Logo
Logo
×

অভিমত

গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও ১/১১ এর অভিজ্ঞতা নিয়ে আমাদের আশঙ্কা

Icon

কায়সুল খান

প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ১২:২২ এএম

গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও ১/১১ এর অভিজ্ঞতা নিয়ে আমাদের আশঙ্কা

৫ আগস্ট, ২০২৪ বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম উজ্জ্বল একটি দিন হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। এ দিন ছাত্র-জনতার বিপুল বিক্রমে এগিয়ে চলা গণ-অভ্যুত্থানের ফলে টানা ১৬ বছর বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা বিদায় নিতে বাধ্য হন। সরকারি চাকরিতে বৈষম্যবিলোপের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলনের ওপর স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দলীয় কর্মী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক হওয়া নৃশংস আক্রমণের মাধ্যমে যেটি অহিংস ছাত্র আন্দোলন থেকে সহিংস রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ লাভ করে। মাত্র তিন সপ্তাহের কম সময়ে নানা পেশাজীবী ও বয়সী হাজারের ওপর ছাত্র-জনতা শহীদ হয়। আহত এবং গ্রেপ্তার হওয়া মানুষের সংখ্যা অগণিত। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কোটি কোটি নাগরিক বিক্ষুব্ধ হলে শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। যার ফলাফল হিসেবে আমরা দেখতে পাই শেখ হাসিনা সেনা হস্তক্ষেপে মাত্র ৪৫ মিনিটের নোটিসে বাংলাদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। 

বাংলাদেশের বিগত ৮০০ বছরের ইতিহাসে শেখ হাসিনা প্রথম ব্যক্তি যিনি ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়ে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিক শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার পতনের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের দ্বিতীয়বারের মত মুক্তি লাভ করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশে মানুষের জীবনে সবচেয়ে খুশির দিন হিসেবে লিপিবদ্ধ হয় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট।

শেখ হাসিনার ১৬ বছরের কর্তৃত্ববাদী স্বৈর-শাসনের শাসনের অবসানের পর বাংলাদেশ কার্যত ৩ দিন সরকারবিহীন অবস্থায় ছিল। ৮ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দায়িত্ব গ্রহণের মধ্যদিয়ে প্রাথমিক বিপদের আশঙ্কা থেকে বাংলাদেশের মানুষ স্বস্তি পায়। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে একটি অনির্বাচিত, অগণতান্ত্রিক অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব পালন করছে। 

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও তাদের সাথে জোটবদ্ধ দলগুলো ছাড়া অন্য সকল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ এবং দেশের জনসাধারণের আস্থায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার ১৬ বছরের হাসিনা যুগে আদালতসহ ধ্বংস হয়ে যাওয়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, ব্যাপক আর্থিক দুর্নীতির শিকার হওয়া ব্যাংক ব্যবস্থা, দলীয়করণে বিপর্যস্ত প্রশাসন-পুলিশ, অপরিকল্পিত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, অবৈজ্ঞানিক গণপরিবহন ব্যবস্থা প্রভৃতির সংস্কারের কাজ শুরু করেছে। 

বিগত দেড় দশকে বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক, আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গায় অপরাজনীতি যেভাবে স্থান করে নিয়েছে তা থেকে মুক্তি পাওয়া খুব সহজ কাজ নয়। এজন্য প্রয়োজন জাতিগত ঐক্য, ধৈর্য এবং মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ জাগ্রত করা। পৃথিবীতে মানুষে মানুষে মতৈক্য হবে সেটিই স্বাভাবিক, কিন্তু কোনো বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশের ভাষা হবে পরমতসহিষ্ণুতার কোমল আবহে। বাংলাদেশে পরমতসহিষ্ণুতার যে তীব্র অভাব দেখা দিয়েছে, যেভাবে মানুষে মানুষে পারস্পরিক আস্থা বিনষ্ট হয়েছে সেখান থেকে ফিরে আসার পথ যে বেশ দুর্লঙ্ঘনীয় হবে তা বলাই বাহুল্য। 

