মুজিববাদ: মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে সংঘটিত প্রথম প্রতিবিপ্লব
সারোয়ার তুষার
প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ০৬:১৬ পিএম
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের সময়কার চিত্র
সম্প্রতি ডেইলি স্টারের সম্পাদক জনাব মাহফুজ আনাম এক নিবন্ধে লিখেছেন শেখ হাসিনার ‘অপশাসন’ দিয়ে যেন শেখ মুজিবকে বিচার না করা হয়। শেখ হাসিনার বিগত পনেরো বছরের অবৈধ ফ্যাসিবাদী শাসনকে ‘অপশাসন’ (misrule) তকমা দেয়া মৃদু বকুনি কি না, সে প্রশ্ন আপাতত তোলা থাক। বর্তমান প্রবন্ধে আমরা মাহফুজ আনামের প্রস্তাব ধরেই অগ্রসর হব তথা শেখ হাসিনার ‘অপশাসন’ দিয়ে শেখ মুজিবকে বিচার করব না। বরং শেখ মুজিবের শাসনামলের নিরিখেই শেখ মুজিবর রহমানের মূল্যায়ন এবং সামগ্রিকভাবে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী চরিত্র সম্পর্কে কিছু কথা বলব।
মুজিব শাসনামল নিয়ে বেশকিছু ভালো বই-পুস্তক এবং অন্যান্য দলিলপত্র থাকলেও, জনস্মৃতি ও জনপরিসর থেকে ১৯৭২-৭৫ শাসনামল এক প্রকার অপসৃত। কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী ও গবেষক পঁচাত্তরের আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডকে বাংলাদেশের প্রথম ‘প্রতিবিপ্লব’ সাব্যস্ত করেছেন। পঁচাত্তরের নির্মম হত্যাযজ্ঞ সমর্থন করার কোনো সুযোগ নাই, কিন্তু ১৫ আগস্টকে কেন্দ্র করে-যে পঁচাত্তর পরবর্তী আওয়ামী লীগের চেতনাবাদী শোকের রাজনীতি গড়ে উঠেছে, এ কথা ভুলে গেলে চলবে না।
বর্তমান প্রবন্ধে আমাদের প্রস্তাব: পঁচাত্তর নয়; বাহাত্তর সালেই এক দলীয় সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম প্রতিবিপ্লব শুরু হয়। ‘মুজিববাদ’ বলতে আমরা শুধু জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র নামক চার মতাদর্শকে না বুঝিয়ে উল্লিখিত সময়কালের আওয়ামী শাসন, দলীয় সংবিধান প্রণয়ন, মুক্তিযুদ্ধের একক মালিকানা দাবি, বাকশাল কায়েমসহ মুজিব শাসনামলে সংঘটিত সকল গণবিরোধী তৎপরতার ভাবাদর্শিক ভিত্তিকে নির্দেশ করব। আওয়ামী লীগের পনেরো বছরের মাফিয়া শাসনের পতন ঘটেছে ঠিকই, মুজিববাদী চেতনা ও ভাবাদর্শিক উন্মাদনা অটুট রয়েছে।
|২|
গণহত্যাকারী শেখ হাসিনার ‘দুঃশাসন’ দিয়ে শেখ মুজিবকে বিচার করার দরকার নাই। শেখ মুজিবকে মূল্যায়ন করার জন্য ১৯৭২-৭৫ শাসনামলই যথেষ্ট।
সকল আপত্তি অগ্রাহ্য করে পাকিস্তানের গণপরিষদের জন্য নির্বাচিতদের দিয়ে আওয়ামী লীগ এক গণপরিষদ গঠন করে এবং মাত্র ৯ মাসের মধ্যে একটি একদলীয় সংবিধান জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়। ২০১৪ থেকে ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত তিনটি ভুয়া ও ডামি নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ইতিহাস শুরু হয়নি। ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় নির্বাচনকে কলঙ্কিত করার মাধ্যমে শুরু হয় মুজিববাদী রাজনীতির বিতর্কিত ইতিহাস। কয়েকটা নজির হাজির করা যাক।
আজীবন আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল আনিসুজ্জামান তাঁর “বিপুলা পৃথিবী” বইতে লিখে গেছেন ওই নির্বাচনে বিপুল উৎসাহ নিয়ে ভোট দিতে গিয়েও তিনি ভোট দিতে পারেন নাই।
