৭১ এর ষোড়শ ডিভিশন ও ২৪ এর অতিবিপ্লবী এবং ইনক্লুসিভ রাষ্ট্রের স্বপ্ন
অনেকে জুলাই বিপ্লব পরবর্তী বিষয়গুলো নিয়ে কথা তুলেছেন। থানায় আগুন, ফ্যাসিস্ট রেজিমের নেতাদের ওপর গণক্ষোভ, পুলিশ হত্যা, এসব বিষয় তার অন্তর্ভুক্ত। এসব বিষয়ে বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াও শুরু হয়েছিল হঠাৎ করেই। আর সেই ব্যবস্থা ছিল অনেকটা প্রতিবিপ্লবের প্রতিচ্ছবি। বিপ্লব পরবর্তী অগোছালো অবস্থাকে সামনে রেখে যে প্রতিবিপ্লব ঘটানোর চেষ্টা ছিল, অনেকে তাই মনে করছেন। কিন্তু সরকার বুঝতে পেরে তা সামাল দিয়েছে। ফরাসি বিপ্লব সম্পর্কে যাদের জানা আছে, তারা জানেন বিপ্লব পরবর্তী সময় গণরোষ কতটা লাগামছাড়া থাকে। সেই অবস্থা বলা যায় অনিয়ন্ত্রণযোগ্য। বিপ্লব পরবর্তী তাৎক্ষণিক ক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ করা এককথায় অসম্ভব। কোনো বিপ্লবেই তা করা যায়নি।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথাই বলি। লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের ভাষায়, “১৬ ডিসেম্বর ঢাকা মুক্ত হলো। আমি তখন গ্রামে। অনেক জায়গায় শুরু হলো বাঙালির ‘বিহারি’ নিধন; তাদের বাড়ি, গাড়ি, দোকান আর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দখল। কয়েক দিনের মধ্যেই মিরপুর ও মোহাম্মদপুরের জনমিতি বদলে গেল। অবাঙালি-অধ্যুষিত এই এলাকাগুলোর বাড়ির মালিক হয়ে গেলেন বাঙালিরা। তাঁরা নানা বর্ণের ‘মুক্তিযোদ্ধা’; কেউ প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা, ৯ মাস ছিলেন ভারতে। কেউ ষোড়শ ডিভিশনের সদস্য। সবার হাতে পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া অস্ত্র। কেউ কেউ অবশ্য ‘জেনুইন’মুক্তিযোদ্ধা।” দেখুন তো তুলনা করে ২৪ পরবর্তী সময়ে অনেকটা এরকমই ঘটেছে কিনা। মিলে কিনা মহিউদ্দিন আহমদের বয়ানের সাথে।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় অনেক ‘বাঙালি’ হয়ে গেলেন বিহারীদের বাড়ি, গাড়ি, সম্পদের মালিক। মহিউদ্দিন আহমদের ভাষ্য অনুযায়ী, যারা মালিক হলেন, তাদের অনেকেই প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা, কেউ ষোড়শ ডিভিশনের সদস্য। ২৪ এর বিপ্লব পরবর্তীতেও তাই হয়েছে। যারা মূল বিপ্লবী তারা লেগে গেলেন দেশ গঠনের কাজে, আর যারা সেই ‘ষোড়শ ডিভিশন’ তারা লেগে গেলেন দখলদারিত্ব আর লুটপাটে।
যাদের বিপ্লবকালীন সময়ে কোনো খোঁজখবর ছিল না, উল্টো কেউ কেউ ফ্যাসিস্টদের তোষামোদিতে ব্যস্ত ছিলেন তারা বিপ্লব পরবর্তী সময়ে হয়ে গেলেন অতিবিপ্লবী। এই অতিবিপ্লবীদের আস্ফালনে ২৪ এর বিপ্লব মাঝেমধ্যেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে। অতিবিপ্লবীর বিষয়ে আমার মরহুম পিতা একটা কথা বলতেন। তিনি বলতেন, ‘অতিবিপ্লবী মানেই প্রতিবিপ্লবী’। কথাটা যে মিথ্যা নয়, তা প্রতিটা বিপ্লবের পরেই তা প্রমাণ হয়েছে। একাত্তরেও হয়েছিল বিহারীদের হত্যা ও সম্পদ দখলের মধ্যে দিয়ে। ২৪শেও তাই।
