মাজার, মব, মাফিয়া অথবা ব্যক্তির আধ্যাত্মিক স্বাধীনতার ইশতেহার
সেলিম রেজা নিউটন
প্রকাশ: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:১৭ পিএম
আফগানিস্তানের নীল মসজিদ: হযরত আলীর রওজা। ছবি: উইকিপিডিয়া
ধর্ম দুই রকম। আল্লাহ্র ধর্ম আর রাজা-ফেরাউনের ধর্ম। গরিবের ধর্ম এবং বড়লোকের ধর্ম। নিপীড়িত-শাসিতের ধর্ম এবং নিপীড়ক-শাসকের ধর্ম। মজলুমের ধর্ম এবং জালিমের ধর্ম। মায়ের ধর্ম এবং মাফিয়ার ধর্ম। ব্যক্তির ধর্ম এবং পাল অথবা ‘মব'-এর ধর্ম।
আল্লাহ্র ধর্ম আল্লাহ্র এলাকা। কওম, কমিউনিটি এবং সমাজের এলাকা। সংহতি আর পারস্পরিক সহযোগিতার এলাকা। আল্লাহ্র এলাকা সব প্রাণির জন্য খোলা। সূর্যের আলো অথবা নদীর জল সবার জন্য অবারিত।
অন্যদিকে রাজার ধর্ম রাজনীতির এলাকা। শাসন ও বলপ্রয়োগের এলাকা। রাজার রাজ্য শুধু অনুগতদের জন্য, দাস-প্রতিপালনের জন্য এবং আজাদি উচ্ছেদের জন্য। রাজনীতি মানে ভাগ করা এবং শাসন করা। গায়ের জোরে অপরকে দমন করা। আল্লাহ্র ধর্ম হলো মনুষ্যধর্ম। কৌতূহল, ভালোবাসা, মুক্তি ও স্বাধীনতার ধর্ম। ধর্ম নিছক দণ্ডবিধি নয়। ধর্ম এসেছে মানুষকে এবং নিখিল মাখলুকাতকে ধারণ করার জন্য, মুক্ত ও স্বাধীন করার জন্য। কিন্তু রাজার ধর্ম স্রেফ শাস্ত্রের ধর্ম। আর শাস্ত্রের ধর্মই হলো শাসন ও বলপ্রয়োগ। শাস্ত্র নিতান্তই কতকগুলো কঠোর বিধিবিধান, যে-বিধিবিধান মেনে না চললে তুমি ধর্মের বাইরে। তুমি একঘরে। তুমি বাতিল।
শাস্ত্রধর্মই কিন্তু রাজধর্ম, রাষ্ট্রধর্ম। মানে রাষ্ট্রের ধর্ম। হ্যাঁ, আল্লাহ্র ধর্মের বিপরীতে রাষ্ট্র তার নিজস্ব ধর্ম কায়েম করে বৈকি। সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞ আল্লাহ্র কাছে আশ্রয় প্রার্থনার বিপরীতে রাষ্ট্রধর্ম চায় তার নিজের প্রতি সমস্ত মানুষের আনুগত্য। আল্লাহ্র সার্বভৌমত্বের বিপরীতে সে দাবি করে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব। জীবন-মৃত্যুর মালিক তো আল্লাহ্, অথচ গণবিরোধী আইন ও দণ্ডবিধির জোরে রাষ্ট্রই হয়ে ওঠে নাগরিকদের জীবনমৃতু্য এবং মানইজ্জতের মালিক।
গায়ের জোরে, একচেটিয়া শাস্তির জোরে, ভয়-আতঙ্ক-প্রোপাগান্ডার জোরে এবং ফেতনা-ফ্যাসাদ-বিভক্তির কৌশলে রাষ্ট্রধর্ম হয়ে ওঠে সর্বশক্তিমান। আল্লাহ্র ধর্ম আনুভূমিক, কিন্তু রাষ্ট্রের ধর্ম উলম্ব-আমলাতান্ত্রিক। আল্লাহ্র ধর্ম প্রেম, ভক্তি, ভালোবাসার। রাষ্ট্রের ধর্ম ভয়, আতঙ্ক এবং প্রোপাগান্ডার, এবং জুলুম ও বলপ্রয়োগের। আল্লাহ্র ধর্ম সর্বজনীন ঐক্যের। রাষ্ট্রের ধর্ম ফেতনা-ফ্যাসাদ-বিভক্তির।
রাষ্ট্রধর্মই জন্ম দেয় ফ্যাসিবাদের। ফেতনা-ফ্যাসাদ-বিভক্তি, খুন-গুম-ক্রসফায়ার, এবং ভয়-আতঙ্ক-প্রোপাগান্ডার শক্তিতেই টিকেছিল খুনি ফ্যাসিবাদী হাসিনা। এর বিপরীতে আপামর নিপীড়িত-মজলুম নাগরিকদের আন্তরিক দরদভরা ভালোবাসা ও ঐক্যের অতুলনীয় উজ্জ্বলতায় ভরপুর সাহস ও সংহতির পথে, মনুষ্যধর্মের পথে, আল্লাহ্-ঈশ্বর-ইউনিভার্সের পথে নিজেদের জান হাতে করে নেমেছিল ছাত্রজনতা, আপামর মেহনতি মানুষ। ঘটিয়েছিল ৩৬ শে জুলাইয়ের অভ্যুত্থান, গণ-অভ্যুত্থান, বিপ্লব। ছিনিয়ে এনেছিল ইবলিস-ফ্যাসিবাদের হাত থেকে বাংলাদেশের মুক্তি।
.দুই॥
গতকাল যাঁরা মন্দির ভাঙতে গিয়েছিলেন, অথবা আগামীকাল যাঁরা মাজার ভাঙতে যাচ্ছেন, তাঁরা দুর্বল-মজলুম-গরিবের ধর্মের ওপর হামলা চালাচ্ছেন। এই জালিমদের ধর্ম বড়লোক-বড়হুজুরদের পোষা পালের ধর্ম। জুলুমের ধর্ম। এরা আসলে প্রান্তিক দুর্বলের, গরিবের ও মজলুমের ‘ব্যক্তি' হয়ে ওঠার রাস্তা বন্ধ করতে চাচ্ছেন। মাজার মূলত গরিবের প্রতিষ্ঠান। গরিবের গণপরিসর। গরিবের একান্ত আত্মগত, অন্তর্গত এবং আত্মাগত পরিচয়কে ধারণ করে খোদ আল্লাহ্র সামনে ব্যক্তিগতভাবে হাজির থাকার পথ।
আরবিতে মাজার শব্দটার আক্ষরিক অর্থ হলো জিয়ারত বা পরিদর্শন করার স্থান। শব্দটা এসেছে “জারা” ধাতু থেকে, যার অর্থ পরিদর্শন করা বা জিয়ারত করা। কিন্তু এ কথা ভুলে যাওয়ার কোনো উপায়ই নাই যে, গত দেড় দশকের ফ্যাসিবাদে আধ্যাত্মিক পথ-পিপাসুদের পরিদর্শনকে ছাড়িয়ে গেছে খুনি আওয়ামী রাষ্ট্রের মারাত্মক উন্নয়নমূলক মাজার-পরিদর্শন। অর্থাৎ গরিবের গণপরিসরে অনুপ্রবেশ ঘটেছে রাষ্ট্র-শিক্ষিত, বড়োলোক, উঁচু শ্রেণীর ধান্দাবাজ এবং মাফিয়া লোকজনের।
ঢুকেছে এরা রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের নেতা-হাতা হিসেবে। ঢুকেছে মাজার-কমিটির রূপ ধারণ করে। আরো ঢুকেছে মাজার-উন্নয়নের মাফিয়া-ঠিকাদার হিসেবে। এলাকার কমিশনার, ইউএনও, এমপি এবং ডিসি সাহেবদের নিয়ে লাইন ধরে তৈরি হয়েছে মাজার পরিচালনার আত্মাহীন আমলাতান্ত্রিক কমিটি। একেকটা মাজারের পরিচালনা কমিটি ভরে গেছে বিয়ে-এমএ পাশ-ফেল করা কবি-সাহিত্যিক-মার্কা পোশাক-আশাক পরা লোকজন দিয়ে। এরা হলো মাজারের প্রথম শ্রেণীর মাফিয়া। আর অর্থপিপাসু যত ইবলিস নিয়ে গঠিত খুনি হাসিনার উন্নয়ন-ঠিকাদার-লীগ মাজারে মাজারে গড়ে তুলেছে নতুন নতুন দালানকোঠা এবং তোরণ। দ্বিতীয় শ্রেণির মাফিয়া এরা।
এই দুই টাইপ মাফিয়াদের উন্নয়নের টাইলসে নিরিবিলি গাছতলার পুরানা শ্যাওলাপড়া অন্তরঙ্গ কবরগুলো এমনই জাতে উঠেছে, তাকে আর চিরচেনা মাজার বলে চেনাই মুশকিল। এই মাফিয়ারা একেবারে শেষ করে ফেলেছে ঘন সবুজ গাছপালা দিয়ে ঘেরা খোলা উঠান এবং সর্বপ্রাণ-সর্বপ্রকৃতি ও পাগলসাধুর স্মৃতি নিয়ে গড়ে ওঠা মানুষের মিলনমেলাকে। মাজারগুলোর চিরায়ত অর্গানিক প্রাণপ্রবাহের সিলসিলা চিরকাল যাঁরা বহন করেছেন সেই গরিব, সাধু, পাগল এবং সমাজ-পরিত্যক্ত ব্যক্তি-মানুষদের জায়গাই গেছে কমে। মাজারে, খানকায়, আখড়ায় এঁরাই এখন অনাকাঙ্ক্ষিত, অবাঞ্ছিত, পরিত্যক্ত।
সবাই নিশ্চয়ই এক না, কিন্তু তৃতীয় শ্রেণির মাফিয়ার মধ্যে আছে স্থূল মাজার-ব্যবসায়ী পীর-বাবা-খাদেমের দল। এরা আছে অনেক কাল ধরে। মাজারগুলো হয়ে উঠেছে দুর্নীতিপরায়ণ ধান্দাবাজদের পয়সা কামানোর মেশিন — আল্লাহ্র নামে, অলি-আউলিয়ার নামে, ধর্মের নামে। মাফিয়া-মানবতার মাদারবোর্ড-আম্মার মাফিয়া-সন্তান এই বদমাশের দল। তাই, মাফিয়া-রাষ্ট্রের উঁচুতলার শয়তানির সমস্ত ছোটো ছোটো রূপই আপনি দেখতে পাবেন এইসব মাজারের মধ্যে।
এসবের বাইরে ছিল আরো এক উৎপাত। মঠ-মন্দির-প্যাগোডা অথবা শহীদ মিনারের মতো মাজার-খানকা-আখড়াগুলোতেও ঢুকেছিল ইঙ্গ-মার্কিন-ইসরায়েলি এবং ভারতীয় ডিপস্টেটসমূহের গোয়েন্দাযন্ত্র কর্তৃক বিনির্মিত এবং সর্বাত্মক রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্র কর্তৃক পুনঃ পুনঃ মঞ্চায়িত জঙ্গি-আতঙ্ক। আত্মশক্তি, গণশক্তি, সমাজশক্তি এবং বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার বদলে এসব স্থান ও প্রতীকের আশ্রয়ে থাকা বিভিন্ন আতঙ্ক-প্রিয় জনগোষ্ঠী গিয়ে উঠেছিল ফ্যাসিবাদ নামক সর্বাত্মক রাষ্ট্রতন্ত্রের কপট আশ্রয়ের কোলে। ফলত হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান, ভুয়া-সেকুলার এবং বিভিন্ন লোকধর্মের অন্তত কিছু কিছু মানুষ পরিণত হয়েছিল ফ্যাসিবাদী হাসিনার সমর্থকে। আর অতীব দুঃখজনক ঘটনা হলো, সুফি ধারার কতিপয় নেতাও আওয়ামী ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিক এনাবলার মিত্র হয়ে উঠেছিল। আল্লাহ্- ঈশ্বর-ইউনিভার্সের ধর্মকে ক্রমাগতভাবে ফোকলা করে দিচ্ছিল ইবলিসের রাষ্ট্রধর্ম। আমরা এসব থেকে উদ্ধার পেয়েছি আমাদের রূপকথার মতো আশ্চর্য কিন্তু অতি-আকাঙ্ক্ষিত জুলাই-বিপ্লবের মাধ্যমে।
এই সার্বিক প্রেক্ষাপটেই যে বঙ্গীয় ফ্যাসিবাদের পিতা শেখ মুজিবের অতিকায় মূর্তি এবং আওয়ামী লীগের মতো করে জুলাই বিপ্লবের উপর্যুপরি ঢেউয়ের ধাক্কায় এই সমস্ত স্থান, প্রতীক, স্থাপনা ও জনগোষ্ঠীও খানিকটা দুলে দুলে উঠেছে সেটা বিস্মৃত হওয়াটা আমাদের ইনবিল্ট বিচারবুদ্ধি ও বিবেকবুদ্ধির অপ্রতুলতার দিকেই ইঙ্গিত করে।