৭ মার্চে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে বিরোধী অনেক প্রার্থীকেই মনোনয়ন দাখিল করতে দেয় নাই শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ। অনেক প্রার্থীকে বলপূর্বক মনোনয়ন প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয়েছিল৷
ভোলার একটি আসনে মনোনয়ন জমা দেওয়ার কথা ছিল ডাক্তার আজহারউদ্দিনের। তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। মনোনয়ন জমা দেওয়ার আগে তাঁকে অপহরণ করায় তাঁর পক্ষে মনোনয়ন জমা দেওয়া সম্ভব হয় নাই। ফলে ওই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়। ওই আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন খোদ শেখ মুজিব। একইভাবে শেখ মুজিবের তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদও ভোলার আরেক আসনে বিরোধী প্রার্থীকে মনোনয়ন জমা দিতে দেন নাই।
কুমিল্লার দাউদকান্দি আসনে জাসদ প্রার্থী রশিদ ইঞ্জিনিয়ারের কাছে খন্দকার মুশতাক হেরে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় ব্যালটবাক্স তুলে এনে খন্দকার মুশতাককে জেতানো হয়েছিল। গবেষক মোরশেদ শফিউল হাসান মনে করেন, “সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে বা ইচ্ছাতেই সেটা হয়েছিল। সেদিন মুশতাককে ওভাবে না জেতালে বাংলাদেশের ইতিহাস হয়তো অন্যরকম হতো।” মোরশেদ শফিউল হাসান তখন দৈনিক ‘সংবাদ’ পত্রিকার তরুণ রিপোর্টার ছিলেন।
চট্টগ্রামে মোজাফফর ন্যাপের একজন প্রার্থী মোস্তাক আহমদ চৌধুরীকে বিজয়ী ঘোষণার দেড় দিন কি দু-দিন পর রেডিও ঘোষণার মাধ্যমে সে ফল উল্টে দেওয়া হয়। নির্বাচনে যে মিডিয়া ক্যুর কথা বলা হয়, তার নজির প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই স্থাপিত হয়।
১৯৭৩ সালের সংসদ নির্বাচনের এ সকল অভিজ্ঞতার কারণেই ডাকসু নির্বাচনে ব্যালটবাক্স ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটায় ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ প্যানেল তথা লেনিন-গামা পরিষদ। এ প্রসঙ্গে আমরা পরে আবার ফিরব।
দৈনিক ‘সংবাদ’-এর তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মোরশেদ শফিউল হাসান সলিমুল্লাহ হলে এবং পরে জগন্নাথ হলে ব্যালট বাক্স ছিনতাই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। পত্রিকা হিসেবে দৈনিক ‘সংবাদ’ এবং ব্যক্তি হিসেবে জনাব মোরশেদ শফিউল হাসান লীগ-ইউনিয়ন প্যানেলের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তবু ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠতার স্বার্থে তিনি সত্য স্বীকারে দ্বিধা করেন নাই।
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে বাকশাল তথা একদলীয় শাসন কায়েম করা হয়। বাকশালের সরল অর্থ হচ্ছে বহুদলীয় ব্যবস্থাকে নিষিদ্ধ করে একদলীয় শাসন। গণতন্ত্র হত্যা। পছন্দের চারটা সংবাদপত্র রেখে বাকি সব নিষিদ্ধ। সরকারি চাকুরেদের বাধ্যতামূলক বাকশালে যোগদান।
শেখ মুজিব সংসদে মাত্র ৫ মিনিটের মধ্যে বাকশাল কায়েম করেছিলেন। ২৯৪-০ ভোটে চতুর্থ সংশোধনীটি পাশ হয়। সংসদে বিরোধিতার কোনো সুযোগ ছিল না। দুনিয়ার ইতিহাসে এত কম সময়ে কোনো সংশোধনী পাশের দ্বিতীয় নজির নাই।
এমনকি শেখ মুজিবের স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবও বাকশালের পক্ষে ছিলেন না। বাকশাল কায়েমের আগে আগে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের পারিবারিক আবহে কি কি ঘটছিল তা জানার জন্য শেখ হাসিনার হাজবেন্ড পরমাণু বিজ্ঞান এম এ ওয়াজেদ মিয়ার “বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ” বইটা পড়া যেতে পারে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, গণহত্যাকারী শেখ হাসিনা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও কেন ওয়াজেদ মিয়ার উল্লিখিত বইটি বাজারে পাওয়া যায় নাই।
ওয়াজেদ মিয়ার বইতে ছাত্রলীগের অন্তর্কোন্দলের জের ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলের কুখ্যাত সেভেন মার্ডার প্রসঙ্গেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। অন্তর্কোন্দল ছিল মূলত মণি গ্রুপের সাথে রাজ্জাক গ্রুপের। শফিউল আলম প্রধান ছিলেন রাজ্জাক গ্রুপের। এজন্যই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। মণি গ্রুপের হলে শফিউল গ্রেপ্তার হতেন কি না সন্দেহ করার যথেষ্ট অবকাশ আছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম ‘সেভেন মার্ডার’ ঘটেছিল ছাত্রলীগের অন্তর্কোন্দলের জের ধরে— এ তথ্যের ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে।
কে/কারা শেখ মুজিবকে বাকশাল কায়েমে প্ররোচিত করেছিলেন, ওয়াজেদ মিয়া বেশ সাধাসিধাভাবে তার স্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছেন।
মাহফুজ আনাম সাহেবের কাছে অরুণা সেনের নাম অজানা থাকার কথা নয়। কমিউনিস্ট নেত্রী অরুণা সেনকে রক্ষীবাহিনী ভয়ংকর নির্যাতন করেছিল। অরুণা সেনের জবানবন্দি পড়ে অনেকেই মত দিয়েছেন যে, রক্ষীবাহিনীর ওই অত্যাচারের সাথে কেবল ও কেবলমাত্র পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর তুলনা করা চলে।
সিরাজ শিকদারসহ ৩০ হাজার বিরোধী নেতা-কর্মীদের হত্যা করা হয়েছিল মুজিব আমলে। স্বাধীন বাংলাদেশের দ্বিতীয় ডাকসু ইলেকশনেই ব্যালট ছিনতাইয়ের নজির সৃষ্টি করেছিল ছাত্রলীগ। সাথে ছিল ছাত্র ইউনিয়ন।
ব্লগার সুব্রত শুভ ব্লগ থেকে জানা যায়, ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাসে ভিয়েতনাম সংহতি মিছিলে শেখ মুজিবের পুলিশ গুলি চালায়। এতে শহিদ হয়েছিলেন মতিউল-কাদের। এর জের ধরে পল্টন ময়দানে আয়োজিত এক সমাবেশে ডাকসুর পক্ষ থেকে তৎকালীন ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম তুমুল করতালির মধ্যে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিব রহমানকে দেওয়া জাতির পিতা ও বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রত্যাহার করে নেন এবং ডাকসুর আজীবন সদস্য পদ বাতিল করেন।
আওয়ামীলীগের গুন্ডারা ন্যাপের কেন্দ্রীয় কার্যালয় জ্বালিয়ে দেয়। ন্যাপের তৎকালীন নেত্রী মতিয়া চৌধুরী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রতিবাদ সভায় শেখ মুজিবের প্রতি ধিক্কার জানিয়ে বলেছিলেন, “তুমি আর বঙ্গবন্ধু নও আজ থেকে তুমি বঙ্গশত্রু।” সেই সময় শাহরিয়ার কবির লিখেছিলেন, “মুজিব আর বঙ্গবন্ধু নয়, এখন থেকে মুজিব জনশত্রু”।
এরকম অসংখ্য ভয়ংকর ঘটনায় ঠাসা শেখ মুজিবের শাসনামল ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫। ওই সময়কাল সম্পর্কে মাহফুজ আনামের সমালোচনা দেখা যায় না। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে সংঘটিত প্রথম প্রতিবিপ্লব মুজিববাদ তথা বাকশাল সম্পর্কে মাহফুজুর রহমান, সোহরাব হোসেনসহ সুশীল সমাজের বড় এক অংশ আশ্চর্য রকমের নীরব।
