অবিশ্বাস আর ঘৃণার বিস্তার যতো পাহাড় আর সমতলের দূরত্ব ততো
পাহাড়ের একটি চিত্র। ছবি: লেখক
১.
লেখার শুরুতে একটি সিনেমার কথা বলি। ভারতের নর্থ-ইস্টের রাজনীতি এবং সেখানকার আদিবাসীদের সংগ্রাম নিয়ে নির্মিত সিনেমা ‘Anek’ এর শুরুটা ছিলো এরকম- জাতিসত্তার অধিকার আদায়ের প্রশ্নে স্বশস্ত্র সংগ্রামে থাকা একটি সংগঠনের শীর্ষ গেরিলা নেতা টাইগার সাঙ্গা সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন এক সাংবাদিককে। তাদের কথোপকথনের একটি অংশ ছিলো এরকম-
‘সাংবাদিক: এতো বছরেও সংঘাত শেষ হলো না সমস্যাটা কোথায়? উত্তরে গেরিলা নেতা টাইগার সাঙ্গা বলেন- আপনাদের সরকার ও আপনাদের জনতা (ইনডিয়ান সরকার), তারা কেউ বৈচিত্র্যকে গ্রহণ করার মতো মানসিকতা পোষন করে না। তখন পাল্টা মতামত দিয়ে সাংবাদিক বলেন, কিন্তু আমি যদি বলি পৃথিবীর সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় ও গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে - ভারত উদযাপন করছে...।
তখন গেরিলা নেতা বলেন, সেই সেলিব্রেশনের নমুনা কি আমাদের দেখলে চিংকি/চিঙ্কু, চিকেন নামে ডাকা? কাশ্মীরীদের পাকিস্তানি, খালিস্তানি বলা? মানুষের আঞ্চলিক পরিচয়কে তোমরা গ্রহণ করতে পারো না...।’
সিনেমার সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত আলাপে না গিয়ে এখানেই থামিয়ে, আমরা বাংলাদেশের বাস্তবতাকে দেখি। গত ৪ অক্টোবর এক বাঙালি যুবকের দেওয়া একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস হুবহু তুলে দিচ্ছি- ‘পাহাড়ি উপজাতিদের স্লোগান‘... থুমি খে? হামি খে? ব্যাং বুং ! চ্যাং চু ।’
কেমন সিনেমার মতো লাগে না? ওই যে সিনেমায় যে গেরিলা নেতা অভিযোগ করে বলেছিলেন তাদের চেহারার গঠনের কারণে তাদের চিঙ্কু চ্যাং চুং নামে ডাকা হয়...। ঠিক একইভাবে চেহারা ভাষা সংস্কৃতির ভিন্নতার কারণে আমাদের পাহাড়ের মানুষদেরও এমন নানা রকম বিদ্বেষী কথা বার্তা শুনতে হয়। গত দুই দিন ‘চ্যাং চুং চ্যাং’ এই শব্দগুলো পুরো অনলাইন জুড়ে ভাইরাল। এক আদিবাসী নারী শিক্ষার্থীকে রাস্তায় এই ধরনের শব্দ ব্যবহার করে হয়রানি করা হয়েছে। সেই শিক্ষার্থী একটি টেলিভিশনে সাক্ষাৎকারে সেই অভিযোগ দিয়েছেন। সেই ভিডিওটি নিয়েও ট্রল হয়েছে। এই উপহাস মজা ট্রল করছেন সমতলের পাহাড় না বোঝা বা অনুভব করতে ব্যর্থ বাঙালিদের একটি অংশ।
এই যে অন্য জাতির মাতৃভাষা নিয়ে বুলিং করছে এমন একটি জাতির মানুষ যারা মাতৃভাষার মর্যাদার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন, সেই সমাজেরই অংশ তারা। কেউ যখন অন্য জাতিসত্তা নিয়ে উপহাস করে, ভাষা নিয়ে বুলিং করে তাতে মূলত সেই ভাষা সংগ্রামকেই খাটো করা হয়। সেই জাতিকে লজ্জিত করা হয়।
অথচ এইরকম অসংখ্য জাতি বিদ্বেষপূর্ণ লেখা-কনটেন্ট ঘুরে বেড়াচ্ছে অনলাইনে। সেই লেখা যেসব আদিবাসী-পাহাড়ি তরুণ-তরুণীরা দেখছেন, শিক্ষার্থীরা দেখছেন স্বভাবতই তাদের ভেতরও একটা মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। কেউ কেউ নিরবে ঘৃণা পুষে রাখেন মনে। আবার কেউ পাল্টা জবাব দেন । সেই জবাব আবার অনেক বাঙালির ভালো লাগবে না। ফলে স্বভাবতই বাড়তে থাকে এইসব ঘৃণার চাষবাস।
২.
সম্প্রতি পাহাড়ি আদিবাসী শিক্ষার্থীদের ৮ দফার আন্দোলনকে ঘিরে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়েছে। সংঘাত ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ব্যানারে শিক্ষার্থীদের শুরু হওয়া এই আন্দোলনকে ঘিরে এক পর্যায়ে পাহাড়ি-বাঙালি জাতিগত সংঘাত শুরু হয় ওই অঞ্চলে। এই সংঘাতের শুরুও হয় গুজব থেকে। মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে খাগড়াছড়িতে মামুন নামের এক যুবককে গণধোলাই দেওয়া হয়। পরবর্তীতে খবর ছড়িয়ে পড়ে পাহাড়িরা বাঙালি যুবককে পিটিয়ে হত্যা করেছে। এ নিয়েই শুরু হয় সংঘাত, হামলা, ভাঙচুর এবং শেষ পর্যন্ত কয়েকজনের প্রাণ যায় এই সংঘাতে। যদিও পরে জানা যায় সেই যুবক মারা গিয়েছিলো মোটরসাইকেল চুরি করে পালানোর সময় দুর্ঘটনায়। অন্যদিকে তার স্ত্রী এটা ব্যবসায়িক বিরোধের জের হিসেবে হত্যা মামলা দায়ের করেন। যার প্রধান আসামির তালিকায় রয়েছে কয়েকজন বাঙালি।
ঠিক একইভাবে অনলাইনেও মিথ্যা প্রপাগান্ডা মারাত্মকভাবে ভাইরাল হয়। আমরা দেখতে পেয়েছি আসাম পুলিশের স্পেশাল ফোর্সের কমান্ডো ট্রেনিংয়ের ভিডিও। জঙ্গল ট্রেনিংয়ের অংশ হিসেবে কমান্ডোরা বনের ভেতর দিয়ে অস্ত্র নিয়ে যাচ্ছে। তাদেরই একজন সাম্বর রঙপি যিনি তাদের এই ভিডিওটি তার ফেসবুক ওয়ালে আপলোড করেন গত ১৭ জুলাই। পরে সেই ভিডিওটি বাংলাদেশের অনেকে ছড়িয়ে দিয়ে বলছে এরা পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাসী। কেউ বলছে সাম্প্রতিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে সশস্ত্র হামলার পরিকল্পনা। ইউটিউবেও এই ভিডিও বেইজ করে ‘ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা’ বলে ভ্লগ বানানো হয়েছে।
একই কায়দায় ইন্দোনেশিয়ার তরুণ কনটেন্ট ক্রিয়েটর সাত্তার জাক্কাল ও তার এক বন্ধুর ডামি অস্ত্র নিয়ে রাস্তায় ঘোরাফেরার একটি কনটেন্টকে বাংলাদেশের অনেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বলে প্রচার করে দিলো। এমন আরো অনেক কনটেন্ট আমরা দেখেছি। এই সব ভিডিও ছড়িয়ে দিয়ে বলা হচ্ছে জুম্মুল্যান্ড তৈরির প্রস্তুতি চলছে। এই আন্দোলন সেই জুম্মুল্যান্ডের আন্দোলন। আমরা দেখলাম অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়া হলো, জুম্মুল্যান্ডের মুদ্রা, ম্যাপ, পতাকা। অথচ যারা আন্দোলন করছেন তারা বলছেন ঠিক উল্টা কথা। তারা কোথাও জুম্মুল্যান্ডের দাবি তোলেননি। দেশ বিচ্ছিন্নতার কথা বলেননি। তারা বলছেন আমরা এই দেশের মানুষ । আমরা বাংলাদেশি।
কিন্তু সাম্প্রদায়িক কনটেন্ট ক্রিয়েটররা, বিষবাষ্প ছড়ানো মানুষগুলো বলছে ওরা জুম্মুল্যান্ডই চাইছে। কেউ আবার বলছেন, এই দেশে থাকতে হলে বাঙালি হয়ে থাকতে হবে। কেউ জোর করেই জুম্মুল্যান্ড চাপিয়ে দিচ্ছেন আন্দোলনরত পাহাড়িদের কাঁধে। ফেসবুকে নানা বিদ্বেষী কনটেন্ট দিয়ে উত্তেজিত করে তুলছেন। ফলে জাতিগত সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প আরো ছড়িয়ে পড়ছে। অন্যদিকে তাদের এই সাম্প্রদায়িক উসকানিতে পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে।
এর নিকটতম উদাহরণ হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের সম্প্রতি জনপ্রিয় হওয়া একজন কনটেন্ট ক্রিয়েটর। তিনি পাহাড় নিয়ে প্রচুর বিদ্বেষমূলক কথা বার্তা ছড়ান। আর তার পোস্টের নিচে হাজার হাজার কমেন্ট পড়ে সেই বিদ্বেষ সুর মিলিয়ে নানা সাম্প্রদায়িক আলাপে।
৩.
এখন প্রশ্ন হচ্ছে যুগযুগ ধরে এই বিদ্বেষী অবস্থার পরিবর্তন কেন হচ্ছে না? মানুষের ভেতর পারস্পারিক মেলবন্ধন তৈরি হওয়ার বদলে এখনো জাতিগত ভিন্নতা, ভাষাগত ভিন্নতার কারণে একজন শিক্ষার্থীকে বুলিংয়ের শিকার হতে হচ্ছে। জাতিগত সাম্প্রদায়িকতার এই প্রতিচ্ছবি আমরা যতই আড়াল করার চেষ্টা করি বড় বড় সম্প্রীতির বিলবোর্ড ঝুলিয়ে, কিন্তু বাস্তবতা তো বদলাবে না। আমি অনেক তরুণ বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করে দেখেছি, পাহাড় নিয়ে সমতলের অধিকাংশ মানুষেরই স্পষ্ট ধারণা নেই। নানা রকম ভাসা ভাসা ধারণা, ধোঁয়াশা ধারণা থেকে এক ধরনের ভুল প্রতিচ্ছবি তৈরি হচ্ছে। আরো স্পষ্টভাবে বলতে গেলে পাহাড় সম্পর্কে আলাপ আমাদের এখানে পৌঁছায় না। এমনকি সব নিউজও পৌঁছায় না, প্রকাশ হয় না। যার ফলে নানা রকম কনস্পেরেসি থিউরি বাড়ছে। ধোঁয়াশা বাড়ছে। একই সাথে বাড়ছে ভুল ধারণা, ভুল আলাপ, ভুলের পক্ষে জনমত তৈরির কাজ। আর এসব কিছুই পাহাড়কেও ভুল পথ তৈরির মন্ত্রণা জোগাবে।
দমনপীড়ন বলপ্রোয়োগ, এর কোনটা দিয়েই পাহাড়ের সমস্যার সমাধান হবে না। যত বলপ্রয়োগ করা হবে, শক্তি প্রদর্শন করা হবে এই সমস্যা ততো বাড়বে, রাষ্ট্রের প্রতি ক্ষোভ আরও বাড়বে, দূরত্ব তৈরি হবে। আর এসবেরই সুযোগ নেবে সুযোগ সন্ধানীরা। উসকানি দেবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, উসকানি আগুন সেখানেই দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে, যেখানে ক্ষোভের বারুদ বিরাজ করে।
পাহাড়ি বাঙালির যে দূরত্ব রয়েছে তা দূর করার প্রধানতম প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রের, আর আত্মিক দায়িত্ব হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠের জাতির মানুষের। সংঘাতের ভাষা, ঘৃণার ভাষা, দখলদারিত্বের ভাষা তাকে পরিত্যাগ করতে হবে। তাকে বারবার ভালোবাসার বার্তা নিয়ে যেতে হবে। আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা তৈরি করতে হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠর ক্ষমতা আর অহংকারের মনস্তত্ত্ব পরিবর্তন করতে হবে। সাংস্কৃতিক ভাবে এই পরিবর্তনের চর্চা তখনই শুরু হবে যখন রাষ্ট্র নিজেও আন্তরিকভাবে এর সমাধান চাইবে। বিনয় ভালোবাসার কোনো বিকল্প নাই। পাহাড়ে শান্তি ফেরানোর সব পলিসি ফেইল হবে যদি সেই সব পলিসির সঙ্গে বিনয় ভালোবাসা ও উদারতা যুক্ত না হয়।
কিন্তু রাষ্ট্র কি আদৌ সেই বিষয়টি অনুধাবন করতে পারছে? এই প্রশ্ন রেখে লেখাটি শেষ করছি আবারো ‘anek’ সিনেমাটির প্রসঙ্গ টেনে। সিনেমার শেষ পর্যায়ে নর্থইস্টে মিশন নিয়ে যাওয়া একজন এজেন্ট এবং একজন আন্ডার কভার অফিসারের কথপোকথানে আন্ডার কভার অফিসার তার সিনিয়রকে প্রশ্ন করেন- স্যার আমরা কি শান্তি চাই? নাকি শান্তিচুক্তি চাই? উত্তরে তার সিনিয়র অফিসার বলেন- ‘শান্তিচুক্তি’। আমাদের রাষ্ট্রকেও ঠিক করতে হবে কাগজ কলমের সম্প্রীতি চান নাকি সত্যিকারের সম্প্রীতি শান্তি...। ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ গঠনের দিকে যদি সত্যিই যাত্রা করতে পারি আমরা তাহলে সেই পথ যেন পাহাড়ে এসে থেমে না যায়।
লেখক : তথ্যচিত্র নির্মাতা ও অ্যাক্টিভিস্ট