ফ্যাসিজম নিঃসৃত ডগমাটিজম এবং ডগমাটিকদের ‘কী হচ্ছে এসব’ এর আলাপ
বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও লোভী মানুষের সমন্বয়ে হয় ডগমাটিক। চিন্তার ক্ষেত্রে যাকে বলা হয় ডগমাটিজম। ডগমাাটিক চিনতে খুব বেশি দূরে যাবার প্রয়োজন নেই। সামাজিক মাধ্যমে সহজেই এদের দেখা মিলবে। ‘কী হচ্ছে এসব’, ‘এমন স্বাধীনতা কি আমরা চেয়েছিলাম’ কিংবা ‘এক স্বৈরাচারীর হাত থেকে শত স্বৈরাচারীর হাতে পড়লো দেশ’ এসব বক্তব্য থেকেই নিশ্চিত হতে পারবেন এরাই ডগমাটিক। এদের এমন চিন্তাই হলো ডগমাটিজম। ডগমাটিজমের প্রকট প্রকাশ দেখিয়েছেন কিছু শিল্পী জুলাই বিপ্লবকালে। তারা অসংখ্য তরুণের মৃত্যুতে দুঃখিত না হয়ে দুঃখ পেয়েছিলেন বিটিভির পোড়া ভবন দেখে। জানি, এ কথাটা বহুবার বলা হয়েছে এবং বলা হবে। কেন হবে, প্রশ্নটা সেখানেই। আর তার উত্তর হচ্ছে, তারা মতান্ধ অর্থাৎ ডগমাটিক।
একজন মানুষ বুদ্ধি প্রতিবন্ধী না হলে মানুষ বাদ দিয়ে ভবনের জন্য কাঁদতে পারে না। আর এই কাঁদাটা যদি অভিনয় হয়, তাহলে তো আরো ভয়াবহ। অর্থাৎ তারা অনেকটা রুদালিদের মতন ভাড়ায় কাঁদতে যায়। কান্নার বিনিময়ে তারা প্রাপ্তির আশা করে। অর্থাৎ তারা লোভী।
রুদালিদের কথা বলি, ভারতের কিছু অঞ্চলে উচ্চবর্ণের কেউ মারা গেলে, শোক প্রকাশের জন্য লোক ভাড়া করা হয়। ভাড়া করা লোকজন এসে উচ্চস্বরে কান্নাকাটি করে। যত বেশি টাকা তত বেশি কান্না এবং তত বেশি জোরে। এরাই হলো রুদালি। ডগমাটিক বলা যায় রুদালিদের। কারণ তাদের ভেতর কোনো শোক নেই, তারা কাঁদে টাকার জন্য। আর কান্নাটাকে বলা যায় ডগমাটিজম। কারণ তাদের চিন্তাই হলো কেঁদেকেটে টাকা কামাই। স্বজন হারানোর বেদনার অভিনয়টাও তাই। ওই কেঁদেকেটে দেশের কোষাগার লুটে নেয়ার ধান্দা।
সামাজিক মাধ্যমে ডগমাটিকরা ক্রমেই প্রকাশ্য হচ্ছেন। জুলাই বিপ্লবের পর, তারা ভয়ে লেজ গুটালেও এখন পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে লেজ মেলতে চাচ্ছেন। তাদের লেজ গুটানোর কারণও তারা। কারণ তারাই ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতন কালাকানুনের সমর্থন করে নিজেরাই বাকস্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করেছিলেন। মানুষ ভয়ে কিছু বলতে পারতো না। বললেই হামলা-মামলা, গুম-খুন জুটতো নসিবে। এই নসিবকেই তারা স্বাভাবিক ধরে নিয়েছিল।
তারই ধারাবাহিকতায়, তারা লেজ গুটিয়ে ছিল এতদিন এবং তা অভ্যাসের দাস বলে অভ্যাসের দোষে। সেকারণেই অন্যদের উপর চালানো প্রক্রিয়াকেই তারা সত্য বলে মেনেছিলেন আর তা ডগমাটিক হওয়ার কারণেই। তারা মনে করেছিলেন, তারা যেভাবে মানুষের জান-জবানের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিল, অন্তর্বর্তী সরকার বোধহয় তাই করবে। যখন দেখলো না সরকার তা করছে না, তখন তারা লেজ মেলতে শুরু করলো। আর এখন তো পুরো মাথাই বের করে ফেলেছে।
এক নারী সাংবাদিককে দেখলাম, আরেকজনের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে বলছেন, ‘এখনো বুঝো নাই, আস্তে আস্তে বুঝবে’। তারা বলতে চাইছে সেই কথা, ‘এক স্বৈরাচারীর হাত থেকে শত স্বৈরাচারীর হাতে পড়লো দেশ’। অর্থাৎ আগে ফ্যাসিস্ট ছিল একজন, এখন হয়েছে শতজন। না, এটা শুধু কথার কথা নয়, তারা এটাকে রীতিমতো ক্যাম্পেইনে পরিণত করতে চলেছে। ‘কী হচ্ছে এসব’, ‘এমন স্বাধীনতা কি আমরা চেয়েছিলাম’- এগুলো সেই ক্যাম্পেইনেরই অংশ।
‘কী হচ্ছে এসব’ কথাটার জবাবে বলা যায় মুদ্রাস্ফীতির কথা। অন্তর্বর্তী সরকারের একমাসের মধ্যেই মুদ্রাস্ফীতি কমেছে ১.১৭ শতাংশ। হিসেবটা যদি তারা বোঝে তবে তাদের চোখ কপালে ওঠার কথা। ডলারে দাম স্থিতিশীল। বন্যা মোকাবিলায় স্বজন হারানোর কান্না ব্যতিরেকে নিঃশব্দে এসে গেছে ১ হাজার কোটি টাকা। পদ্মা সেতুর চলমান কাজ থেকে সাশ্রয় হয়েছে ১ হাজার ৮০০ কোটিরও বেশি টাকা। মেট্রোরেলের কথা বলি। যে কাজীপাড়া স্টেশন ঠিক হতে ফ্যাসিস্ট রেজিম ১০০ কোটি টাকার কথা বলেছিল, সেই মেট্রোরেল স্টেশন ঠিক হয়েছে একুশ লাখ টাকার কমে। চালু হবার কথা ছিল ১ বছর পর, তার চালু হয়েছে দুই মাসের মধ্যেই। হ্যাঁ, এসবই হচ্ছে। ‘এসব কী হচ্ছে’র জবাব এটাই। শুধু বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হবার কারণে এসব ওনাদের চোখে পড়ছে না। সাথে লোভী হবার কারণে তারা আইএমএফ যে বাংলাদেশকে স্বপ্রণোদিত হয়ে ঋণ দিতে চাচ্ছে তা শুনেও না শোনার ভান করছে। এ টাকার বড় অংশ তো তাদের পকেটে উঠবে না। মেট্রোরেলের ৯৯ কোটি ৭৯ লাখ যেমন তাদের পকেটে ওঠেনি। সুতরাং ভান না করে উপায় কী।
যারা বলছেন, ‘এই স্বাধীনতা কি আমরা চেয়েছিলাম’, তাদের বলছি এই স্বাধীনতাই আমরা চেয়েছিলাম। যে স্বাধীনতার গৌরবে বাংলাদেশের সরকার প্রধানের সাথে বিশ্ব নেতারা ছবি তুলতে লাইন ধরবেন। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্রের প্রধান বাংলাদেশের সরকার প্রধানকে বুকে জড়িয়ে ধরবেন। সকল রীতি ভেঙে বৈঠক করবেন বাংলাদেশের সরকার প্রধানের সঙ্গে। যা গত ৩০ বছরে হয়ে ওঠেনি। এমন স্বাধীনতাই আমরা চেয়েছিলাম, যেখানে জাতিসংঘের প্রধান নির্বাহী অকুণ্ঠ সমর্থন জানাবেন বাংলাদেশকে। উন্নত বিশ্বের তাবৎ শক্তি পাশে থাকার অঙ্গীকার করবে। বাংলাদেশের সরকার প্রধানের পাশে ভারতের সরকার প্রধানকে নিষ্প্রভ দেখাবে। মতান্ধরা না চাইলেও আমরা তাই চেয়েছিলাম।
জানি অন্তর্বর্তী সরকারের ভুল-ভ্রান্তি হচ্ছে এবং হওয়াটা স্বাভাবিক। স্তরে স্তরে যেখানে ফ্যাসিজমের অনুগতরা রয়ে গেছে সেখানে ভ্রান্তি থাকা স্বাভাবিক এবং তা থেকে ভুলটাও স্বাভাবিক। তারপরেও অনেক পরিবর্তন হয়েছে এবং সেই পরিবর্তন দৃশ্যমান। পুলিশের কথাই বলি। আমি কদিন আগে পুলিশ হেড কোয়ার্টার, সিআইডি, পিবিআইয়ের প্রধান কার্যালয়ে গিয়েছি। আগেও গিয়েছি, কিন্তু এবার পরিবর্তন দৃশ্যমান। আগে নিজের এবং কাজের গুরুত্ব বোঝাতে রিসেপশনিস্টের কাছেই ব্যয় হতো অনেকটা সময়। এখন রিসেপশনিস্ট নিজেই স্যার ডেকে বিনীত ভাবে জিজ্ঞেস করেছেন, আমি কী জন্য এসেছি। যা ফ্যাসিস্ট রেজিমে চিন্তাই করা যেত না।
খোদ রিসেপশনিস্টরাই নিজেদের আইজিপি ভেবে বসে থাকতেন। সাহায্যপ্রার্থী কিংবা দেখা করতে আসা মানুষকে ধমকে কথা বলতেন। এবার দেখেছি ঠিক তার উল্টোটা। বিমান বন্দরের চিত্র পাল্টে গিয়েছে। ফ্যাসিস্ট রেজিমে এক ইতালি প্রবাসীকে ভুল-ভাল ইংরেজিতে নিজের দেশকে গালি দিতে শুনেছি এবং গালি দিয়েছেন নিগৃহীত হয়েছেন বলেই। বিমান বন্দরের এখনের চিত্র ঠিক তার উল্টো। এখন যদি তিনি দেশে আসেন, তবে নিশ্চিত তার গালি ভালোবাসার বুলিতে পরিণত হবে।
জানি, তারপরেও অনেকে বলবেন, প্রশাসন তো ঠিকমতো কাজ করছে না। কীভাবে করবে, ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত ফ্যাসিস্টদের লোক বসানো। শুধু ওপরের দিকে পরিবর্তন হয়েছে, নিচের দিকটা এখনো বাকি। সোজা কথায় ইঞ্জিন আর বগির ঠিকমতো সমন্বয় হচ্ছে না, তাই গতিটা ধীর। কদিন আগেই একটা বিক্ষোভ দমাতে নিচের দিকের পুলিশরা অ্যাকশনে যেতে চায়নি।
গণমাধ্যম লিখেছে, পুলিশের নিম্ন পদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তা কনস্টেবলদের অ্যাকশনে যেতে নিরস্ত করেছেন। বাধ্য হয়েই পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের খোদ রাস্তায় নামতে হয়েছিল। তাদের কাউকে আফসোস করে বলতে শোনা গেছে, এভাবে পুলিশ চলতে পারে না, এমন কথাও। অতএব যারা দুই মাস না যেতেই ‘হচ্ছে না’ বলে অস্থির হয়ে উঠেছেন, তাদের নিজেদের রাশটা টানতে হবে। ফ্যাসিজমের শেকড় অনেকদূর পর্যন্ত গিয়েছে, তা উপড়াতে সময় লাগবে। আর এই সময়টার মধ্যে ঘটতে থাকবে নানান ঘটনা। কদিন আগেই সেসবের নজির দেখেছে এদেশের মানুষ এবং এখনো দেখছে। সামনে দুর্গাপূজা। ঘটনা ঘটানোর একটা সুযোগ। পারতপক্ষে ফ্যাসিস্ট অনুসারীরা এই সুযোগ হাতছাড়া হতে দেবে না। যদিও আইজিপি বলেছেন, তেমন কোনো শঙ্কা নেই। না থাকলে ভালো। কিন্তু ফ্যাসিজমের প্রেতাত্মারা যখন তখন কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে, তাদের নজর-আন্দাজ করাটা খুব বেশি বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
মনে রাখতে হবে, ডগমাটিকরা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। তাদের দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি কোনো দায় নেই। তারা শুধু দায়বদ্ধ তাদের ফ্যাসিস্ট নেতা-নেত্রীদের কাছে। দেশ গোল্লায় যাক তাদের কিছুই যায় আসে না। বিশ হাজার কেন, বিশ লাখ পঙ্গু হোক তাদের কিছু যায় আসে না। দুই হাজার কেন পঞ্চাশ হাজার মরুক তাতেও তাদের কিছু যায় আসে না, আসবে না।