বোঝা যায়, সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধ আর তাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বয়ানের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন ভূখণ্ড প্রাপ্তি এ দেশের আপামর মানুষের সবচেয়ে বড় অর্জন; অন্যদিকে, মুজিববাদী ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ গণবিরোধী ও অগণতান্ত্রিক।
প্রসঙ্গত, চব্বিশের ২৬ জুলাই গণহত্যা ও অভ্যুত্থান চলাকালে মাহফুজ আনাম ডেইলি স্টারে যা লিখেছেন তা গণহত্যাকে সমর্থন করারই শামিল। আপাতদৃষ্টিতে ওই লেখায় সরকারের সমালোচনা করা হয়েছে এমন মনে হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে সরকারি ভাষ্যকে বিনা প্রশ্নে মেনে নিয়ে মাহফুজ আনাম মূলত আন্দোলনকারীদের ‘স্বাধীনতা বিরোধী’ শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
মাহফুজ আনামের পিতা আবুল মনসুর আহমদ বাংলাদেশের একজন মহিরুহ তাত্ত্বিক, চিন্তক, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিক ছিলেন। সামনের দিনগুলোতে মনসুর সাহেব আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবেন; অন্যদিকে, জনাব মাহফুজ আনামের তেমন কোনো প্রাসঙ্গিকতা আগামীর বাংলাদেশে আমি দেখতে পাই না।
|৩|
শেখ হাসিনা বাংলাদেশের একমাত্র শাসক যাকে গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে। এরশাদের মতো তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয় নাই। পতনের পর রাজনীতিতে এরশাদের পুনর্বাসন হয়েছিল। এর ‘কৃতিত্ব’ আমরা তৎকালীন রাজনৈতিক দলগুলোকে দিতেই পারি। তবে এবার শিক্ষার্থী সমাজের নেতৃত্বে বাংলাদেশের তরুণ সমাজ ও জনগণ, এমনই এক তীব্র গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়েছে যে, গণহত্যাকারী হাসিনাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে।
একুশ শতকের বৈশ্বিক ইতিহাসের নিকৃষ্টতম ফ্যাসিস্ট শাসককে এই দেশের তরুণরা অবৈধ ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেছে। এজন্য তারা নিজেদের জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছে। এটা বর্তমান তরুণ প্রজন্মের সবচেয়ে বড় অর্জন।
তবে আত্মতুষ্টির ফুরসত নাই। হাসিনা পালিয়ে গেলেও, তার তৈরি করা ব্যবস্থা পুরোটা অক্ষত রয়ে গেছে। এজন্যই শিক্ষার্থী-তরুণরা “ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত”-র রাজনীতি নিয়ে হাজির হয়েছে। পরিস্থিতি এমন যে, হাসিনার নামের আগে খুনি বা গণহত্যাকারী না লিখলে তরুণরা ক্ষুব্ধ হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের আবেগ ব্যবহার করে আবার দেশে ঢুকতে তৎপর। আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
সোহরাব হাসানরা প্রথম আলোতে কলাম লিখে হাহাকার করছেন। ইতিহাস নাকি মুছে ফেলা হচ্ছে! এ অশ্রু বিসর্জনের মাজেজা বোঝা কঠিন। কোনো ইতিহাস মুছে ফেলা হচ্ছে না; বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুজিববাদী বিচ্যুতি ঠিক করার মাধ্যমে প্রকৃত ইতিহাস সৃষ্টির পথ সুগম করা হচ্ছে মাত্র। মুজিববাদী ভাবাদর্শ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিকৃতি সাধন করেছে। ইতিহাসের সকল স্বর মুছে দিয়ে একক ব্যক্তির মহিমা কায়েমের পাঁয়তারা করেছে। বাংলাদেশের সুশীল সমাজের বড় অংশ গত চার দশক ধরে ইতিহাসকে আওয়ামী লীগের কোলে তুলে দিয়েছে। চেতনা ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলেছে। সেই চেতনা ইন্ডাস্ট্রি যে কতটা দেশ ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী, তা বলা শুরু হয়েছে মাত্র।
বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র করতে হলে ইতিহাসের বি-আওমীকরণের কোনো বিকল্প নাই। ইতিহাসের অন্যায্য মুজিবময়তা দূর করার মাধ্যমে ব্যক্তি মুজিবের ঐতিহাসিক ও বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নের পরিসর তৈরি করা সম্ভব হবে। তেমন পরিস্থিতিতে দেবত্ব আরোপ নয়; ইতিহাসে ব্যক্তি মুজিবের অবদান নিঃসঙ্কোচে স্বীকার করতে কোনো দ্বিধা থাকবে না।
স্মরণ করা আবশ্যক, ২০২০ সালে মুজিববর্ষ পালনের নামে শেখ হাসিনা গুজরাটের কসাই, হিন্দুত্ববাদের সর্দার নরেন্দ্র মোদিকে প্রধান অতিথি করে বাংলাদেশে এনেছিলেন। ছাত্র-তরুণরা প্রতিবাদ করায় তাদের হত্যা আর জেল-জুলুমের শিকার হতে হয়েছিল। বাংলাদেশের সুশীল সমাজের ‘মূলধারা’ তখন নীরব ছিল। মূলত তারা যে থরো-থরো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আবেগ দেখিয়ে থাকেন, সেখানে মুক্তিযুদ্ধ থাকে না, স্রেফ গণবিরোধী ওই চেতনাটুকুই থাকে।
৭ মার্চকে “জাতীয় ঐতিহাসিক দিবস” ঘোষণা এসেছিল মাত্র দুই বছর আগে। ২০২২ সালে। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের তখন চূড়ান্ত পর্যায় চলছে। ২০২২ সালের আগে কি বাংলাদেশে ৭ মার্চ যথাযথ ভাবগাম্ভীর্যের সাথে পালিত হয় নাই? “জাতীয় ঐতিহাসিক দিবস” আসলে কী? আমাদের ঐতিহাসিক দিবস কি একটা? আমাদের অসংখ্য ঐতিহাসিক দিবস রয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণ চড়া মাইকে প্রচার করে কান ঝালাপালা করার বাইরে আর কি ইতিহাস আওয়ামী লীগ জাতিকে শিখিয়েছে?
জাতীয় ঐতিহাসিক দিবস ঘোষণার প্রস্তাব সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে এসেছিল। হাইকোর্টে এ সংক্রান্ত একটি রিট পিটিশনের প্রেক্ষিতে যে দুটি সিদ্ধান্ত ছিল তার একটি হলো, ৭ মার্চকে জাতীয় ঐতিহাসিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা এবং দ্বিতীয়টি, প্রত্যেক উপজেলাতে যেন বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল নির্মাণ করা হয়।
অর্থাৎ ওই দিবস ঘোষণাও শেখ হাসিনার কোর্টরুম পলিটিকসের ফসল ছিল। নিজেদের পোষ্য বিচারকদের দিয়ে রুল এনে, তারপর রুলের দোহাই দিয়ে তা সরকারি অর্ডার জারি করা।
৭ মার্চ আগেও ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু ৭ মার্চকে ব্যবহার করে যেভাবে মুজিববাদী বয়ান আওয়ামীলীগ তৈরি করেছে, ইতিহাসের স্বার্থে তার বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকতে হবে। ফ্যাসিবাদের চূড়ান্ত পর্বে ঘোষিত “জাতীয় ঐতিহাসিক দিবস” বাতিল করাকে “ইতিহাস মোছার চেষ্টা” হিসেবে যারা দাবি করা গর্হিত কাজ।
|৪|
আসলে গণইতিহাস দূরে থাক, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের পক্ষে ঠিকমতো একটা দলীয় ইতিহাস লেখাও সম্ভব নয়। তাদের প্রচারিত ইতিহাসে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী, সিরাজুল আলম খান, তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, কামরুদ্দীন আহমদ, অলি আহাদ, আবুল মনসুর আহমদ, মুহাম্মদ আতাউর রহমান খান নাই! স্বাধীনতার ঘোষক মেজর জিয়াউর রহমান তো রীতিমতো পাকিস্তানপন্থী!
