Logo
Logo
×

অভিমত

সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন: আওয়ামী লীগ পুনর্বাসন প্রকল্প

Icon

শেখ ওমর

প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২৪, ১২:৫৮ পিএম

সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন: আওয়ামী লীগ পুনর্বাসন প্রকল্প

সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন (Proportional Representation) এমন একটি নির্বাচন পদ্ধতি যেখানে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাত অনুযায়ী সংসদ বা আইনসভায় আসন বণ্টন করা হয়। সরাসরি ভোটের মাধ্যমে একটি দল যে পরিমাণ ভোট পায়, সেই অনুযায়ী তাদের প্রতিনিধিত্ব সংসদে নিশ্চিত করা হয়। অর্থাৎ, একটি দল যদি ৩০% ভোট পায়, তবে তারা সংসদে মোট আসনের ৩০% লাভ করবে। এই পদ্ধতির লক্ষ্য হচ্ছে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় জনগণের ভোটের শতকরা হারের ভিত্তিতে সংসদে প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করা। 

সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির উদ্ভব ঘটে উনিশ শতকের ইউরোপে। বিভিন্ন দেশ যখন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকার গঠন করছিল, তখনই কিছু দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিহত করার জন্য সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের ধারণাটি আসে। এই পদ্ধতির প্রথম ব্যবহার হয় বেলজিয়ামে ১৮৯৯ সালে। এর পরবর্তী সময়ে ইউরোপ ও অন্যান্য দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এটি প্রয়োগ হতে থাকে।

যদিও সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির উদ্দেশ্য ছিল ভোটের সঠিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা, কিন্তু অনেক দেশে এই পদ্ধতির দুর্বলতা ও ব্যর্থতা পরিলক্ষিত হয়েছে। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো দুর্বল ও অস্থিতিশীল সরকার গঠন হওয়া। কেননা, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে কোনো একক দল সাধারণত সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে না, ফলে জোট সরকার গঠন করতে হয়। জোট সরকারের ক্ষেত্রে দলগুলোর স্বার্থের সংঘাত বেশি হয় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে দেরি হয়, যা সরকারের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এই ধরনের একটি পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে জার্মানিতে অ্যাডলফ হিটলার ক্ষমতায় এসেছিলেন।

সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির একটি বড় সমস্যা হিসেবে দুর্বল ও অস্থিতিশীল সরকার গঠনের উদাহরণ ইতিহাসে অনেকবার দেখা গেছে। ওয়েমার প্রজাতন্ত্র (জার্মানি, ১৯১৯-১৯৩৩)-তে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির কারণে ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলো পার্লামেন্টে অনেক বেশি আসন পেয়েছিল। ফলে বারবার জোট সরকার গঠিত হয়, কিন্তু এসব সরকার দীর্ঘস্থায়ী ছিল না এবং প্রায়ই অস্থিতিশীল ছিল। ফলাফল হিসেবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক সংকটের কারণে জার্মান জনগণের আস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অ্যাডলফ হিটলারের নাৎসি পার্টি ক্ষমতা দখল করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা অনুসরণ করে ইতালিতে প্রায় প্রতিটি সরকার ছিল জোট সরকার। ছোট রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়ই জোটের ভেতরে অসন্তোষ সৃষ্টি করত, যার ফলে সরকারগুলো দীর্ঘমেয়াদী হতে পারত না। ফলে ১৯৪৫ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত সময়ে ইতালিতে প্রায় ৫০টির বেশি সরকার পরিবর্তিত হয়, যা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার স্পষ্ট উদাহরণ।

বেলজিয়ামের সংখ্যানুপাতিক ব্যবস্থায় বড় রাজনৈতিক বিভাজন রয়েছে ভাষাভিত্তিক ও সাংস্কৃতিক কারণে। ২০১০ সালে বেলজিয়ামে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও পরবর্তী ৫৪১ দিন কোনো কার্যকরী সরকার গঠিত হয়নি, যা একটি বিশ্ব রেকর্ড। ফলে সেখানে তীব্র রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হয় এবং দীর্ঘমেয়াদী আলোচনা সত্ত্বেও বেলজিয়ামে কার্যকরী সরকার গঠন করা সম্ভব হয়নি, যা দেশটির শাসন ব্যবস্থায় জটিলতা সৃষ্টি করেছে।

ইসরায়েলে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির সংসদ রয়েছে। এই পদ্ধতির কারণে ইসরায়েলে বিভিন্ন ছোট রাজনৈতিক দল সেদেশের জোট সরকারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফিলিস্তিনে আগ্রাসনের ব্যাপারে এই ছোট দলগুলোর ভূমিকা অনেক বেশি। এসব ছোট দল প্রায়ই বিশেষ স্বার্থ রক্ষা করে এবং জোটের ভেতর অস্থিরতা সৃষ্টি করে। এর ফলে ইসরায়েলে সরকার প্রায়ই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না, যেমন ২০১৯-২০২২ সালের মধ্যে ইসরায়েলে পাঁচ পাঁচটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

ভারতের রাজ্যসভাগুলোতেও আংশিক সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা আছে। এই সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা ভারতের রাজ্যসভাগুলোর কার্যকারিতার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। রাজ্যসভাগুলোতে আঞ্চলিক দলগুলো কখনো কখনো মাত্রাতিরিক্ত শক্তি পায়, যা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রায়ই জটিলতা তৈরি করে। রাজ্যসভাগুলোর বিভিন্ন দলের মধ্যে মতানৈক্যের কারণে আইনের প্রণয়ন প্রক্রিয়া ধীর হয়ে যায় এবং কার্যকর উদ্যোগ নিতে অসুবিধা হয়। কিছু ক্ষেত্রে রাজ্যসভাগুলো রাজ্য সরকারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, বিশেষত যদি রাজ্যসভায় সরকার পক্ষের সংখ্যা কম থাকে।

এসব উদাহরণ থেকে বোঝা যায়, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি ছোট দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করলেও এর ফলে জোট সরকারের মাধ্যমে অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি থেকে যায়।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, ইসরায়েল ও ভারতে ব্যর্থ এই সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা বাংলাদেশে চালুর জন্য প্রস্তাব করছে ভারতপন্থী দলগুলোই!

বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশক থেকে সিপিবি ও অন্যান্য বামপন্থি দলগুলো সংখ্যানুপাতিক ব্যবস্থার পক্ষে কথা বলে আসছে। ২০১৩ সালেও সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম দশম সংসদ নির্বাচনের আগে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা তুলেছিলেন। [tinyurl.com/mrxt9pf4]

গত ৫ই আগস্টে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভ্যুত্থানের পর সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার বিষয়টি সবার আগে আলোচনায় আনেন পতিত স্বৈরাচারের গণধিকৃত প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের মাত্র এক সপ্তাহের মাথায় গত ১৭ই আগস্ট ২০২৪ তারিখে কাজী হাবিবুল আউয়াল দৈনিক সমকালে লেখা একটি কলামে এই পদ্ধতি চালুর পক্ষে মতামত দেন। [tinyurl.com/2epwewmr]

এছাড়া জাতীয় পার্টি ও চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলনও এই পদ্ধতির পক্ষে। অর্থাৎ বাংলাদেশে যেসব দল ও ব্যক্তি এই সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার কথা তুলেছে, তারা সবাই ভারতপন্থী রাজনৈতিক দল/ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত। জামায়াতে ইসলামীও এই পদ্ধতির পক্ষে কথা বলা শুরু করেছে। স্বৈরাচার পতনের পর ভারতের সাথে জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক সংযোগ পুনঃস্থাপিত হওয়ার পর থেকে।

এই সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিটি তার জন্মভূমি ইউরোপেই ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশে এই পদ্ধতির সাফল্যের সম্ভাবনা আরো অনেক কম। কেননা, বাংলাদেশে নির্বাচন ও রাজনীতির ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশের ভোটারদের একটি বড় অংশ স্বল্প শিক্ষিত এবং রাজনৈতিকভাবে অজ্ঞ/অন্ধ। অন্তত ৮৫% ভোটার দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে ভোট দেয়। তাছাড়া, ভোট বিক্রি হওয়ার একটি "ঐতিহ্য" তো বাংলাদেশে আছেই। তাই সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি বাংলাদেশের সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

তাহলে এই সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতিটি বাংলাদেশে আমদানির তোড়জোড়ের আসল উদ্দেশ্য কী?

ইসরায়েল-ভারতের এই নির্বাচন পদ্ধতিটি বাংলাদেশে চালু করলে সেটার সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হবে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে হেরে গিয়েও প্রায় ৪০% ভোট পেয়েছিল। দেশের ১০% সংখ্যালঘু ভোট ও বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলের ভোটের একটা বড় অংশ এখনো আওয়ামী লীগই পাবে। তাই আগামী নির্বাচনে তাদের পক্ষে সারাদেশে গড়ে কমপক্ষে ২০% ভোট পাওয়া খুবই সম্ভব। 

যদি সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি বাংলাদেশে প্রয়োগ করা হয়, তবে আওয়ামী লীগ এই ২০% ভোটের ভিত্তিতে আগামী সংসদে ২০% আসন অর্থাৎ অন্তত ৬০ জন এমপি পেতে পারে। ছাত্র-শ্রমিক-জনতার বিপুল আত্মত্যাগের বিনিময়ে গঠিত হবে যে সংসদ, সেই সংসদে পতিত স্বৈরাচারের অন্তত ৬০ জন এমপি নিশ্চিত করতেই কি চাচ্ছে ইসরায়েল-ভারতপ্রেমী দলগুলো?

এটা কেমন রাজনৈতিক আবদার যে, দেশে গড়ে ২০% আওয়ামী ভোট থাকলেই আওয়ামী লীগকে সংসদে ২০% আসন দিতে হবে? বাংলাদেশে ১৬% মানসিক রোগী আছে বলে বিভিন্ন সময়ে জরিপে প্রকাশ পেয়েছে। তাহলে কি মানসিক রোগীদের মধ্য থেকে সংসদে ১৬% এমপি দিতে হবে?

ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের বিদেশি প্রভুরা জানে যে, বাংলাদেশে প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে দেশের তরুণ প্রজন্মের গণঘৃণার মুখে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে সারাদেশে দশটি আসন জেতাও সম্ভব নয়। তাই ইসরায়েল-ভারতের মদদপুষ্ট আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক পুনর্বাসন করার জন্য বাংলাদেশে এই সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক সংসদ গঠনের ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। ইসরায়েল-ভারতের এই ব্যর্থ নির্বাচনী মডেল বাংলাদেশের ছাত্র-শ্রমিক-জনতা শুধু প্রত্যাখ্যানই করবে না, প্রতিহতও করবে।

শেখ ওমর: এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন