‘বাকস্বাধীনতার প্রথম শহীদ’ বলে রং হেডেড ম্যাজিস্ট্রেট তাপসী তাবাসসুম ঊর্মির নাম উল্লেখ করেছেন এক সোকল্ড অ্যাকটিভিস্ট। ‘সোকল্ড’ লিখলাম এ কারণে যে, ডিজিটাল মার্কা ‘টাল’ সিকিউরিটি অ্যাক্টে মানুষজনকে ধরে নিয়ে, জেলে ভরে, আয়নাঘরে রেখে জুলুমের বিষয়ে তার সারা প্রোফাইল ঘেটে কোনো লেখা পাইনি। পাইনি খসড়া হিসেবে ষোল’শ মানুষের শহীদানের বিষয়ে কোনো লেখা। হ্যাঁ, পেয়েছি তোফাজ্জলের মৃত্যু নিয়ে তার শোকগাথা, এই একটা মৃত্যুই তাকে ব্যথিত করেছে। এক ঊর্মি তাকে উত্তেজিত করেছে। এছাড়া বাকস্বাধীনতা বিষয়ে তিনি ছিলেন বাকহারা। বাকপ্রতিবন্ধী। এমন অনেকেই রয়েছেন। কেউ কথা বলছেন, কেউ এখনো ‘ছুপা রুস্তম’।
বলতে পারেন, কেন সামাজিকমাধ্যমের বক্তব্য নিয়ে শুরু করলাম। সামাজিকমাধ্যমকে এখন আর ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। মেইনস্ট্রিম গণমাধ্যমগুলো এখনো তাদের চরিত্র ফিরে পায়নি। অ্যাকটিভিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী দিলশানা পারুল, পূজাকে ঘিরে ঘরের শত্রু বিভীষণদের কথা বলে সরকারকে সাবধান করে দিয়েছেন। কোনো কোনো গোয়েন্দা সংস্থার কিছু লোকজন মানুষের দেয়া টাকায় বেতন নিয়ে, মানুষকেই বিপদে ফেলার চেষ্টা করছে এমন কথাই বলেছেন দিলশানা পারুল। মেইনস্ট্রিম গণমাধ্যমগুলোর এসব বিষয়ে কোনো আলাপ নেই, রিপোর্ট নেই, অনুসন্ধান নেই। অথচ থাকা উচিত ছিল। বর্তমানে সামাজিকমাধ্যম যে শক্তি ধরে সে শক্তি গণমাধ্যমের নেই, সে কারণেই সামাজিকমাধ্যমের বক্তব্যকে সামনে আনা।
একজন চাকরিজীবীর বাকস্বাধীনতা ততক্ষণ পর্যন্তই শোভন, যতক্ষণ পর্যন্ত তা মানুষকে বিভাজিত না করে। মানুষকে এক করার পরিবর্তে বিভাজিত করার দায়িত্ব কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে দেয়া হয়নি। যারা এই বাকস্বাধীনতার কথা বলেন তাদের বলি, মাঝে এক সরকারি চাকরিজীবী হিজাব বাধ্যতামূলক করা দরকার এমন কথা বলেছিলেন। ইসলামের বিপক্ষে যায় পাঠ্যপুস্তকে এমন কিছু লেখা রয়েছে বলে এর প্রতিবাদ করে চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন শিক্ষক আসিফ মাহতাব। তখন কিন্তু তাদের বাকস্বাধীনতাকে ভিন্নভাবে দেখা হয়েছিল। তখন সেই বাকস্বাধীনতা হয়ে গিয়েছিল ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বিরোধী। সুতরাং যারা ঊর্মির ক্ষেত্রে বাকস্বাধীনতা বিষয়টিকে টেনে আনেন, তারা ভেবে দেখবেন এই টানাটানি আপনার নিজের ধুতি নিয়ে টান দিবে কিনা।
তাপসী তাবাসসুম ঊর্মির কথায় আসি। অনেকে বলেন, তিনি অ্যাসাইলাম শিকার। দেশের বাইরে নিজের ক্যারিয়ার গড়ার জন্য একাজ করেছেন। ঊর্মির বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন তার মা এমন খবরও চাউর করেছে কোনো কোনো গণমাধ্যম। কিন্তু সেই খবরে, তার মায়ের বক্তব্যের একটা অংশ ছিল, ইতিহাস অস্বীকার করা যায় না। এই এক কথাতেই তিনি প্রকারান্তরে ঊর্মির বক্তব্যকেই জাস্টিফাই করেছেন। বিরোধীতার নামে যে সমর্থন করা যায়, এটা তারই কৌশলী প্রমাণ। তার মার বক্তব্যের মূল স্পিরিটটা ছিল সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে ঊর্মির বক্তব্য ঠিক হয়নি, কিন্তু বক্তব্যটি ভুল নয়।
আমি কদিন আগেই একটা লেখাতে ‘স্লিপার সেল’ এর কথা বলেছিলাম। যারা এসপিওনাজ সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন তারা বুঝবেন ‘স্লিপার সেল’ হলো গোয়েন্দা কার্যক্রমের শেষ অস্ত্র। একে অনেকটা আইএসএর আত্মঘাতীদের সাথে তুলনা করা যায়। এদেরকে মোটিভেট করা হয়। মাথায় ভরে দেয়া হয় আত্মোৎসর্গের কল্পিত মহত্ত্ব। অনেকটাই সম্মোহনের মতন। ফলে ‘স্লিপার সেল’ এর সদস্যরা বলা যায় সম্মোহিত অবস্থায় থাকেন। তাদের লজিক নষ্ট হয়ে যায়। তারা ভালোমন্দের তুলনা করতে ভুলে যান। তাদের মাথায় যে কথা ঢুকিয়ে দেয়া হয় তাকেই সত্য বলে মানেন এবং শেষ সময়ে পাওয়া নির্দেশ অনুযায়ীই কাজ করেন।
সম্ভবত ঊর্মিরা সেই ‘স্লিপার সেল’ এরই অংশ। লক্ষ্য করে দেখুন, ঊর্মি নিশ্চিত জানে, এতে তাকে চাকরি হারাতে হবে এবং জেলেও যেতে হতে পারে। হতে পারে মানুষের বিক্ষোভের সম্মুখীন। সেই বিক্ষোভ সহিংসও হতে পারে। এমন হলে তার পক্ষে বিদেশে গিয়ে অ্যাসাইলাম প্রার্থনা খুব সহজ হবে না। এককথায় অসম্ভবও বলা যায়। এগুলো জেনেও তিনি একথা বলেছেন। সুতরাং বিষয়টাকে অ্যাসাইলাম সিকিংয়ের মতন সহজ বিষয়ের সাথে গুলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না। ঘটনা কিন্তু এক ঊর্মিতেই থেমে থাকেনি। ৬ অক্টোবর ড. ইউনূসের ফাঁসি নিশ্চিত এমন আগাম ‘ভবিষ্যদ্বাণী’ করে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন, ঝালকাঠি সদর উপজেলার গোপনীয় সহকারী শেখ মনিরুজ্জামান।
এমন ‘গোপন সহকারী’রা সবজায়গাতেই আছেন এবং গোপনীয়তা রক্ষার আড়ালে গোপনীয়তা ফাঁস করে সরকারকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করছেন। গণমাধ্যম সে কারণেই খবর করেছে, ‘আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতাই ভারতে কিংবা দূরদেশে’ এমন বিষয়ে। এদের জন্যই তারা আজ ভারতে কিংবা দূরদেশে। তাপসী তাবাসসুম ঊর্মি এবং শেখ মনিরুজ্জামানের মতন লোক প্রশাসনের উঁচু থেকে নীচু সব জায়গাতেই আছেন। এই দুজন চুনোপুঁটিকে সমুখে আনা হয়েছে ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে। যেমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিষ্টি সুবাস বলে অদ্ভুত নামের এক কথিত মডেলকে দিয়ে জন্মদিন পালনের চেষ্টা করা হয়েছিল। পথশিশুরা যে প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে। অথচ সেই মডেল বলেছেন, শিবিরের নেতারা তার উপর হামলা করেছিলো। ভিডিও ফুটেজ না থাকলে সত্যিকার অর্থেই পথশিশুদের শিবির বানিয়ে দেয়া হতো। যেমন তোফাজ্জলের মৃত্যুর জন্য দায়ীরা ছাত্রলীগের হলেও, দোষ দেয়া হচ্ছে সরকারকেই। এই চুনোপুঁটিরা সফল হলে, রাঘব-বোয়ালরা সামনে চলে আসবে। গত কদিনের গুজব সেই সম্ভাবনার কথাই জানান দিচ্ছে।
তাপসী তাবাসসুম ঊর্মি ‘রিসেট বাটন’ এর কথা বলেছেন। এই ‘রিসেট বাটন’ বিষয়টিকে অবিশ্বাস্যভাবে হাইলাইট করছে কোনো কোনো গণমাধ্যম। হাইলাইটের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রয়েছে বিবিসি। অথচ ‘রিসেট’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ নিয়ে কথা না বলে মনগড়া অর্থ ও ব্যাখ্যাকেই সামনে আনছে গণমাধ্যমগুলো। রিসেট শব্দটির সঠিক আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ‘পুনরায় যথাস্থানে রাখা’ বা ‘পুনঃস্থাপন করা’। আমরা যারা কম্পিউটার ব্যবহার করি, তারাও জানি মূলত রিসেট হচ্ছে, প্রোগ্রামটাকে পুনরায় গুছিয়ে নেয়ার বিষয়। বলতে পারেন, রিসেট করলে তো সব ডাটা মুছে যায়, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও মুছে যাবে। তাদের বলি, ৫২, ৬৯, ৭১, ৯০, ২০২৪ এসব মূল প্রোগ্রামের অংশ হয়ে গিয়েছে। রিসেট হলো সেই মূল প্রোগ্রামে কোনো উল্টোপাল্টা হলে তা গুছিয়ে দেয়া। আমরা যে ভুল ডাটা সংগ্রহ করেছি, যে স্ক্র্যাপ ও গার্বেজ রয়েছে তা মুছে ফেলে মূল প্রোগ্রামে ফিরে যাওয়া। শুদ্ধভাবে স্টার্ট করা।
ভুল তথ্য কোনো কাজের বিষয় নয়। কাজেও দেয় না। জেনারেশন জেড বড় হয়েছে নানা আজগুবি কাহিনি শুনে। তাদের পাঠ্যবইয়ের ঠেসে দেয়া হয়েছিলো নানা গাঁজাখুরি গপ্প। প্রতি বইমেলায় গাঁজাখুরি গপ্পের একগাদা বই বের হতো। কিন্তু সেসব গপ্প কি জেনারেশন জেড বিশ্বাস করেছিলো? করেনি। তারা ঠিকই সঠিক ইতিহাস খুঁজে বের করে পড়েছে। কারণ তাদের সম্মোহন করা সম্ভব হয়নি। একটা বিশাল জনগোষ্ঠীকে বোকা বানানো যায় স্বল্প সময়ের জন্য কিন্তু তাদের গাঁজাখুরি আলাপে টিউনড তথা সম্মোহিত করা যায় না। জেনারেশন জেডকেও করা যায়নি। যার ফলেই ‘রিসেট বাটন’ হিসেবে ২০২৪ এর জুলাই বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। এসেছে আগস্ট ভিক্টোরি। এই সত্যকে অস্বীকার করার মতন বড় বোকামি আর নেই।
ফুটনোট : আমার এক ছোটভাই, যে খুবই একটা দায়িত্বশীল জায়গায় কর্মরত রয়েছেন। তিনি তরুণ ঘোষ নামে এক ভারতীয় বাঙালি ভদ্রলোকের ইউটিউবিয় বয়ান পাঠিয়েছেন আমাকে শোনার জন্য। ভারতীয় বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের বয়ান শুনতে গেলে হাসি ধরে রাখা অনেকটাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। যেমন, রিপাবলিক বাংলা টিভি’র ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ নামে এক জোকার রয়েছেন। তার ধারণা পশ্চিমবঙ্গে ইলিশ বেচতে না পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ধসে যাবে। এই রামপাঠাকে কী বলবেন, কী দিয়ে বোঝাবেন, ‘অর্থনীতি জিনিসটাই তুই বুঝিস নারে গবেট’। তরুণ ঘোষও তেমনি একজন, স্রেফ গবেট। এই গবেট কথা বলেছেন তাপসী তাবাসসুম ঊর্মির পক্ষ নিয়ে। এদের নিয়ে কথা বলতে গেলে নিজেদেরই বিবমিষা হয় ‘জাফর স্যার’ এর মতন। তারপরও বলি, এদের কথাতেই ‘স্লিপার সেল’ যে পরাজিতদের জয়ের শেষ চেষ্টা এবং সেই ‘স্লিপার সেল’ এর ডিস্ট্রিবিউটার কারা সেসম্পর্কে ধারণা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে যায়।