শেখ হাসিনার আমলে গুম ও খুনের ঘটনা ভয়ংকর ও আশংকাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছিল। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী (র‍্যাব, পুলিশ), রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই প্রত্যক্ষভাবে হাসিনা সরকারের বিরোধী মতের কয়েক শত থেকে কয়েক হাজার মানুষকে গুম ও খুন করেছে। শেখ হাসিনার আমলে ডিজিএফআই এর তত্ত্বাবধানে আয়নাঘরের মত অভূতপূর্ব জঘন্য ও গোপন কারাগারে বছরের পর বছর মানুষ গুম হয়ে থেকেছে। ভারত ও হাসিনার বিরোধী পক্ষের মতবাদ দমনে পুলিশ-প্রশাসন-বিচারালয় আইন, মানবিকতা এবং ন্যায়-নীতির তোয়াক্কা না করে মানুষের ওপরে যে জুলুম করেছে তা বর্ণনাতীত। পৃথিবীর ইতিহাসে শেখ হাসিনার মত আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর, নৃশংস, জিঘাংসু এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ শাসক খুব কম এসেছে। 

বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে গোপালগঞ্জের শেখ পরিবারের একচ্ছত্র অবদান ও ভূমিকা প্রতিষ্ঠা করতে শেখ হাসিনা যেভাবে সত্যের সাথে মিথ্যার সংমিশ্রণ ঘটাতে সর্বস্ব বিনিয়োগ করেছিলেন আজ দেখা যাচ্ছে সেই বিনিয়োগ সম্পূর্ণ বিফলে গেছে। হাসিনা সরকারের পতনের সাথে সাথে আওয়ামী লীগের রাজনীতির আইকনিক বিভিন্ন স্থাপনা ও দর্শনগত বয়ানকে নতুন প্রজন্মের ছাত্র-জনতা ধুয়ে মুছে দিতে দ্বিধাবোধ করেনি। শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার চেয়েও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দর্শনকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেওয়া বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ও প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলটিকে কার্যত অস্তিত্বের সংকটে ফেলেছে। কর্মীদের বিপদের মুখে ফেলে শেখ হাসিনার পলায়নবাদী আচরণের মূল্য অত্যন্ত চড়া দামে দলটিকে প্রদান করতে হবে বলে আমরা আশঙ্কা করি। 

২০১১ সালে বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্যদিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে তা শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করেছেন। হাসিনা মডেলে ২০১৪ সালের প্রতিযোগিতাহীন নির্বাচন অনুষ্ঠান করে ক্ষমতা লাভের পর বাংলাদেশের নাগরিকবৃন্দের জীবনে ঘোর অমানিশার সূচনা হয়। টানা দ্বিতীয়বার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই মূলত দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্ট চরিত্র লাভ করে। ২০১৫ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপশাসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে আওয়ামী ফ্যাসিবাদ চূড়ান্ত নিকৃষ্ট পর্যায়ে পৌঁছে। র‍্যাব, পুলিশের দ্বারা গুম-খুনের মত বিষয় স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়। যার ফলাফল হিসেবে ২০১৮ সালের নৈশভোট কিংবা ২০২৪ সালে ডামি নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ হয়তো ক্ষমতা লাভ করে কিন্তু দলের আভ্যন্তরীণ সুস্থ ও প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতির কবর রচিত হয় শেখ হাসিনার হাতে।

বাংলাদেশের রাজনীতির যে অকল্পনীয় ক্ষতি শেখ হাসিনার হাত ধরে সাধিত হয়েছে তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সমগ্র বাংলাদেশ। আমাদের স্মরণে রাখা জরুরি যে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কিন্তু জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আসা কোনো সরকার নয়। বিপ্লবী এই সরকারের জন্ম বাংলাদেশের সংবিধানের বিরুদ্ধে গিয়ে। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সংবিধানকে যেভাবে প্রায় অপরিবর্তনযোগ্য করেছে সেই বাস্তবতায় বাংলাদেশে নতুন একটি সংবিধান প্রণয়ন ভিন্ন সংস্কারের মাধ্যমে স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে নিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব। 

