, ‘আমি কোনো ইহুদী বা অ-ইহুদীকে হত্যা করিনি, আমি কোনো মানুষকে হত্যা করিনি। আমি কখনো কোনো ইহুদী বা অ-ইহুদীকে হত্যা করার আদেশ দেইনি।’
বিচারকালে তিনি উল্টো দাবি করেছিলেন যে তিনি তার চাকরিস্থল থেকে বদলি হতে চেয়েছিলেন। কারণ তিনি হত্যার দায়ভার থেকে বাঁচতে চেয়েছিলেন।
সাংবাদিক হ্যানা আরেন্ট তার লেখা ‘আইখম্যান ইন জেরুজালেম: অ্যা রিপোর্ট অন দ্য ব্যানালিটি অব ইভিল’ - বইয়ে অটো এডলফ আইখম্যানের বিচারের বর্ণনা এভাবেই তুলে ধরেছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের অপকর্মের অন্যতম প্রধান সহযোগী ছিলেন আইখম্যান। তিনি ছিলেন গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে সাধারণ ইহুদীদের হত্যার রূপকার। হিটলারের পরাজয়ের পর আইখম্যান আর্জেন্টিনায় পালিয়ে যান এবং ছদ্মবেশে একটি কৃষি ফার্মে কাজ করেন।
১৯৬০ সালে আর্জেন্টিনা থেকে তাকে তুলে আনে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। গণহত্যায় সম্পৃক্ততার অভিযোগে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। দোষী সাব্যস্ত হবার পর ১৯৬১ সালের ১১ ডিসেম্বর তাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো হয়। তার দেহ ভস্মীভূত করা হয় ও ছাই সাগরে ফেলে দেওয়া হয়।
‘নিউ ইয়র্কার’ পত্রিকার সাংবাদিক হানা তার বইয়ে লেখেন, ‘“কোন্ অর্থে তিনি নিজেকে দোষী মনে করেন?’ দীর্ঘ জেরায় ডিফেন্স লইয়ার, প্রসিকিউশন বা তিনজন বিচারকের কেউই তাকে এমন সুস্পষ্ট প্রশ্ন করার প্রয়োজন বোধ করেননি।’” পরবর্তীতে সাংবাদিকদের এক ব্রিফিংয়ে আইখম্যানের আইনজীবী Robert Servatius of Cologne বলেছিলেন, ‘আইখম্যান অনুভব করেন ঈশ্বরের সামনে দোষী, আইনের সামনে নয়।’
আইখম্যানের আইনজীবী তৎকালীন প্রচলিত নাৎসি আইনি ব্যবস্থায় তার মক্কেল কোনো অন্যায় করেননি বলে বার-বার দাবি করেছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন, তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তা অপরাধ নয়, বরং ‘রাষ্ট্রের কাজ’। ‘আনুগত্য করা তার কর্তব্য ছিল’।
বাংলাদেশে জুলাই-আগস্ট মাসে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার নির্দেশে সংঘটিত গণহত্যায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের রাজনৈতিক নেতা এবং আইন-শৃঙ্খলাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারাও এখন কুখ্যাত আইখম্যানের ভাষাতেই কথা বলছেন। হাসিনার ‘আইখম্যানরা’ জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণহত্যায় নিজেদের জড়িত না থাকার দাবি তুলছেন আদালত প্রাঙ্গণে বা ডিবির জেরায়।
পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাদেশে সংঘটিত জুলাই-আগস্ট গণহত্যা সত্যিকার অর্থেই বিরল ও রোমহর্ষক। নিজ দেশের জনগণের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমন করতে রাষ্ট্রের সব শক্তি নিয়োগ করে শত-শত ছাত্র-শ্রমিক-জনতাকে নির্মমভাবে হত্যার উদাহরণ সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীর আর কোনো দেশেই মিলবে না।
গত ১৬ বছরেরও বেশি সময়ে রাষ্ট্রের সব শক্তির অপব্যবহার করে দেশের দণ্ডমুণ্ডের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে উঠেছিলেন শেখ হাসিনা। ক্ষমতার দণ্ড নিজের হাতে রাখতে বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং ভিন্নমতের লোকদের দমন করেছেন নৃশংসভাবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে ব্যবহার করে গুম-খুন-ক্রসফায়ার করে এক ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিলেন ভারতে পালিয়ে যাওয়া এই সাবেক প্রধানমন্ত্রী। পাশাপাশি দুর্নীতিতেও আকণ্ঠ ডুবে ছিলেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ থেকে নিচের স্তরের নেতারা।
জুলাই বিপ্লবে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাবার পর একে-একে গ্রেপ্তার হচ্ছেন গণহত্যার কুশীলবরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলি করে হত্যার অভিযোগে এরই মধ্যে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে পুলিশের সাবেক তিন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) সহ ১৮৪ জন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমপক্ষে ৯৯ জন কর্মকর্তাকে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের ১৮৭ পুলিশ সদস্যসহ দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এক ডজন পুলিশ কর্মকর্তা এরই মধ্যে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেছেন।
গণহত্যার নীলনকশার অন্যতম প্রণেতা অবসরে পাঠানো পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান মো. মনিরুল ইসলাম, ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, অবসরে পাঠানো ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, ডিবির সাবেক যুগ্ম কমিশনার খোন্দকার নুরুন্নবী, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার এস এম মেহেদী হাসান, রংপুর মহানগর পুলিশের (আরপিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার উত্তম কুমার পাল এবং পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ারদারসহ কুখ্যাত পুলিশ কর্তকর্তারা এখনও পলাতক রয়েছেন।