.তিন॥
মাজার আমার আরাধ্য নয়। পীর-মুরশিদ-গুরু-গোঁসাই-বাবাদের চরণ ধরে মুক্তি খোঁজার পথও আমার নয়। কিন্তু প্রতীক-রূপক হিসেবে দেখলে, পূণ্য-প্রেরণা লাভের আশায় প্রার্থনা ও পরিদর্শনের জন্য যাই এমন কত কিসিমের ‘মাজার' যে আমাদের সমাজে আছে! আখড়া, থান, খানকা, মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা, পার্টি-অফিস, সামরিক-কর্পোরেট হেডকোয়ার্টার, মহাবিহার, মঠ, বিশ্ববিদ্যালয়, সচিবালয়, বঙ্গভবন, বিজ্ঞান, নাসা, অথবা শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ, নাস্তিক-সংশয়বাদী সমিতিসমূহের বিভিন্ন পবিত্র কার্যালয় ইত্যাদি-প্রভৃতি পবিত্র-অপবিত্র কোনো স্থানই আমার আরাধ্য নয়। তবে, প্রাচীন রোমান নাট্যকার টেরেন্সের কোনো নাটক যদিও আমি দেখি নি কিন্তু ল্যাটিন ভাষায় তাঁর এই কথাটা আমারও কথা: “Homo sum, humani nihil a me alienum puto", অর্থাৎ “আমি মানুষ, মানুষ সম্পর্কিত কিছুই আমার অনাত্মীয় নয়।"
তদুপরি, কোনো ‘হুজুর'ই আমার পরম আরাধ্য নন। শিক্ষা-হুজুর, দীক্ষা-হুজুর, ধর্ম-হুজুর, মাদ্রাসা-হুজুর, বিশ্ববিদ্যালয়-হুজুর, ক্যান্টনমেন্ট-হুজুর, মিডিয়া-হুজুর, সচিবালয়-হুজুর, পারিবারিক হুজুর, সামাজিক হুজুর, রাষ্ট্রীয় হুজুর — এত হাজার হাজার ‘হুজুর' ঘাড়ে করে নিয়ে ঘোরার মতো অবস্থা আমার নাই। তা ছাড়া, সব হুজুরের একই রা। সবাই মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে চান। নিজের গোয়ালের গরু বানাতে চান। সবাই মানুষকে ভেড়ার পাল মনে করেন, আর নিজেকে মনে করেন সর্বোত্তম রাখাল। আমার প্রয়োজন মতো, আমার নিজের মতো করে, আমি সবার কাছ থেকে শিখতে রাজি আছি। কিন্তু আমার শিক্ষক কে হবেন সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাকেই। নানা জায়গা থেকে আসা নানা জিনিস শেখার পরে আমি কী বুঝলাম, আমার করণীয় কী, সেটা নির্ধারণ করতে হবে আমাকেই। হৃদয়মন দিয়ে, এবং বিবেকবুদ্ধি, বিচারবুদ্ধি ও বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে কেননা আমার আল্লাহ্-ঈশ্বর-ইউনিভার্সই আমাকে এইসব সহজাত-অন্তর্জাত গুণাবলি দিয়েছেন।
ব্যক্তির স্বাধীনতাকে কোনো-না-কোনোভাবে কম গুরুত্ব দেয় এমন কোনো প্রকার বিশ্বাস, অবিশ্বাস, মতবাদ বা প্রতিষ্ঠানেরই অনুরাগী আমি নই। সব ধরনের মাজারেই দেখি ব্যক্তির চাইতে বড় কিছু-একটার উপাসনা, আরাধনা, এবাদত, বন্দনার জায়গা। ব্যক্তি সেখানে বড়ই তুচ্ছ। রাষ্ট্র, জাতীয় পতাকা, দেশপ্রেম, ধর্ম, নাস্তিকতা, বিজ্ঞান, শিক্ষা, কালচার, তমুদ্দুন ইত্যাদি সব ধরনের বিশ্বাস, অবিশ্বাস, মতবাদ এবং মতাদর্শের যে-প্রাধান্যশীল চেহারা আমরা দেখতে পাই তাতে দেখি সবচেয়ে মূল্যহীন ভাবা হয় ব্যক্তিকে। এদের অনুমান হলো, বিরাট বিরাট অট্টালিকায় ব্যক্তি হবে পরিচয়হীন ইটের গাঁথুনি মাত্র। বিরাট বিরাট কারখানায় ব্যক্তি হবে বড়োজোর নাট-বল্টু। সমাজ-অরণ্যে ব্যক্তি হবে পোকামাকড় মাত্র।
তাই বলে ওপরে যাদের নাম বলেছি সেইসব বিশ্বাস-অবিশ্বাসমূলক ধারণা ও প্রতিষ্ঠানের কোনোটার প্রতিই কোনো প্রকার বিদ্বেষ বা বিরাগ আমার নাই। তার প্রশ্নও ওঠে না। আল্লাহ্র দুনিয়ায় যাবতীয় কিছুর মধ্যেই সত্য এবং হকের অস্তিত্ব আমি দেখতে পাই। তিনি এক এবং অদ্বিতীয়, এবং তিনি সর্বত্র বিরাজমান — এই চরম সত্য আমি বিস্মৃত হতে পারি না। সত্য একই সাথে বহুবিচিত্র, অখণ্ড এবং সমগ্র। নিজের বিবেকবুদ্ধি ও বিচারবুদ্ধি দিয়ে জীবনের সামনে অথবা পেছনে এসে হাজির হওয়া প্রতিটা প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গকে কেস-বাই-কেস যাচাই-বাছাই, গ্রহণ-বর্জন করে সিদ্ধান্ত নিতে হয় মানুষকে, ব্যক্তিকে, আমাকে। কারো মহামূল্যবান মুখস্থ প্রেসক্রিপশনে আমার জীবন আমি দাঁড় করাতে পারি না।
আল্লাহ্ আমাকে সৃষ্টি করেছেন ব্যক্তি-মানুষ হিসেবে। হ্যাঁ, আমি সমাজে জন্মেছি, রাষ্ট্রের মধ্যে জন্মেছি। তাই বলে ব্যক্তিসত্তা বিসর্জন দিলে আমি সামাজিক মানুষ হিসেবে উন্নত হতে পারি না, রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে উন্নত হতে পারি না, স্বাধীনও থাকতে পারি না। আল্লাহ্ আমাকে সৃষ্টি করেছেন স্বাধীন, কৌতূহলী ও বুদ্ধিমান প্রাণি হিসেবে। আমাকে তিনি সৃষ্টি করেছেন দেখে, শুনে, পড়ে, বুঝে, চিন্তা করে, বিচার করে, এবং ঠেকে শেখার মতো গুণসম্পন্ন প্রাণি হিসেবে। স্থায়ী পদ-পদবি-উপাধি অথবা ইউনিফর্মওয়ালা কোনো মুরুব্বির হুকুমতন্ত্র ছাড়াই মানুষ নিজে নিজে শিক্ষা অর্জন করতে পারে।
আল্লাহ্, ঈশ্বর, মা-প্রকৃতি, বিশ্বজগত, ইউনিভার্স বা পরম সত্তা ইত্যাদি যে-নামেই ডাকেন না কেন, আমি আমার আল্লাহ্কে জানতে-চিনতে-বুঝতে এবং আত্মস্থ করতে চাই সবার আগে ব্যক্তিগতভাবে। তাঁর সমস্ত রূপময় এবং অরূপময় অভিপ্রকাশের মধ্যদিয়ে। নিজের মতো করে, নিজের স্ব-অধীনতার চৈতন্য বজায় রেখেও নিজেকে সমর্পণ করতে চাই নিখিল অস্তিত্বের কাছে। হাশরের মাঠে আমার জবাব তো আমাকেই দিতে হবে। কোনো