‘মবের মুল্লুকে’ কুতর্কের বেসাতি
বিশৃঙ্খল অবস্থা কিংবা অরাজক পরিস্থিতি বোঝাতে বাংলায় বেশ জনপ্রিয় প্রবাদ মগের মুল্লুক। ১৬৬৩ সাল পূর্ব বাংলায় ইন্দো-চীন নিবাসী মারমগরি, ভূঁইয়া মগ, বড়ুয়া মগ, রাজবংশী মগ, মারমা মগ, রোয়াং মগ কিংবা ভ্যুমিয়া মগদের মধ্যে থেকে ভয়ানক এক দস্যুদল আসতো মগ রাজার দেশ থেকে। তারা ছিল পর্তুগীজ নৌ-দস্যুদের একটি বিবর্তিত রূপ। তারা বাংলায় যে অরাজকতার সৃষ্টি করেছিল তা বোঝাতে ‘মগের মুল্লুক’ তথা ‘যাচ্ছেতাই কাজকম্মের দেশ’ কথাটা প্রচলিত হয়েছিল।
প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে বহুল আলোচিত ‘মাৎস্যন্যায়’ তথা ‘মাছের রাজত্ব’ বলতে যা বোঝায় অনেকের মতে মগের মুল্লুক ঠিক তাই। এ সময়কাল নিয়ে আহমদ শরীফ লিখেছেন ‘মগ জলদস্যুরা জলপথে বাংলাদেশের ভুলুয়া, সন্দ্বীপ, সংগ্রামগড়, বিক্রমপুর, সোনারগাঁ, বাকলা, যশোর, ভূষণা ও হুগলী লুণ্ঠন করত। তারা হিন্দু-মুসলিম, নারী-পুরুষ ও বড়-ছোট-নির্বিশেষে ধরে নিয়ে যেত। হাতের তালু ফুঁড়ে বেত চালিয়ে গরু-ছাগলের মতো বেঁধে নৌকার পাটাতনে ঠাঁই দিত। মুরগীকে যেভাবে দানা ছিটিয়ে দেওয়া হয়, তাদেরও তেমনি চাল ছুড়ে দেওয়া হত খাবার জন্যে। এ অবহেলা ও পীড়নের পরেও যারা বেঁচে থাকত তাদেরকে ভাগ করে নিত মগে-পর্তুগীজে’।
বাংলার ইতিহাসে মগদের এই দৌরাত্ম্য নিয়ে অনেকেই অনেক কথা লিখে গিয়েছেন। তবে ‘মব’ বলতে কি বোঝায় সে দিকে আলোকপাত করা জরুরি। হঠাৎ করে অনেকজন মানুষ কোনো জনাকীর্ণ স্থানে খুব স্বল্প সময়ে অপ্রচলিত এবং দৃশ্যত উদ্দেশ্যহীনভাবে কিছু বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড করে বিচ্ছিন্ন ভাবে বিভিন্ন স্থানে হারিয়ে গেলে তাদের মব বলা যেতে পারে।বিনোদন দেওয়া, ট্রল কিংবা ব্যঙ্গ করা কিংবা শৈল্পিক কোনো ধারণা তুল ধরতে এই মবের আয়োজন বলে তাকে ‘ফ্ল্যাশ মব’ হিসেবে চিনে থাকেন সবাই। মব তথা ফ্ল্যাশ মবে যারা অংশ নিয়ে থাকেন এখানে কারও কোনো নেতৃত্ব কিংবা দায় থাকে না। সবাই যার যার জায়গা থেকে পারফর্ম করে ঘটনাস্থল থেকে সরে যান। ফলে হঠাৎ করে তারা দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যাওয়ার আগে নতুন কাউকে জায়গা করে দেন।
জুলাই বিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশকে মজা করে ‘মবের মুল্লুক’ বলা যেতে পারে। কারণ স্বৈরচারী শাসন পতনের পর থেকে নানাবিধ সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা সামনে হাজির হচ্ছে অনেকটা ফ্ল্যাশ মবের মতো। গণঅভ্যুত্থানের মুখে পড়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভারতে পালিয়ে গেলেও তার সন্তান বিদেশ বিভূঁই থেকে হুমকি দিয়ে বসেন ‘ভয়ংকররূপে ফিরে আসার’। সবাই এই বক্তব্য শুনে থমকে গিয়েছিলেন। সবাই এতোদিন কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায় শুনেছেন ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে - এই বাংলায়/ হয়তো মানুষ নয় - হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে; / হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে’। কিন্তু ভয়ংকররূপে ফিরে আসা সেটা আবার কী? অনেকেই এটা নিয়ে সন্দেহের মধ্যে ছিলেন।
অল্পসময় ব্যবধানে ‘ভয়ংকররূপে ফিরে আসার’ নমুনা হিসেবে শুরু হয় যেন ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ প্রতিযোগিতা। শুরুতে বিদ্রোহ-বিক্ষোভ আর প্রতিবিপ্লবের বার্তা নিয়ে হাজির হতে দেখা যায় সংখ্যালঘু রূপে, তারপর হুট করে বেড়ে যায় ডাকাতের উপদ্রব, বিদ্রোহী আনসাররা গিয়ে ঘেরাও করে সচিবালয়, হুমকি আসতে থাকে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীদের গণছুটির, ‘ব্যাটারি নাকি প্যাডেল’ কারা থাকবে রাজপথে এটা নিয়ে হুমকি ধামকি আসে রিকশাওয়ালাদের তরফ থেকে।
‘পদ্মা মেঘনা যমুনা, ব্যাটারি রিকশার ঠিকানা/ তুমি কে আমি কে ব্যাটারি ব্যাটারি’ এমন শ্লোগানে যখন শাহবাগ উত্তাল তখন দেশের নানা স্থানে পূর্বতন বেতনভাতা অপ্রাপ্তির ক্ষোভ থেকে আবারও রাজপথে নেমেছেন পোশাক শ্রমিকরা। তবে অন্যদের মতো তাঁরা ভয়ংকররূপে ফিরে আসা কেউ নন। কারণ বিগত স্বৈরাচারী সরকারের সময়েও তাঁরা বহুবার বিক্ষোভ করেছেন। গুলি খেয়ে মরেছেন, রানা প্লাজায় চাপা পড়েছেন, তাজরিন ফ্যাশানে পুড়ে অঙ্গার হয়েছেন।বহুদিনের দাবি দাওয়ার বিপরীতে তাঁরা খাওয়ার মধ্যে খেয়েছেন গুলি, আর পাওয়ার মধ্যে পেয়েছেন অবিচার।তাই তাঁরাও হয়তো ভেবেছেন জনগণের ভোটে সরাসরি নির্বাচিত না হোক বিপ্লবের ফসল হিসেবে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসেছেন কিছু না হোক অন্তত জনদাবি তাদেরকে জানিয়ে যদি কিছুটা সুফল পাওয়া যায় দোষ কী?
নেতার হুংকার শুনে ‘ভয়ংকররূপে ফিরে আসার’ প্রথম দৃশ্যপট মঞ্চায়িত হয়েছিল গোপালগঞ্জে। তারপর তা দাবানলের মতো নানাস্থানে ছড়িয়ে যাওয়ার যে শঙ্কা তা ধীরে ধীরে স্তিমিত হয় সেনাবাহিনীর সুদক্ষ অবস্থান গ্রহণের মধ্য দিয়ে। তবে ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ প্রতিযোগিতা আরও প্রলম্বিত হয় দেশের নানা স্থানে চিকিৎসকদের কর্মবিরতির মধ্য দিয়ে। তবে দ্রুত তাঁদের দাবি দাওয়া মেনে নেওয়ার পাশাপাশি উপযুক্ত নিরাপত্তাবিধান নিশ্চিত করায় চিকিৎসকরা ফিরে গিয়েছেন নিজ নিজ কর্মস্থলে।
জুলাই বিপ্লব তথা গণঅভ্যুত্থান যাই বলা হোক এর পরর্বতীকালের অস্থিতিশীলতা বিপ্লবের বাস্তবতা থেকে বিশ্লেষণ করতে গেলে স্বাভাবিক বটে।কারণ যে কোনো বিপ্লবের পর উদ্দিষ্ট ভূখণ্ডে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমরা যদি স্টিফেন হিলের ‘In Defence of Our Humanity: Real Life as a United Nations Ambassador in a Troubled World’ বইটা পড়তে যাই সেখানে গণ অভ্যুত্থান তথা বিপ্লবের পর কিছু ঘটনাকে অবশ্যম্ভাবী হিসেবে তুলে ধরতে দেখি।
ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব ও ইরান বিপ্লবের উদাহরণ সামনে রেখে তিনি বিপ্লব পরবর্তীকালের ঘটনাপ্রবাহ হিসেবে স্বাভাবিক মনে করেন রাজনৈতিক ও সামাজিক রূপান্তর (Political and Social Changes), অর্থনৈতিক পরিণতি (Economic Consequences), সহিংসতা এবং অস্থিরতা (Violence and Instability) এবং আন্তর্জানিক সম্পর্কে (International Relations) গুরুত্বপূর্ণ রূপান্তর ঘটবেই। বেশিরভাগ দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক রূপান্তর হিসেবে বিভিন্ন নিত্যনতুন অবকাঠামো গড়ে উঠতে দেখা যায়, সামাজিক স্তরবিন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ রদবদল ঘটে এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণ দৃশ্যমানরূপে বেড়ে যায়। অভ্যুত্থানের পর বেশিরভাগ দেশে আর্থিক বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। বিভিন্ন ধরনের কোম্পানিকে রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। বৈদেশিক বিনিয়োগ ও আয়ব্যায়ের ক্ষেত্রেও দেখা যায় বিভিন্ন রূপান্তর ও পরিবর্তন। তবে বিপ্লব কিংবা অভ্যুত্থানের পর বেশিরভাগ দেশেই সহিংসতা এবং অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়া একরকম অনিবার্য পরিণতি।
জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে তাই এখনই হতাশ হওয়ার কিছু নাই। আমরা বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করতে পারি। বিশেষত, বর্ষাকালে হঠাৎ ধেয়ে আসা ঝুম বৃষ্টিতে ভেজার ভয়ে সবাই বাধ্য হয়ে অনেকক্ষণ কোনো না কোনো শেডের নিচের আটকে থাকেন। তারপর বৃষ্টি ছাড়লে সবাই একসঙ্গে রাস্তায় নামেন। এই সময় তাড়াহুড়োয় যানজটের পাশাপাশি বিভিন্নরকম বিশৃঙ্খলা সৃস্টি হতে পারে। এই সময়ের অনাকাঙ্ক্ষিত বিশৃঙ্খলা দেখে কেউ কি বলেন যে ‘বৃষ্টি ছাড়াটাই উচিত হয়নি’ কিংবা ‘সবাইকে সারাদিন বৃষ্টির ভয়ে শেডের নিচে আটকে থাকাটাই ভাল ছিল’।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান ঠিক বৃষ্টি ছাড়ার পরের মুহূর্ত।এই অভ্যুত্থান অগণিত ছাত্রজনতার তাজা রক্তে স্নানের মধ্য দিয়ে স্বৈরতান্ত্রিকতা থেকে পবিত্র করেছে বাংলাদেশকে।ঘনঘোর ফ্যাসিবাদী বর্ষার পর হঠাৎ আকাশ থেকে উঁকি দেওয়া সূর্যের মতো ঘটেছে এই ছাত্রজনতার বিপ্লবী অভ্যুত্থান।বৃষ্টি ছেড়ে যাওয়ার পরের সামান্য বিশৃঙ্খলার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারলে যেমন জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়। আর সেটা মানিয়ে না নিয়ে কেউ যদি ঘরে বসে থাকে সেটা ভিন্ন কথা। ঠিক তেমনি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরের এই সামান্য বিশৃঙ্খলার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারলে তবেই আমরা সমৃদ্ধ বাংলাদেশের দেখতে পারি।
সেকালের ‘মগের মুল্লুক’ থেকে আজকের ‘মবের মুল্লুক’ রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় নিতান্তই কিছু ঘটনাপ্রবাহ মাত্র।সম্প্রতি নানাজনের নানা মত আর পথ উসকে দিয়েছে তর্কের পরিসর। কেউ কেউ পুরোদস্তুর খুলে বসেছেন বিবিধ কুতর্কের দোকান।ভোটের অধিকার হরণ, গুম, খুন, অপহরণ কিংবা অবিচারের প্রতিটি পদক্ষেপে নিশ্চুপ থাকা মানুষগুলোও এখন বাকস্বাধীনতার সুবিধা পুরোপুরি উপভোগ করছেন। তারা বাকস্বাধীনতার ব্যবহার করতে গিয়ে নির্লজ্জতার শেষ সীমায় গিয়ে এটাও বলছেন ‘আগেই ভাল ছিলাম।রাস্তায় এতো অটোরিকশা ছিল না। এতো যানজট হতো না। কেউবা বলছেন লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ার কথা।কেউ কেউ সামান্য সমস্যাকে তিল থেকে তাল করে প্রচার করছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে’। তবে এই সব বিতর্ক কিংবা কুতর্ক এগুলোও আমাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সুনিশ্চিতকরণের দিক থেকে চিন্তা করলে ইতিবাচক হিসেবেই ধরতে হবে। আর এগুলোর মধ্যে থেকেও যদি আমরা ইতিবাচকতা খুঁজে নিতে পারি তাহলে সহজেই একটি সমৃদ্ধ ও পরমতসহিষ্ণু উদারনৈতিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা ও বাস্তবায়ন করা আমাদের জন্য অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে।
ড. মো. আদনান আরিফ সালিম
সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।