অজনপ্রিয় সরকার ও ইউটোপিয়ান বুদ্ধিজীবী এবং ফ্যাসিজমের উত্থানের চেষ্টা
ফাইল ছবি
যারা একবার ইউটোপিয়ায় বাস করা শুরু করে তাদের বোধহয় ইউটোপিয়া থেকে বের হবার কোনো রাস্তা থাকে না। এই ইউটোপিয়ানগণ এবার হিসাব কষা শুরু করেছেন ড. ইউনূসের সরকার কেন অজনপ্রিয় হচ্ছে সে বিষয়ে। জনপ্রিয়তার ধারণাটা কী ফেসবুকে কিছু কথিত বুদ্ধিজীবীর হা-হুতাশ! কিছু কবি-লেখকের আর্তনাদ! ওবায়দুল কাদেরের ভাষায় বলতে হয়, ‘এরা কারা’।
এই ‘এরা কারা’দের চিনতে হলে গত ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট তাদের সামাজিকমাধ্যমের পোস্ট দেখতে হবে। দেখবেন, তাদের ৭০ শতাংশই সে সময়ের স্ট্যাটাস ডিলিট করা, না হয় ফুল-পাখি-লতা-পাতা নিয়ে আলাপ। আর যে ত্রিশ শতাংশ রয়েছেন, তারা হলেন ‘আওয়ামী ট্যাবু’র অনুসারী। সফ্ট চেতনাপন্থী আর কী। যে চেতনা এতদিন মানুষকে বিভক্ত রেখে দেশকে একপাল লুটেরার হাতে ছেড়ে দিয়েছিল। এই চেতনার কথা বলেই ব্যাংক থেকে দুই লক্ষ কোটি টাকা হাপিশ হয়ে গেছে। ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। প্রতিটা ক্ষেত্রে পাহাড়সম দুর্নীতি দৃশ্যমান হচ্ছে। এতদিন যা গুজব বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। কারো কাজের লোকের ৪০০ কোটি টাকা, কারো কাজের বেটির ১০০ কোটি টাকার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ তারা এতই লুটেরা ছিল যে, তাদের বাড়ির কাজের লোককেও ঘুষ দিতে হয়েছে।
মানুষ এসব এখন জানে। তারা জানে দেশটার কী অবস্থা করে রেখে গিয়েছিল ফ্যাসিস্ট রেজিম। তাই তাদের প্রত্যাশা বেশি এই সরকারের কাছে। মানুষের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। তাই তারা দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে চাচ্ছে। কিন্তু তাদের চাওয়ার সাথে সরকারের কাজের গতি ঠিকঠাক মিলছে না। মিলছে না ফ্যাসিস্ট রেজিমের রোপিত বিষবৃক্ষের কারণে। প্রধান যারা ছিলেন তারা না হয় পালিয়েছেন, কিন্তু প্রশাসন থেকে সব জায়গায় তাদের লোকজন রয়ে গেছে। তাদের কারণেই সরকারের কাজে গতি আসছে না। তাদের কারণেই অনেক লুটেরা পালিয়ে গেছে দেশ ছেড়ে।
বিজিবি প্রধান যেমন বলেছেন, তারা কীভাবে পালিয়েছে তা বিজিবির জানা নেই। কারা তাদের পালাতে সাহায্য করছে, তা তিনি জানার চেষ্টা করছেন। তিনি অবশ্য সাথে প্রশ্নও তুলেছেন, এরজন্য শুধু বিজিবি দায়ী কিনা। অবশ্যই না। একটা অংশের দোষ দিয়ে লাভ নেই। ফ্যাসিস্ট শাসনকে রেজিম বলা হয়েছে সে কারণেই। একটা রেজিম মানে সবখানেই ফ্যাসিজমের দোসররা রয়েছে। তারাই লুটেরাদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছে।
যে ইউটোপিয়ানরা বর্তমান সরকারকে অজনপ্রিয় বলছেন, তাদের জ্ঞাতার্থে বলি, দেশের ৯৭ শতাংশ মানুষ এই সরকারের প্রতি আস্থাশীল। এটা বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (এনএসইউ) সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্নেন্স (এসআইপিজি) পরিচালিত অতিসাম্প্রতিক একটি জরিপের ফলাফল। না, এটা বিবিসির মরিয়ম সুলতানার করা রিসেট বাটন বিষয়ক গায়েবি রিপোর্ট নয়। যে রিপোর্ট শুধুমাত্র সামাজিকমাধ্যমের কিছু মানুষের স্ট্যাটাস ও কমেন্টের ভিত্তিতে করা। মেহের আফরোজ শাওন কিংবা তসলিমা নাসরিনের মতন অজনপ্রিয় মানুষের স্ট্যাটাসকে সামনে রেখে এমন একটা রিপোর্ট অসম্ভব রকম হাস্যকর। জুলাই বিপ্লব ও আগস্ট ভিক্টোরিতে মেহের আফরোজ শাওনের অবস্থান কী ছিল, সেটা বিবেচনায় আনেনি বিবিসি। তসলিমা নাসরিনের স্প্লিট পার্সোনালিটি, একেক সময় একেক কথা বলার ধারাবাহিকতার কথাও ভাবেনি বিবিসির সেই রিপোর্টার। যে তসলিমা নাসরিন জুলাই বিপ্লবের পক্ষে কথা বলেছেন প্রথম দিকে, তারপর শেষের দিকে এসেই আবার স্বভাবগত পল্টি দিয়েছেন। সুতরাং এ দুজনকে যখন সামনে আনা হয়েছে, তখনই রিপোর্টটির উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। সুতরাং, বিবিসিকে এ ধরণের রিপোর্ট করার আগে চিন্তা করতে হবে। তাদের ভাবতে হবে, এখন আর ফ্যাসিজমের যুগ নয় যে, কেউ তাদের করা রিপোর্টের পোস্টমর্টেম করতে পারবে না।
ইউটোপিয়ানরা উৎসাহিত হচ্ছেন ফেসবুক আর এক্স হ্যান্ডেলে ফ্যাসিজমের সরব উপস্থিতি দেখে। সেই উৎসাহের যজ্ঞে ঘি ঢেলেছে বিবিসি। ইউটোপিয়ায় বাস করতে গিয়ে তারা ভুলে গেছেন জেনারেশন জেড এর স্বভাবের কথা। তারা তাদের কাজ আপাত শেষ হয়েছে জেনেই ফিরে গেছে নিজের জগতে। ক্লাশে এবং স্মার্টফোন কিংবা ল্যাপটপের মনিটরে। তারা চিনে এসব ইউটোপিয়ানদের, তারা জানে, এদের দৌড়।
জেনারেশন জেড প্রয়োজনে সামাজিকমাধ্যমে ফিরলে, তখন পালিয়েও কুল পাবেন না ইউটোপিয়ানরা। খেয়াল করলে দেখবেন, যারা এখন সামাজিকমাধ্যমে সোচ্চার তাদের বেশিরভাগেরই বয়স মেহের আফরোজ শাওন আর তসলিমা নাসরিনদের মতন। আগেই বলেছি এদের মধ্যে রয়েছেন সফ্টকোর চেতনবাদী বুদ্ধিজীবী এবং সাথে কিছু কবি ও লেখক। এদের কথায় কোনো সরকার অজনপ্রিয় হয় না, জনপ্রিয়ও হয় না। বিগত ফ্যাসিস্ট শাসকই তার প্রমাণ। সেই শাসকের পক্ষে শাওনদের ভোকাল বধির মানুষের কানেও পৌঁছেছিল, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়েছিল কি?
এদের আলাপ আপাতত থাক। যে বিষয়টি এখন শঙ্কার তা নিয়ে কথা বলি। বিগত ফ্যাসিস্ট রেজিমের সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল সোকল্ড জঙ্গিবাদ। তারা জঙ্গি জুজুর ভয় দেখিয়ে পশ্চিমাদের বিভ্রান্ত করেছিল। ফ্যাসিস্ট রেজিম ধারণা দিয়েছিল, তারা না থাকলে সারাদেশে সাম্প্রদায়িক হানাহানি শুরু হবে আর ইসলামী এক্সট্রিমিস্টরা ক্ষমতা নিয়ে নেবে এবং বাংলাদেশ আরেকটি আফগানিতস্তানে পরিণত হবে। এটা যে কতবড় মিথ্যা তা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামীর ভোটের সংখ্যা দেখলেই বুঝতে পারা যায়।
জামায়াতের ভোটের গড় সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ। বাংলাদেশে ইসলামী জলসা ও সভাগুলোতে প্রচুর মানুষ যায়। তারা যায় কোরআন, হাদিসের কথা শুনতে। কিন্তু রাজনীতি তাদের কাছে ধর্ম থেকে আলাদা। এ দেশের মানুষ ভোট দিতে গেলে বেছে নেয় সেই বিএনপি, আওয়ামী লীগকেই। সুতরাং বাংলাদেশ কখনোই মৌলবাদীদের খপ্পরে পড়বে না। এখন অবশ্য আওয়ামী লীগের সে অবস্থা নেই। তাই সে শূন্যস্থান পূরণ করতে নতুন একটা দল হতেই পারে। যার লক্ষণও দেখা যাচ্ছে। শক্ত বিরোধীপক্ষ গণতন্ত্রের জন্য সহায়ক।
প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে ড. ইউনূসের শাসনের দুই মাস যেতে না যেতেই আইসিসের মতো কালো রঙের কলেমাখচিত পতাকা দেখছি কেন? বলি, দেখছেন এই কারণে যে, আপনাদের দেখানো প্রয়োজন মনে করছে কেউ। এই কেউ’রা কারা। এর উত্তর পেতে হলে আপনাদের একটু কৌতুহলী হতে হবে। অঙ্ক কষতে হবে, এই কালো পতাকা প্রদর্শনে লাভ হচ্ছে কার।
ড. ইউনূসের, বিএনপির, জামায়াতের? না, তাদের বরং ক্ষতি হচ্ছে, সেই ক্ষতির কারণেই আপনারা প্রশ্ন ও আঙুল তুলতে পারছেন। তাহলে লাভটা হচ্ছে কার? এই প্রশ্নের উত্তরেই রয়েছে আসল রহস্য। লাভ হচ্ছে মেহের আফরোজ শাওনদের। যার পিতা-মাতা দুজনেই আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন। তারা এই কালো পতাকার জন্য প্রশ্ন ও আঙুল দুটোই তুলতে পারছেন। হিন্দুদের পূজায় গণ্ডগোল হলে লাভ কার, সাম্প্রদায়িক দাঙা হলে লাভ কার? উত্তর একটাই পতিত ফ্যাসিজমের এবং ভারতের। বলবেন তো ভারতের কীভাবে, সেটারও উত্তর দিয়ে দিই। বাংলাদেশে ফ্যাসিজমের পতন ভারতের কূটনীতির ক্ষেত্রে একটা বড় বিপর্যয়। মহাবিপর্যয়ও বলতে পারেন। ফ্যাসিজম বিরোধীদের বরাবরের অভিযোগ ছিল, ফ্যাসিস্ট রেজিমকে শক্তি সাহস জুগিয়েছে ভারত। যার ফলেই জুলাই বিপ্লবে স্লোগান উঠেছিল, ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’। এখন ভারতের ইজ্জত বাঁচানোর সময়। খুলে যাওয়া ধুতি পরিধানের চেষ্টায় ভারত এখন দেখাতে চেষ্টা করবে পশ্চিমাদের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রকে। তারা বলার চেষ্টা করবে, ‘বলেছিলাম না, আমাদের লোক বিতারিত হলে, ইসলামিস্টরা ক্ষমতায় বসবে, দেশটা আফগানিস্তান হয়ে উঠবে, তার লক্ষণ দেখতে পাচ্ছেন তো।’ এ কথা বলার জন্যই এই কালো পতাকা, সাম্প্রদায়িকতা দৃশ্যমান হচ্ছে। এর বাইরে আর কোনো কারণ নেই, থাকার কথা নয়।
ইউটোপিয়ায় যারা বাস করেন তাদের পুনর্বার বলি, যাদের কথায় আপনারা মনে করছেন সরকার অজনপ্রিয় হয়ে গেছে, তারা ইউটোপিয়া থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করুন। চোখটা খুলুন, দেখবেন, আপনার দেখা দৃশ্যটা স্বপ্নদৃশ্য। বলতে পারেন, রাজনৈতিক দলগুলোও তো সরকারের নানান কাজের প্রতিবাদ করছে। এখানেও বলি, গত দেড় দশকের বেশি তো টিউনড ছিলেন ভালোচনায়। সমালোচনা বলতে যে একটা বিষয় রয়েছে তা ভুলেই গিয়েছিলেন আপনারা। সমালোচনা মানে সরকারের বিরোধীতা নয়, কাজের বিরোধীতা। ভুল করলে, তা ভুল বলে জানান দেয়া, যাতে তারা শুধরে নিতে পারেন। কোনো রাজনৈতিক দল কি বলেছে ড. ইউনূসের পদত্যাগ চাই? বলেনি তো। তাহলে? আপনারা যে ‘স্টেপডাউন ইউনূস’ হ্যাশট্যাগ দেখছেন, তা মূলত স্বপ্নদৃশ্য, বিগত ফ্যাসিস্ট রেজিম যেভাবে উন্নয়নের স্বপ্নদৃশ্য দেখিয়েছিল মানুষকে, বিশ্বকে।