এই অতিবিপ্লবী কারা এটা চিহ্নিত করা খুব কঠিন নয়। বিশেষ করে ফ্যাসিস্ট রেজিমে নির্যাতিতরা এদের চেনে ভালোভাবে। আল জাজিরাখ্যাত অনুসন্ধানী সাংবাদিক প্রিয়জন জুলকারনাইন শায়ের খান সামাজিকমাধ্যমে এমন সব অতিবিপ্লবীদের একটি লিস্ট পোস্ট করেছেন এবং তিনি দাবি করেছেন সেই লিস্ট একটা গোয়েন্দা সংস্থার করা। তার কোনো তথ্য খুব কমই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং এসব অতিবিপ্লবীদের চিহ্নিত করা খুব কঠিন কাজ নয়। হয়তো গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যে অনেকেরই নাম আসেনি। কিংবা পরে আসবে। সুতরাং অতিবিপ্লবী চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়েছে এবং করা হচ্ছে, এটা নিশ্চিত।
অতিবিপ্লবীরা যেমন প্রতিবিপ্লবকে সহায়তা করে এবং একসময় নিজেই বনে যায় প্রতিবিপ্লবী। এবং তা নিজের অজান্তেই। আর জাত প্রতিবিপ্লবীরা তো রয়েছেই। এমনি এক প্রতিবিপ্লবীর কথা বলি। সে আমার পরিচিত জন লেখালেখি করেন এবং তিনি নারী। সাথে ভালো চাকরিও করেন এবং ফ্যাসিস্ট ঘরানার প্রতি বিশ্বস্ত মানুষ। নারীদের সাথে এমনিতেই সাবধানে কথা বলতে হয়, তারপর ফ্যাসিজমের সমঝদার।
তিনি বললেন, তার আয়ে এখন সংসার চলছে না। অন্তর্বর্তী সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ। জিনিসপত্রের দাম বিগত শাসনামলের চেয়ে অনেক বেশি। অথচ ফ্যাসিস্ট আমলের শেষের দিকে ডিমের দাম উঠলো পনেরো টাকা প্রতিটা। মরিচের কেজি হলো ১ হাজার ২০০ টাকা। পেঁয়াজ ভারত বন্ধ করে দিলে উঠে গিয়েছিল চারশ টাকার ওপরে। তখন কিন্তু তাদের সংসার চলছিল, এখন চলছে না। তখন তাদের কাছে বাড়তি মূল্য সহনীয় ছিল, এখন সহ্য হচ্ছে না।
তিনি দাবি করলেন, ৫ আগস্টের পর তিন হাজারের ওপর পুলিশ হত্যা করা হয়েছে। ফ্যাসিস্ট অনুসারীরা অকাতর খুনের শিকার হয়েছেন। আমি বললাম, এ হিসেব আপনাকে কে দিলো। বললেন, ফেসবুকে দেখেন না। আমি বললাম, এগুলো যে ফেইক, তা ফ্যাক্ট চেক প্রমাণ করেছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা, সেই ফেইক খবরই তার কাছে গীতার শ্লোক হয়ে গেছে।
সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার, শহীদ আবু সাঈদের হত্যাকেও সে প্রোপাগান্ডার সূত্র ধরে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এমনকি শহীদের সংখ্যাও তার কাছে অবিশ্বাস্য। তার ধারণা পঞ্চাশ থেকে ষাটজন মারা গেছেন। আর সব বাড়িয়ে বলা হয়েছে। এসবই তার কাছে সত্যিকার অর্থেই গীতার শ্লোকের মতন বিশ্বাসযোগ্য। ফ্যাসিজম তার কাছে ধর্মবিশ্বাসের মতন। বলতেন পারেন, এক ধরনের কাল্টের চর্চা। গুরুর কথায় কোনো ভুল নেই। যেমন নেই ফ্যাসিজমের আইকনের ব্যাপারে। ফ্যাসিজম ও কাল্টচর্চার মধ্যে মিলের জায়গাগুলো গুরুত্বপূর্ণ। এদের প্রধান মিল হচ্ছে ডগমাটিজমে। এরা হয় ভয়াবহ রকম ডগমাটিক। আর ডগমাটিকরা একসময় সঙ্গতই হয়ে ওঠে এক্সট্রিমিস্ট। আমাদের পূর্বাপর বিশ্লেষণ করলে সেই এক্সট্রিমিজমের চিত্রই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এপিসি থেকে ফেলে দেওয়া ইয়ামিনের দেহ, রিকশার পাদানিতে ঝুলে থাকা শহীদের শরীর, এদের অনুভূতিকে উদ্বেলিত করে না, যেমনটা করে একটা কংক্রিটের মূর্তিকে ভেঙে ফেলায়। তারা ভাবে না কংক্রিটের মূর্তি নির্মাণযোগ্য কিন্তু মানুষের জীবন বিনির্মাণ করা যায় না।
এসব কথা হালকা ভেবে নেওয়ার কারণ নেই। এদেশের মানুষ অনেক সময়ই ইউটোপিয়ান বয়ানেই বিশ্বাস করে। না হলে, দীর্ঘদিন যাবত এক ট্যাবু, যাকে বলা হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’, সেই ট্যাবুতে ভর করে সকল অপকর্মকে জায়েজ করা যেত না। লুটপাট, দখলদারিত্ব সব ঢেকে দেওয়া হয়েছে সেই চেতনার চাদরে। এত অপকর্মের পরও একদল হা-হুতাশে ব্যস্ত।
ফ্যাসিজমের প্রত্যাবর্তনের নিমিত্তে যে হা-হুতাশ। ফরাসি বিপ্লবের পর ফ্যাসিজমের সকল আইকনিক সিম্বল ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। যাতে কোনো পথ ধরেই ফ্যাসিজম ফিরতে না পারে। ফলেই ফ্যাসিজমের প্রত্যাবর্তন সম্ভব হয়নি। সুতরাং ফ্যাসিজম ঘৃণা করবেন, কিন্তু ফ্যাসিজমের আইকনকে পূজা করবেন, এটা স্রেফ দ্বিচারিতা। যারা করছেন, তারা বরং সরাসরি জানান দিন, আপনি ফ্যাসিজমের সমর্থক। ফ্যাসিজমে একটা পপুলিজম থাকে।
একশ্রেণির মানুষ শক্তির পূজা করে। যেমন, জেলেদের অনেক সম্প্রদায় সমুদ্রকে পূজা করে ধ্বংস ক্ষমতার জন্য। তেমনি যারা চান তারা ফ্যাসিজমের পূজা করতে পারেন। আর যদি ফ্যাসিজমের বিরোধিতা করেন, তবে ফ্যাসিজমের আইকনেরও বিরোধিতা করেন। ফ্যাসিজম ফিরে আসে তার রেখে যাওয়া আইকনের মাধ্যমে। এ ব্যাপারটা মাথায় না থাকলে ব্যর্থ হবে আমাদের ২৪ এর বিপ্লব। এই বিপ্লব ৭১ এর ধারাবাহিকতা। কারণ ৭১ এ আমরা একটা ইনক্লুসিভ রাষ্ট্র গড়তেই অস্ত্র ধরেছিলাম। কিন্তু আমাদের ব্যর্থ করে দিয়েছে, আমাদের হতাশ করেছে সেই ফ্যাসিজম। সেই হতাশা থেকে মুক্ত হতেই আমরা ৯০ এর গণঅভ্যুত্থান করেছি। কিন্তু সেই অভ্যুত্থান শেষ পর্যন্ত বিপ্লবে রূপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা আবারও হতাশ হয়েছি। সেই হতাশাকে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ততায় রূপ দিয়েছিল ‘ওয়ান ইলেভেন’। এই ওয়ান ইলেভেনের হাত ধরেই দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এক ভয়াবহ ফ্যাসিস্ট রেজিম। ২৪ এর জুলাই বিপ্লবে সহস্রাধিক প্রাণের বিনিময়ে আমরা আবার একটা ইনক্লুসিভ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখছি। আমাদের এই স্বপ্ন যেন পুনর্বার ব্যর্থ না হয়।