মানুষের কথা শুনুন সাকিব, এই মূহূর্তে দেশে আসবেন না প্লিজ
আব্দুর রহমান
প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ১১:১৪ এএম
সাকিব আল হাসান। ছবি সংগৃ
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের দামামা বেজে উঠেছে, ঢাকা এসেছে প্রোটিয়ারা। বাংলাদেশ দল ঘোষণা করা হয়েছে। টেস্ট দলে আছেন বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আলোচিত, সমালোচিত ও নিন্দিত সাকিব আল হাসানও। এই প্রথমবারের মতো সাকিব আল হাসানের দলে থাকা নিয়ে সমালোচনাই হচ্ছে না, দেখা দিয়েছে নানা শঙ্কাও।
সাকিব আল হাসান, দেশের সেরা ক্রিকেটার, শুধু দেশেরই নয়, বছরের পর বছর তিনি ছিলেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। তিনি বাংলাদেশের ক্রিকেটের এক মহাতারকা। বাংলাদেশের ক্রিকেটে গত দেড় দশকে যা কিছু অর্জন তাতে কোনো না কোনভাবে আছে সাকিবের নাম। আবার যেখানে যেখানে বিপর্যয় সেখানেও নিশ্চিতভাবে উঠে আসবে তার নামটি। সেই সাকিব এখন গ্যাড়াকলে পড়েছেন। ক্রিকেট জীবনই নয়, চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে তার জীবনই, সাকিব আল হাসান টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন। দেশের হয়ে সাদা পোশাকের শেষ ম্যাচটি তিনি খেলতে চান হোম অব ক্রিকেট শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেই টেস্ট শুরু হচ্ছে ২১ অক্টোবর থেকে।
এখানেই বেধেছে গোল, গোল এখন গন্ডগোলে পরিণত হয়েছে। সাকিব মিরপুরে খেলতে চান কিন্তু একটি চরম প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে তার ইচ্ছাটি। সাকিব মিরপুরে খেলার জন্য দেশে ফিরতে, দেশে অবস্থানকালে, খেলাকালে নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন, দাবি জানিয়েছেন খেলা শেষে পরিবারের সাথে মিলতে যুক্তরাষ্ট্রে নিরাপদে ফেরার ব্যবস্থা করার। এরই মধ্যে জানা গেছে, শুক্রবার দেশে ফিরবেন সাকিব।
সাকিব এই ঘোষণাটি এমন এক সময় দিলেন যখন শুধু সাকিব নয়, পুরো আওয়ামী লীগই একধরনের পলাতক অবস্থায় আছে। সাকিব আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য, তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। শেয়ারবাজারে অনিয়মের দায়ে তাকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তাই খেলার মানুষ আর মাঠের মানুষ সাকিব আল হাসান নিজেই পড়ে গেছেন এক ভিন্ন খেলার মধ্যে। আর তা হলো রাজনীতির খেলা।
সাকিব আল হাসানের ব্যাপারে একটি কথা বলা যায়, তিনি ফুলটাইম বিজনেস ম্যান, পার্ট টাইম খেলোয়াড় আর অকেশনাল রাজনীতিবিদ। রাজনীতি তো রাজনীতি, সংসদ সদস্য বিষয়টাকেই তিনি ধারণ করেছেন কি না তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বিগত সংসদ ছিল সাকিবের প্রথম সংসদ, একজন সংসদ সদস্যের কাছে সংসদের প্রথম অধিবেশনটা একটু বিশেষ, একটু বেশিই আকর্ষণীয়, কিন্তু এ বছরের ৩০ জানুয়ারি সংসদের উদ্বোধনী অধিবেশনে না গিয়ে সাকিব খেলতে নেমেছিলেন মাঠে।
সাকিব আল হাসান বিতর্কের আরেক নাম, কিন্তু শুধুই কি বিতর্ক? ভালবাসার নাম কি নয় মোটেও? বাংলাদেশের হারে সহখেলোয়াড়কে জড়িয়ে ধরে সাকিবের কান্নার ছবি কী আমাদের চোখকে অশ্রুসিক্ত করেনি? জাতীয় পতাকাকে নায়কোচিত সেই স্যালুট জানানোর দৃশ্য কি আমাদের আন্দোলিত করেনি? ব্যক্তি সাকিবের সব আচরণ একজন পছন্দ নাও করতে পারেন, খেলোয়াড় সাকিবের সবটাও গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে, কিন্তু এ কথা সবাই জানে এবং সম্ভবত মানে সাকিব হচ্ছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের পোস্টার বয়। ক্রিকেট দুনিয়ায় বাংলাদেশ আর সাকিব অভিন্ন পরিচয় নিয়ে বিরাজ করে।
ভারতের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টের আগে সংবাদ সম্মেলনে সাকিব আল হাসান জানান, তিনি টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানাবেন। সাকিবের টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণাটা অস্বাভাবিক সময়ে এসেছে, তিনি কি আরেকটু রয়ে-সয়ে এ সিদ্ধান্তটা নিতে পারতেন না? সাকিবের ব্যাপারে আন্দালিব রহমান পার্থের একটি কথা নেটওয়ার্ল্ডে সয়লাব। পার্থ বলেছিলেন, ‘আল্লাহ পাক সাকিবকে নৈতিকতা বাদে সবকিছু দিয়েছেন।’
সাকিব কি এই খারাপ সময়ে অবসরের ঘোষণা দিয়ে আরেকটি ‘ডার্টি গেম’ খেললেন? যা অনৈতিকও, তিনি কি দেশের মানুষের ক্ষোভের আগুনে আরেকটু কেরোসিন ঢাললেন? খুব সুকৌশলে তিনি মানুষকে দু’ভাগ করে দিলেন। যখন তার বিচারের বিষয়টাই হওয়া উচিত অগ্রাধিকার (সাজা নয়, বিচার) তখন তিনি টেস্ট খেলা থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়ে মানুষকে ভাগ করে ফেললেন! একদল তার বিচারের দাবি করছে, আরেক দল তার কীর্তি তুলে ধরে প্রশংসার বানে ভাসাচ্ছে। এতে আড়ালে চলে যাচ্ছে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আশির্বাদপুষ্ট সাকিবের সব অপকীর্তি। সাকিব না খেলার একটা ভালো ছুঁতা পেয়ে চলে যাবেন নিউইয়র্কে যেখানে রয়েছে তার পরিবার। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে উপভোগ করবেন আমেরিকার জীবনের সুখ। তিনি ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নিতে না পারার জন্য, একাত্ম হতে না পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। সেই সাথে তিনি বলেছেন, তিনি রাজনীতিতে জড়িয়েছিলেন নিজ এলাকা মাগুরার উন্নতির জন্য। সাকিব বলেছেন, তার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন ক্রিকেট খেলে মানুষের ভালোবাসা পাওয়া। সাকিবের এই ভাষ্যে মানুষের মন গলার কথা, কিন্তু খুব একটা গলেছে বলে মনে হয় না। কান পাতলেই শোনা যায় সাকিববিরোধী নানা কথা।
প্রশাসন আর বিসিবি সাকিবকে নিরাপত্তা দিতে হয়তো কোনো ত্রুটি করবে না, কিন্তু দেশের সেরা ক্রিকেটারটি মাঠে নামার পর থেকে পুরোটা সময় দুয়োধ্বণির মুখে যে পড়বেন না সে নিশ্চয়তা কে দেবে? সব শ্রেণির মানুষ বিশেষ করে তরুণ আর ছাত্রদের ক্ষোভ যে কমেনি তা বুধবার হাইকোর্টে বিচারপতিদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে আরেকবার ফুটে উঠেছে। এ সময় সাকিব দেশে ফেরার কথা ভাবেন কী করে?
সাকিব আর বিতর্ক দু’জন দু’জনার। বাজিকরদের খপ্পরে পড়ে নিষিদ্ধ হয়েছেন। দেশের মানুষ তার আনন্দে যেমন আনন্দিত হতো, তেমনি তার বেদনায় ব্যথিতও হতো, কিন্তু বিস্ময়কর হলো সাকিব বিপাকে পড়লে খুশি হতেন এমন মানুষের সংখ্যাও কম না। সাকিবের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের কারণে তার সমালোচকদের অনেকেই শুধু তার সমালোচকই ছিলেন না, পরিণত হয়েছিলেন তার বিনাশকামী শত্রুতে।
সাকিব তার শেষ ম্যাচ খেলার জন্য নিরাপত্তা চেয়েছেন, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতিতে সাকিবের নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যাপারে বিসিবি সভাপতি কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারেননি। সরকারের যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেছেন, সাকিবের দু’টি সত্তা। একটি খেলোয়াড় বা ক্রিকেটারের সত্তা, আরেকটি তার রাজনৈতিক সত্তা। তিনি জানিয়েছেন, ক্রিকেটার সাকিবকে সব ধরনের নিরাপত্তা দেবে সরকার।
সাকিব আল হাসানের উত্থান আর পথচলা সাফল্যে মোড়া, কিন্তু তার শেষটা কি ট্র্যাজিক বা বিষাদময় হতে যাচ্ছে? আমাদের দেশে তারকাদ্যুতি ছড়ানো মানুষের বড়ই অভাব, সাকিব এক মহাতারকা। তারকাসুলভ রাজসিক বিদায়ই তার প্রাপ্য। দেশের মানুষ সাকিবকে তা দিতে কুণ্ঠাবোধ করবে না, কিন্তু সে জন্য সাকিবকে একটু সময় নিতে হবে, দেশের মানুষকে একটু ধাতস্ত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। সাকিবের কাছে অনুরোধ, মানুষের রাগ আর ক্ষোভের সময়টাকে আপনি দেশে ফেরার জন্য দয়া করে বেছে নেবেন না, এই মুহূর্তে আপনি দেশে ফিরবেন না প্লিজ।
টেস্ট ম্যাচ থেকে অবসরের ঘোষণাটি আপাতত তুলে রাখুন। অন্তত আরও দু’টি বছর তিনি যদি টেস্ট না হোক ক্রিকেটের সাথে থাকেন তাহলে সাকিব ঘৃণা নিয়ে নয়, মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েই তার ব্যাট বল তুলে রাখতে পারবেন।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন