আন্দোলনের ‘মাস্টারমাইন্ড’ তত্ত্ব রুখে দেওয়া জরুরি
আহমেদ খিজির
প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৪৮ পিএম
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মুহম্মদ ইউনুস যুক্তরাষ্ট্রে এক অনুষ্ঠানে সবার সামনে তাঁর বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলমকে জুলাই আন্দোলনের ‘মাস্টারমাইন্ড’ বলে পরিচিত করে দিয়ে পুরো আন্দোলনটিকে ‘পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরিকল্পিত (meticulously designed) বলে উল্লেখ করেন।
ইউনুসের এহেন দাবি সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন আলোচনায় বিতর্ক তৈরি করেছে। এর আগে বিভিন্ন জায়গা থেকে মাস্টারমাইন্ড তত্ত্ব দেওয়া হলেও সরকারিভাবে এই স্বীকৃতি, বিশেষত মার্কিন মুলুকে গিয়ে এই আলাপ দেওয়াটা অনেকের ভ্রূ-কুঁচকে দিয়েছে। অনুষ্ঠানটা ইউনুসের বন্ধু, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের হলেও উনার এই ঘোষণা সরকারি ভাষ্য বলেই ধরা নেওয়া হবে।
আর সব গণ-আন্দোলনের মতোই, জুলাইয়ের আন্দোলন একদিনে গড়ে উঠেনি। আওয়ামী শাসনে পিষ্ট হয়ে মানুষ দিনের পর দিন বিরক্ত হয়েছে। সুযোগ খুঁজেছে সরকারের পতন ঘটানোর। বিএনপির নেতা-কর্মীরা বছরের পর পর জেল জুলুম মোকাবিলা করেছেন, রাষ্ট্রযন্ত্র আর আওয়ামী গুন্ডাদের হাতে খুন ও গুম হয়েছেন অসংখ্য নেতা-কর্মী।
আর শেষতক জুলাই মাসে আন্দোলনটা সফল হয়েছে কারণ এই আন্দোলনে কোনো নেতা ছিল না। ছাত্রদের কোটাবিরোধী আন্দোলন, বৈষম্যবিরোধী প্ল্যাটফর্মে পরিণত হলেও হাসিনার জেদ, পুলিশের খুনে মনোভাব গোটা দেশবাসীকে মাঠে নামায়। এ অঞ্চলের ইতিহাসে জনগণকে অপমান করে, মেরে কেউ ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। হাসিনাও পারেনি।
তবে, হাসিনাশাহী ভেবেছিল যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল খালি করে দিয়ে, কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের ঠান্ডা করে দিয়ে আন্দোলন দমিয়ে ফেলা যাবে। কিন্তু, মাঠে নেমে আসলো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা, যাদের সাথে তথাকথিত মাস্টারমাইন্ডদের যোগাযোগ ছিল ক্ষীণ, যাদের কোটা নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না।
এরপর যখন ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হলো, মুগ্ধ-সাইদদের হত্যা করা হলো, তখন নেমে এলো আপামর জনতা। যাত্রাবাড়ী আর উত্তরা হয়ে উঠলো যুদ্ধক্ষেত্র। খালি হাতে পুলিশ আর গুন্ডাদের বিরুদ্ধে নামলো সর্বস্তরের মানুষ। সেই নেমে আসা কোনো মাস্টারমাইন্ড বা কেন্দ্রীয় সমন্বয় দিয়ে হয়নি।
এটা ঠিক, অবস্থানগত কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবার আন্দোলনের কেন্দ্র হলো, সেইখান থেকেই এক দফা দাবি তোলা হলো এবং ঢাকা মার্চের ঘোষণা দেওয়া হলো। কিন্তু এইসব কোনোটাই ইউনুসের ভাষ্যমতো ‘পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরিকল্পিত’ ছিল না।
এই আন্দোলনে বিএনপির প্রায় ৫০০ কর্মী নিহত হয়েছেন, ডান-বাম নির্বিশেষে সকলে এই আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন। এমনকি সরকারি চাকরির ঝুঁকি নিয়েও পরোক্ষভাবে, গোপনে সহায়তা করেছেন অনেকে। অনেকটাই যেন মুক্তিযুদ্ধের মতো।
ফলে, এই আন্দোলনকে ‘মাস্টারমাইন্ড’ তত্ত্ব দিয়ে ঢেকে দেওয়া অনেকটা আওয়ামী বয়ানের মতো শোনায়। গণ-আন্দোলনের চেতনাকে বিনষ্ট করে। ইউনুস সরকার গত দেড় মাসে আইনশৃঙ্খলা ঠিক করতে না পারলেও, নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্র ফেরানোর কাজে অগ্রসর হতে না পারলেও নির্দিষ্ট কিছু মানুষকে ক্রেডিট দিয়ে গণ চেতনা ঠিকই নষ্ট করছেন। কেউ কেউ ধারণা করছেন, এইসবই নির্বাচন পিছিয়ে দিয়ে মনমতো ‘কিংস পার্টি’ গড়ে তাঁদের ক্ষমতায় নেবার পরিকল্পনার অংশ, আবার কেউ কেউ ভাবছেন, মাঠের রাজনীতি না করা ইউনুসের অপরিপক্বতা।
বাংলাদেশের মানুষ হাসিনার পতন ঘটানোর পর বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ইউনুসের নেতৃত্ব গঠিত সরকারকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিচ্ছে। সরকারের সংস্কার উদ্যোগের জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে। কিন্তু, এহেন মাস্টারমাইন্ড তত্ত্ব দেশের গণতন্ত্র পুনুরুদ্ধারে বিরাট বাঁধা। এইসব রুখে দেওয়া জরুরি।