এমতাবস্থায় ড. ইউনূসের সরকার কীভাবে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা করে তার ওপর আমাদের গভীরভাবে নজর দেওয়া প্রয়োজন। আমরা ১/১১ এর ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন সরকারের শাসনামল দেখেছি। যেকোনো অরাজনৈতিক কিংবা সেনা শাসিত সরকারের আমলে সবচেয়ে বড় সমস্যার জন্ম নেয় একটি দেশের আর্থিক খাতে। বিদেশি বিনিয়োগের জন্য যে আস্থা ও বিশ্বাসের প্রয়োজন হয় তা এ ধরনের অরাজনৈতিক সরকারের আমলে সাধারণত অনুপস্থিত থাকে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা স্বাভাবিক থাকে না। দীর্ঘস্থায়ী অরাজনৈতিক সরকারের আমলে  জনগণের মাঝে একটা চাপা ও অজানা ভয় ভর করে। পাশাপাশি বাকস্বাধীনতা সংকুচিত হওয়ার তীব্র সম্ভাবনা তৈরি হয়। আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীকে অতিরিক্ত বল প্রয়োগের মত অপরাধে লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনাও আরেকটি উদ্বেগের কারণ হতে পারে। 

স্মরণে রাখা জরুরি যে মুক্তবাজার অর্থনীতির সাথে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার একটা প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে তর্কাতীতভাবে বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ভীষণভাবে সংকুচিত ছিল। রাষ্ট্রের ৪র্থ স্তম্ভ বলে স্বীকৃত সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা বলতে প্রায় কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। অপ্রথাগত কিংবা সামাজিক মাধ্যমেও মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিলুপ্ত প্রায় হয়েছিল। একথা সত্য যে হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের মানুষ আজ স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ পেতে শুরু করেছে সত্য। কিন্তু পৃথিবীতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থায় যে কোনো ক্ষমতাসীন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীই দীর্ঘস্থায়ীভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলে ক্রমশ ভয়ংকর ও দমনমূলক আচরণ করতে শুরু করে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পাঠ করলে শাসকের চরিত্রে এই আচরণের প্রমাণ মেলে। যুগে যুগে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও ভারসাম্য রক্ষা না করে একচ্ছত্র ক্ষমতা চার্চার সম্ভাবনা থেকেই স্বৈরতন্ত্রের জন্ম নিয়েছে। তাই আমাদের অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রতি আস্থাশীল হওয়ার পাশাপাশি তীক্ষ্ণ নজর রাখা জরুরি যেন বাংলাদেশ আবারো ১/১১ পরবর্তী একই প্রকৃতির রাজনৈতিক সংকটে পতিত না হয়। রাষ্ট্র সংস্কারের দায়িত্বে নিয়োজিত সরকার যেন নতুন স্বৈরাচারে পরিণত হওয়ার দুঃসাহস না দেখায়। 

বাংলাদেশের মানুষকে স্বৈরাচার মুক্ত করার জন্য জুলাই ২০২৪ এ জীবন দেওয়া শত সহস্র ছাত্র-জনতার রক্তের সাথে প্রতারণা করার অধিকার আমাদের কারও নেই। যে সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বপ্নে আমাদের অমিত সম্ভাবনাময় তরুণ-যুবা প্রাণ দিয়েছেন তাদের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শনের সর্বোত্তম উপায় হলো একটি গণতান্ত্রিক, সংস্কার বিবর্জিত এবং পরমতসহিষ্ণু বাংলাদেশ গঠন করা। সে জন্য সরকার এবং দেশের সকল নাগরিকের দায়িত্বশীল ও সময়োপযোগী আচরণ অত্যাবশ্যক। 

১৯৭১ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের সময় যে ভুল আমাদের তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ করেছিলেন তার পুনরাবৃত্তি রুখে দিয়ে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম এবং আত্মমর্যাদাশীল বাংলাদেশ গড়ে তোলা হোক আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্য; যে বাংলাদেশে ধর্ম, বর্ণ, দর্শন নির্বিশেষে সকলের জন্য ন্যায় ও সাম্য নিশ্চিতে রাষ্ট্রযন্ত্র সদা সচেষ্ট থাকবে। সমগ্র বাংলাদেশবাসী রাষ্ট্র সংস্কারের যে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন তার সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিতের জন্য পুরাতন সংবিধানকে বাতিল করে আধুনিক রাষ্ট্রনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি নতুন ও অনন্য বৈশিষ্ট্যের সংবিধান প্রণয়ন করা সম্ভবত সবচেয়ে জরুরি বিষয়গুলোর মাঝে অন্যতম। আমরা সমৃদ্ধির বাংলাদেশের সম্ভাব্য ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আশাবাদী হতে পারি কি?

কায়সুল খান

গবেষক ও কলামিস্ট 

নোভা ইউনিভার্সিটি অফ লিসবন, পর্তুগাল

[email protected]  

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন