সাম্প্রদায়িক হামলা এবং প্রপাগান্ডার রাজনীতি
পূজামণ্ডপে ইসলামি সংগীত গাওয়ার সময়ের একটি চিত্র। ভিডিও থেকে নেওয়া ছবি
লেখাটি শুরু করতে গিয়েই যে প্রবাদটি মনে পড়লো তা হলো ‘ঘর পোড়ার মধ্যে আলু পোড়া’ খাওয়া। এবারের শারদীয় দুর্গাপূজার সময় তেমনই এক পরিস্থিতি দেখছি আমরা।
এবার দুর্গাপূজা এসেছে একটি বিশেষ রাজনৈতিক পরিবেশে। দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনের পর শেখ হাসিনার শাষিত আওয়ামী লীগ সরকার উৎখাত হয়েছে ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। বর্তমানে দেশ পরিচালনা করছেন অন্তর্বর্তী সরকার। পূর্বের সরকারের রেখে যাওয়া নানা জঞ্জাল এখন এই সরকারের কাঁধে। তার ভেতর রয়েছে ভেঙে পড়া রাষ্ট্র কাঠামোর পুনঃনির্মাণের কাজ। দেশের আইন শৃঙ্খলার অবস্থা এখনো নাজুক। সুযোগসন্ধানী নানা গ্রুপের তৎপরতাও আমরা দেখছি। এই পরিস্থিতিতে নানা রকম শঙ্কা আর উদ্বেগের ভেতরই বছর ঘুরে এলো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা।
কিন্তু আমরা লক্ষ্য করেছি, প্রতি বছরই পূজার এই সময়টা ঘিরে নানা রকম সাম্প্রদায়িক তৎপরতার শিকার হয় বাংলাদেশ। বিভিন্ন স্থানে হামলা ভাঙচুর, এমনকি হত্যার মতো ঘটনাও ঘটে। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। পূজা শুরুর কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই বিভিন্ন স্থানে হামলা শুরু হয়েছে। যা একদিকে যেমন সনাতন ধর্মের মানুষের এই বৃহৎ উৎসবের আনন্দে শঙ্কা তৈরি করেছে, অন্যদিকে পুরো দেশেকেই লজ্জিত অপমানিত করেছে।
এইসব উদ্বেগ শঙ্কা কষ্টের ভেতরই আমরা দেখতে পেয়েছি সংখ্যালঘু নিপীড়নের রাজনৈতিক ব্যবহারের তামাশা। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় আওয়ামী লীগ সমর্থকরা ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে পোস্ট দিচ্ছেন ‘স্বাধীনতার ফল’ অর্থ্যাৎ তারা বলতে চাইছেন সরকার উৎখাতের কারণেই এমন অবস্থার সৃষ্টি। কেউ কেউ বলছেন শেখ হাসিনা সরকার না থাকায় সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে, এই হামলা ভাঙচুর হচ্ছে। সনাতন ধর্মের মানুষের উপর নির্যাতন শুরু হয়েছে। এইসব প্রপাগান্ডা দেখছি আমরা।
বাস্তবতাতো ভিন্ন। আওয়ামী লীগ শাসন আমলেও আমরা এই ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলার ব্যাপকতা দেখেছি। এইসব ঘটনায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা বিচার না হওয়ার জন্য বহুবার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু বিচারহীনতার চর্চাই হয়েছে। যদিও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একমাত্র নিরাপত্তা প্রদানকারী দল আওয়ামী লীগ। এমন একটা ন্যারেটিভ তারা প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন বহুকাল ধরে। কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে কি ধরনের হামলা নির্যাতন হয়েছে তার একটি নমুনা পাওয়া যাবে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রতিবেদনে। ২০২১ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে আসকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সাল থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আট বছর ৯ মাসে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপর ৩ হাজার ৬৭৯টি হামলা হয়েছে। যার ভেতর প্রতিমা, পূজামণ্ডপ, মন্দির ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৬৭৮টি। ১ হাজার ৫৫৯টি বাড়িঘর, ৪৪২টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়েছে। এসব হামলায় আহত হয়েছে ৮৬২ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। নিহত হয়েছে ১১ জন।
এই প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাণা দাশগুপ্ত বলেছিলেন, প্রকৃত ঘটনার চিত্র আরও বেশি। ২০২১ সালে পূজার সময় মাত্র ৩ দিনে সারাদেশে ৭০টি মন্দির, ৩০টি বাড়ি এবং ৫০টি দোকানেও ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে। এসব ঘটনায় ৭০ জনেরও বেশি আহত হয়েছে। (সূত্র:বিডি নিউজ)
২০২২ সালে দুর্গাপূজায় ৩৫টি হামলায় ৯১টি প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে বলে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে মন্দির লুট হয়েছে ৩১৯টি। বসতবাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটেছে ৮৯১টি, অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে ৫১৯টি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর হয়েছে ১৭৩টি। দখল করে নেওয়া হয়েছে ৮৯ হাজার ৯৯০ একর ৬৩ শতাংশ জমি।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত সারাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা-নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৪৫টি। যার ভেতর মন্দিরে হামলা,ভাঙচুর,লুটপাট, ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে ১৪টি। প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছে ৪০টি। ধর্ম অবমাননার কল্পিত অভিযোগে আটক হয়েছেন ৮ জন।
এমন আরও বহু ঘটনা আছে। আসকের প্রতিবেদনেও এইসব সাম্প্রদায়িক ঘটনায় রাষ্ট্র ও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারাও শেখ হাসিনা সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে দায়ী করেছিলেন।
২০২১ সালে চট্টগ্রামে এক সংবাদ সম্মেলনে রাণা দাশগুপ্ত বলেন, বিগত বছরগুলোর সাম্প্রদায়িক সহিংসতার তুলনামূলক পর্যালোচনায় দেখা যায়, সহিংসতার ঘটনার খুব বেশি হেরফের আজও হয়নি। স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চার পরিবেশ একেবারেই সংকুচিত করা হয়েছে। পুলিশি প্রহরায় ধর্মীয় অনুষ্ঠান-উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে। ( সূত্র: প্রথম আলো)
খেয়াল করুন, ২০২১ সালে তিনি বলছেন ‘পুলিশি প্রহরায় ধর্মীয় অনুষ্ঠান-উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে’ । এবার আসি ২০২৪ সালে অর্থাৎ এবারের শারদীয় দুর্গাপূজায়। শুরুতেই উল্লেখ করেছি এবারও দেশজুড়ে বিভিন্ন স্থানে হামলা ভাঙচুর শুরু হয়। ফলে মন্দিরগুলোতে নিরাপত্তারও প্রশ্ন সামনে আসে। এমনি একটি মন্দিরে সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা দেওয়ার ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়। অনেকে এই ছবি প্রচার করেও প্রপাগান্ডার রাজনীতি শুরু করেন।
এই অংশটি নানা ভাবেই প্রমাণ করতে চাইছেন শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে দেশে সাম্প্রদায়িক হামলা শুরু হয়েছে। সত্য-মিথ্যার মিশেলে নানা রকম প্রপাগান্ডা, গুজব এবং উসকানি দেওয়া হচ্ছে। আর এই পরিপ্রেক্ষিতেই আবার আরেকটি পক্ষ প্রচার করছেন এইসব হামলা আওয়ামী লীগের লোকজনই করছেন। এই পাল্টাপাল্টি দোষারপের রাজনীতির বাইরে যেই সত্যটাই পরিষ্কার তা হলো, হামলা ভাঙচুর অব্যাহত আছে এবং সেটা হচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ করার কথা যেমন আছে, তেমনি সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা ও কাজও সমাজে আছে। যার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে এই অঞ্চলে। এই সংকটকে অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু সেই সত্যকে যখন রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের প্রপাগান্ডায় ব্যবহার করা হয় তখন তা মূলত এই সংকটকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
এই অসহিষ্ণু সমাজ থেকে আমাদের বের হয়ে আসার প্রধান বাধা এই রাজনৈতিক অপতৎপরতা। এখান থেকে বের হতে হবে। অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশেও যদি সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে সেটা আমাদের সবার জন্য লজ্জার। এমনতো হওয়ার কথা ছিল না। আমরা যেই বাংলাদেশ নির্মাণের স্বপ্ন দেখছি, সেখানে বিভিন্ন ধর্ম-মত-পথ-জাতি-ভাষার মানুষের সমানভাবে বাঁচার অধিকার থাকবে। কোনো জবরদস্তি আমরা আর দেখতে চাই না। সেই পথে আগাতে যে বাধাগুলো রয়েছে একে একে আমাদের তা ভাঙতে হবে। ভাঙতে হবে আমাদের চিন্তার ব্যারিকেডগুলোও। নিপীড়িত মানুষ, জাতিগোষ্ঠী ধর্মের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে ভাবলেই অনেক কিছু সহজ হয়ে যায়।
নিপীড়নকে কি শুধু রাজনৈতিক হাতিয়ারই বানানো হবে নাকি প্রকৃত সমস্যার সমাধানে আগাবে দেশ? সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে প্রপাগান্ডার যে রাজনীতির নানা খেলা চলে তা বন্ধ করতে হবে। মনে রাখতে হবে এসব কিছুর আড়ালে- ‘কিছু একটা পুড়ছে/ প্রকাশ্যে, চোখের ওপর/ মানুষের মধ্যে/ স্বদেশ’।
লেখক: তথ্যচিত্র নির্মাতা ও এক্টিভিস্ট