এছাড়া, ১৬ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে দোকান কর্মচারী শাহজাহান আলী (২৪) হত্যার ঘটনায় নিউমার্কেট থানায় করা মামলায় সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান এবং অপর মামলায় নৌবাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী, এমপি এবং নেতাকেও গ্রেপ্তার হয়েছেন।
বাংলার আইখম্যানরা
জুলাই গণহত্যার দগদগে ঘা মানুষের স্মৃতিপটে এখনও জ্বলছে। কিন্তু, এর কুশীলবরা আইখম্যানের মতোই আদালত প্রাঙ্গণে কিংবা ডিবির জেরায় নির্লিপ্ত মিথাচার করে যাচ্ছেন।
লন্ডনভিত্তিক ‘নাগরিক টিভি’র সঙ্গে সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে অত্যন্ত নির্লিপ্তভাবে নিজের সব অপকর্ম অস্বীকার করেছেন কুখ্যাত পলাতক কর্মকর্তা ডিবির মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
বাংলাদেশ-ভিত্তিক যমুনা টিভিতে প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে একই ধরনের ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন বাংলাদেশে তথাকথিত জঙ্গি নাটক সৃষ্টির অন্যতম কুশীলব এসবির সাবেক প্রধান মো. মনিরুল ইসলাম। তিনি দাবি করেন, ৫ আগস্টের পরও বর্তমান পুলিশ মহাপরিদর্শক ময়নুল ইসলামের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। এমনকি, গণহত্যায় নিজের সম্পৃক্ততাও অস্বীকার করেছেন মনিরুল।
একই ধরনের মিথ্যাচার করেছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। তার দাবি, তিনি পরিস্থিতির শিকার। জুলাই-আগস্টের ছাত্র-শ্রমিক-জনতার আন্দোলন কঠোর হাতে দমনে সরকারকে বিরামহীন পরামর্শ দেওয়া অপর সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক শহীদুল হকের দাবি, তাকে এসবের মধ্যে জড়ানো হচ্ছে।
পলাতক শেখ হাসিনার নির্দেশের পরিচালিত গণহত্যার অন্যতম এই দুই কুশীলব রিমান্ডে এমনই দাবি করেছেন বলে জানিয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট ডিবির একজন কর্মকর্তা।
আইখম্যান জেরুজালেমের আদালতে যেমন দাবি করেছিলেন, ঠিক একই সুরে সাবেক পুলিশ মহাপরির্দশক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন দাবি করেন, ‘আমি পরিস্থিতির শিকার। আমি গুলি চালাতে চাইনি, যা করেছি সবই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে করেছি। তার নির্দেশেই ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানো হয়েছে। ঘটনার সময় যেহেতু আমি আইজিপি ছিলাম, তাই আমার দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।’
হাসিনার গুম-ক্রসফায়ারের এক সময়ের প্রধান হোতা সাবেক আইজিপি একেএম শহীদুল হকও নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি অনেক আগেই অবসর নিয়েছি। এরপর থেকেই আমি নিষ্ক্রিয়। আমাকে কেন এসবের মধ্যে জড়ানো হচ্ছে?’
উল্লেখ্য, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ও এ কে এম শহীদুল হককে গত ৩ আগস্ট গ্রেপ্তার করা হয়।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ওই সরকার আমলে আইজিপির দায়িত্বে ছিলেন চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। সরকার পতনের পরদিন তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়।
পলক-জিয়াউল আহসানদের কণ্ঠেও আইখম্যানের সুর
‘গত ৭ আগস্ট রাতে আমাকে বাসা থেকে ডিজিএফআইয়ের একটি দল নিয়ে আসে। ৮ দিন আমি আয়নাঘরে ছিলাম। আমি কোনো গুম, খুনের সাথে জড়িত না।’
গত ১৬ আগস্ট ঢাকা মহানগর হাকিম আরফাতুল রাকিবের আদালতে রিমান্ড শুনানি চলাকালে এভাবেই নিজের অপকর্ম অস্বীকার করেন সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অব্যাহতি পাওয়া মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান।
গণহত্যার অন্যতম হোতা জুনাইদ আহমেদ পলকও নিজেকে নিষ্পাপ দাবি করেছেন। পলক ডিবিকে জানিয়েছে, অবস্থা বেগতিক দেখে তিনি পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন।
পলাতক হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানও গণহত্যা থেকে নিজেকে আড়াল করতে ডিবির কাছে দাবি করেন, ‘৫-৬ জন নেতার জন্য দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়। আর এ পরিণতির জন্য শেখ হাসিনা নিজেই দায়ী।’
সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক নিজেকে নির্দোষ দাবি করে করে বলেন, ‘সবকিছুর জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্য দায়ী। আমি তাকে মাঝেমধ্যেই আইনগত বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতাম।’
জুলাই মাসে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে নৃশংস পন্থা বেছে নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। ছাত্র-শ্রমিক-জনতার প্রবল প্রতিরোধের মুখে ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান তিনি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফর্মের স্বাস্থ্যবিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটির তথ্য মতে, আন্দোলনে কমপক্ষে ১৫৮১ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়া ৩১ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন।
লেখক : অনুসন্ধানী সাংবাদিক