অথচ উল্লিখিতদের অধিকাংশই কিন্তু আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। মাওলানা ভাসানী ও সিরাজুল আলম খান ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের প্রধান দুই রূপকার। ছাত্র-শ্রমিকের ওই অভ্যুত্থানই শেখ মুজিবকে আগরতলা মামলা থেকে অব্যাহতি দেয় এবং তিনি কারামুক্ত হন। ওই গণঅভ্যুত্থান না ঘটলে শেখ মুজিবের ‘বঙ্গবন্ধু’ হওয়া হতো না।
অথচ মুনতাসীর মামুনরা ইতিহাস লিখেছেন শেখ মুজিব নাকি একটি ‘অনিচ্ছুক’ জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন! সত্যের খাতিরে বলতে হয়, বাংলাদেশের জনগণ একজন ‘অনিচ্ছুক’ নেতাকে স্বাধীনতার অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত করেছিলেন।
ইতিহাস ভালো করে পড়লে দেখা যায়, ৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিব ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি (এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম) উচ্চারণ করেছিলেন ছাত্রনেতাদের চাপে। মঞ্চের পেছন থেকে নাকি তার পায়জামা ধরে টান দিচ্ছিলেন ছাত্রনেতাদের কেউ কেউ। যেন তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তানভীর মোকাম্মেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তৎকালীন প্রভাবশালী ছাত্রনেতা এবং রাজনীতিবিদ আ স ম আব্দুর রব এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে যখন রাজপথ উত্তাল, শেখ মুজিব বন্দি অবস্থায় প্যারোলে আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছিলেন। তখনই রাজপথে স্লোগান ওঠে: “গোলটেবিল না রাজপথ? রাজপথ, রাজপথ!”
আন্দোলনকারী ছাত্র-শ্রমিকদের চাপে বন্দি অবস্থায় মুজিব আর আলোচনায় বসতে পারেন নাই। অর্থাৎ রাজপথের আন্দোলন মুজিবকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বাধ্য করেছিল; এর উল্টোটা নয়।
আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ইতিহাসের এসব রূঢ় সত্যের মুখোমুখি হওয়ার হিম্মত অর্জন করতে হবে। একক ব্যক্তির মহিমাময় রূপকথাকে ‘ইতিহাস’ নামে চালানোর চেষ্টা ধোপে টিকবে না। শেখ মুজিবের জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না কিসিমের নলা মার্কা বিশ্বাস থেকেও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বেরিয়ে আসতে হবে। বাহাত্তর-পঁচাত্তর রেজিম সম্পর্কে সত্য ইতিহাসের মুখোমুখি হতে হবে। ইতিহাসের বি-আওয়ামীকরণ তথা গণতন্ত্রীকরণ মেনে নিয়ে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে হবে। আইনি-বেআইনি বলপ্রয়োগ করে ইতিহাসের টুঁটি আর চেপে রাখা যাবে না, চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের অনেক অর্জনের অন্যতম এক অর্জন এই নতুন বাস্তবতা।
[বাহাত্তর-পঁচাত্তরের যেকোনো বিশ্বস্ত বইয়ে বর্তমান প্রবন্ধে উল্লেখিত তথ্যগুলোর হদিস মিলবে। তন্মধ্যে কয়েকটি বইয়ের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে: “বাংলাদেশ: শেখ মুজিবর রহমানের শাসনকাল”, মওদুদ আহমদ; “মুজিববাহিনী থেকে গণবাহিনী: ইতিহাসের পুনর্পাঠ”, আলতাফ পারভেজ; “বাংলাদেশের রাজনীতি: বঙ্গবন্ধুর সময়কাল”, হালিম দাদ খান; “জাসদের উত্থান-পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি”, “বেলা-অবেলা: ১৯৭২-৭৫”, মহিউদ্দিন আহমদ; “বাংলাদেশ: বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর”, মেজর নাসির উদ্দিন; “ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ, আহমেদ মূসা]