প্রকারের মাজার, পরিবার, সমাজ, কওম, রাষ্ট্র, জাতীয় পতাকা অথবা সৈন্যবাহিনী আমার তরফ থেকে আমার জবাবদিহি করার জন্য সেদিন অনুমোদন পাবে না। ফলে আমার স্রষ্টার সাথে আমার বোঝাপড়া আমারই একান্ত ব্যক্তিগত। একান্ত আধ্যাত্মিক। আমি নানান ব্যক্তির কাছ থেকে, সমাজ-সংসার-প্রতিষ্ঠান থেকে নানান কিছু শিখতে পারি, বুঝতে পারি, জানতে চাইতে পারি, কিন্তু দিনশেষে আমার পরম করুণাময়ের সামনে আমার মনুষ্যধর্ম রক্ষা করতে হয় আমাকেই।
.চার॥
যতদিন এই জীব-জীবনের গভীর থেকে ব্যক্তির আত্মার আত্মশক্তি জেগে না উঠছে, ততদিন যত শেখা বুলিই আওড়াক না কেন, মানুষ হয়ে ওঠার পথ থেকে পিছিয়ে থাকবে সে। আল্লাহ্, ঈশ্বর বা ইউনিভার্সের পরম শক্তিতে শক্তিশালী হয়ে ওঠা বিনম্র ব্যক্তির আত্মপ্রকাশ যত দিন না ঘটছে, ততদিন সমাজ চলবে মব-উত্তেজনায়। রাষ্ট্র চলবে স্রেফ জিন্দাবাদ-মুর্দাবাদ দিয়ে। তা ছাড়া, মবও তো বিভিন্ন রকম হতে পারে বৈকি। পরিবার, বংশ, গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক মঞ্চ, এমনকি সুমহান আইনশৃঙ্খলা-বাহিনীও মব হয়ে উঠতে পারে তো! পুলিশের যে-বাহিনী আমাদের সন্তান-ভাই-বোনদের লাশ ভ্যানের উপর গাদি করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে জুলাই বিপ্লবের দিনগুলোতে, তারা কি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, নাকি মব? কথা হলো, সমাজে যত বেশি করে ব্যক্তির দেখা আমরা পাব, ততই সর্ব প্রকারের মবগিরির আপদ-বিপদ-উৎপাত কমবে। অন্য কোনো উপায় নাই। পালের অথবা মবের ভেতরের অবিকশিত জন্তুসত্তাকে আপনি শুধু আইনকানুন দিয়ে, ধরে-মেরে-পিটে, আটকাতে পারবেন না। আমাদের লাগবে মানুষের ভেতরে মনুষ্যসত্তার ব্যক্তিগত মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলা, এবং শুধু বৈষয়িক-জাগতিক ধার্মিকতাই নয়, আমাদের লাগবে মানুষের ভেতরে আধ্যাত্মিক ধর্মসত্তারও উন্মেষ ঘটানো।
এ জন্যই ব্যক্তিকে ভয় পান সবাই। মা-বাবা চান তাঁদের সন্তান যেন বাধ্য সন্তান হয়েই থাকে, ব্যক্তি হয়ে না ওঠে। মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ওস্তাদ-হুজুরেরা চান তাঁদের শিক্ষার্থীরা যেন নিতান্ত শিক্ষার্থী হয়েই থাকে, ব্যক্তি হয়ে না ওঠে। রাজনৈতিক দলের নেতারা চান তাঁদের সদস্যরা যেন স্রেফ রাজনৈতিক কর্মী বা কামলা হয়েই থাকে, ব্যক্তি হয়ে না ওঠে। রাষ্ট্রনেতা-রাষ্ট্রপতিরা চান দেশের মানুষ যেন শুধু আইনকানুন-জানা ভদ্র নাগরিক হয়েই থাকে, ব্যক্তি হয়ে না ওঠে। ব্যক্তি বিপজ্জনক, কেননা ব্যক্তি তার বন্ধুদের সাথে চলাফেরা করতে পারে কিন্তু পালবদ্ধ হয়ে প্যারেড করতে পারে না। মব হচ্ছে পাল। নিরীহ ভেড়ার পাল অথবা হিংস্র হায়নার পাল হয়ে চলতে পারে না ব্যক্তি। তাঁর আত্মমর্যাদায় বাধে। পালের সবচাইতে বড় উদাহরণ কিন্তু পলিটিক্যাল পার্টি।
আমাদের গরিব দেশের জন-ইতিহাসে যখন ব্যক্তির আধ্যাত্মিক স্ব-অধীনতার আবির্ভাব ঘটতে শুরু করবে তখন আর কোনো পাল, পার্টি বা জাতীয় পতাকাই মানুষের চেয়ে বড়ো হতে পারবে না। আল্লাহ্, ঈশ্বর বা ইউনিভার্স ছাড়া আর কারো সামনেই মাথা নোয়াবে না সে। এই জন্যেই আমার আল্লাহ্ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন ব্যক্তি-মানুষ হিসেবে, সরাসরি তাঁর নিজের খলিফা হিসেবে। কোনো দেশ, রাষ্ট্র, সমাজ, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, জাতীয় পতাকা, অথবা কোনো চার্চতন্ত্র, ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র, যাজকতন্ত্র অথবা হুজুরতন্ত্রের গোলাম হিসেবে নয়।
.পাঁচ॥
মাদ্রাসা আমাদের, মসজিদ আমাদের। মাজারও আমাদেরই। বাংলার সমাজ চিরকাল বহুমত-বহুপথকে একই সাথে ধারণ করেছে। ফেতনা-ফ্যাসাদ ও বিভেদ-বিভক্তি তো ফ্যাসিবাদের ধর্ম। মানুষের ধর্ম হলো জুলাই বিপ্লবের লড়াইয়ের ধর্ম। বিভিন্ন মত-পথের অন্তর্ভুক্তিমূলক ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম, স্বপ্ন ও আত্মাহুতির ধর্ম। এবারের জুলাইয়ে তো আশুরাও ছিল। আর চব্বিশের আশুরাতে ঝরেছিল মানুষের খুন। রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের দিনগুলোতে কেউ কারো বিশ্বাস-অবিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন তোলে নি। ফ্যাসিবাদী বাহিনীর গুলিতে জখম মানুষের দেহ থেকে বেরিয়ে এসেছিল রক্ত। এবং তার রঙ ছিল রক্তিম লাল। সর্বাত্মক একনায়ক হাসিনা যতদিন আমাদেরকে আমাদের মত-পথ-আদর্শ, বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের প্রশ্নে পৃথক করে রাখতে পেরেছিল, ততদিনই ছিল তার ফ্যাসিবাদের আয়ু। তারপর যেদিন শাহবাগের সাথে দেখা হলো শাপলার, সেই দিনটাই তো ছিল হাসিনা-শাহীর পতনের দিন।
জুলাই-শ্রাবণে আমাদের ঐক্য তৈরি হয়েছিল পথে। বিপ্লবের বৃষ্টিতে আমরা ভিজেছিলাম সবাই। মসজিদ-মাদ্রাসা-মাজারের মতপার্থক্য আত্মস্থ ও অতিক্রম করে আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে জুলাই বিপ্লবের পথ ধরে। সেই পথ গেছে ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্রের জাগতিক স্বাধীনতা এবং আধ্যাত্মিক মুক্তির পথে।