হাসিনা পালিয়ে গেলেও ১৬ বছর ধরে তার কুকুর্মের বেশিরভাগ সাথীই এদেশে রয়ে গেছে। এদের কেউ কেউ ধরা পড়ছে। আওয়ামী রাঘববোয়ালদের ধরা পড়ায় দেশবাসী উল্লাস করছে। তবে কিছুটা ব্যতিক্রম দেখা গেলো এক সময়ের আওয়ামী মন্ত্রী এবং বেশ কয়েকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া আসাদুজ্জামান নুরের বেলায়।
নুর বাংলাদেশের নাটকের ইতিহাসে অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র। টেলিভিশন নাটকে অন্যতম সেরা এই অভিনেতা এই দেশের বহু মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন দারুন অভিনয় দিয়ে। হুমায়ুন আহমেদ রচিত কোথাও কেউ নেই নাটকে বাকের ভাই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি আর সেই চরিত্র এতোটাই দাগ কেটেছিলো যে, বাকেরের ফাঁসি আটকানোর জন্য মানুষ রাস্তায় মিছিল করেছিলো।
অভিনয় ছাড়াও, আবৃত্তি করতেন নূর। কথা বলতেন গুছিয়ে। সব মিলিয়ে নূরের যে প্রতিচ্ছব্বি তা দেশের একটা বড় অংশের মানুষের কাছে খুবই পরিশীলিত। সে কারণে নুরকে যখন গ্রেফতার করা হয় আর দশজন আওয়ামী গুন্ডার পরিণতির মতো উল্লসিত না হয়ে কেউ কেউ মন খারাপ করেন। হয়তো ভাবেন, একজন পছন্দের মানুষ, গুণী মানুষ গ্রেফতার হলো।
অথচ, নুরের এই চেহারাটা তার চরিত্রের একদিক মাত্র। অনেকটা রবার্ট লুইস স্টিভেনসনের অমর উপন্যাস ডক্টর জেকিল এন্ড মিস্টার হাইডের মতো। ভালো মানুষ জেকিলের কুৎসিত একটা রূপ দানব হাইড। আর দশটা আওয়ামী দানবের মতো নূরও খুনি ছিলো।
এমপি থাকাকালীন তার গাড়িবহরে হামলার শোধ নিতে নূরের নির্দেশে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হত্যা করা হয়। শুধু তাই না, নুরের প্রতিষ্ঠান এশিয়াটিক ক্ষমতার জোরে বড় বড় কাজ বাগিয়ে নেয়, লাভ করে কোটি কোটি টাকা।
শুধু তাই না, নুরদের সবচেয়ে বড় প্রভাব ছিলো নিজেদের সুশীল সত্তা কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগের অবাধ হত্যাকান্ড আর লুটপাটকে বৈধতা দেয়া। বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী ও বিরোধিতাকারীদের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি, সংস্কৃতিবিরোধী ইত্যাদি তকমা দিয়ে তাদের দমন করার সম্মতি উৎপাদন করতো নুর এবং তার সাংস্কৃতিক সহযোগীরা।
এইখানেই আওয়ামী লীগের একটা বড় শক্তি ছিলো। আওয়ামী লীগ আমলের কথা মনে হলে হয়তো শামীম ওসমানের মতো, শাহীন চাকলাদারের মতো অস্ত্রধারী খুনিদের ত্রাসের কথা মনে পড়বে, র্যাব আর পুলিশের অসংখ্যা খুন আর আয়নাঘরের কথা মনে পড়বে, কিন্তু নুরদের সফট পাওয়ার আওয়ামী লীগের বড় শক্তি। এতো খুন, এতো অত্যাচারের পরেও নুরকে নিয়ে অনেক সাধারণ মানুষের মমত্ববোধ তা আবার প্রমাণ দেয়।
আওয়ামী লীগ এতোটাই বেপরোয়া হয়ে গেছিলো যে একসময় ওরা নিজেরাও আর সফট পাওয়ারের চর্চা করে নাই। দেশে শিল্প সংস্কৃতি এতোটাই ধংস করে ফেলেছে যে, জনমতে প্রভাব রাখার মতো শিল্পীও তৈরি হয় নাই। ক্যারিয়ারের গোধূলি লগ্নে থাকা রিয়াজ-ফেরদৌসরা চেষ্টা করতে গিয়ে হাসির পাত্র হয়েছে। বরং বৃদ্ধ নূরের প্রভাব অনেক বেশি।
সফট পাওয়ার কি মারাত্মক যে, ৩০ বছর আগের বাকের ভাই ঢেকে দিতে পারেন একজন ভয়ংকর খুনিকে, একজন মাফিয়াকে যে কিনা নিজের ক্ষমতা দিয়ে শামীম ওসমানদের চেয়েও অনেকগুণে ব্যবসা করেছে, নিজের প্রতিষ্ঠানকে মনোপলি বানিয়েছে।
আওয়ামী লীগ এই ডাবল ফেসটা রাখতে জানতো। তারা জানতো, এই দেশের মানুষের খুব বেশি তলায় দেখার অভ্যাস নাই, সুযোগ নাই, এবং এদের ম্যানুপুলেট করা ইজি। তাই ভালোমানুষ বাকেররা আড়ালে খুনে নুরই কেবল হতো না, রীতিমতো নিজেদের দেবত্ব উপভোগ করতো।
অথচ এই জায়গায় বিএনপি যেন ঠিক বিপরীত। গত ১৭ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটা গণতন্ত্র উদ্ধারে লড়াই করলো, শত শত নেতাকর্মী জীবন দিলেন, লাখো লাখো কর্মীরা ভয়ের জীবন কাটালেন। এতো অত্যাচারেও বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুলের মতো মানুষ গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা হারাননি, ভদ্রতাবোধও না। তবুও তিনি ও তার দল সুশীলদের মন পাননি। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল জামায়াতের সঙ্গ ছাড়লেও তাদের সঙ্গেই এক নিশ্বাসে উচ্চারিত হয় বিএনপির নাম, যদিও আওয়ামী লীগ অতীতে বহুবার জামাতের সাথে হাত মিলিয়েছে।
আর তাই দেখা যাচ্ছে, সরকার পতনের পর সুশীল সমাজ থেকে বিএনপি ঠেকাও সুর উচ্চারিত হচ্ছে। বিএনপি যাতে ক্ষমতায় না আসতে পারে সেজন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আজীবনের জন্যও কেউ কেউ ক্ষমতায় দেখতে চাইছেন। এর জন্য নির্বাচন, গণতন্ত্র এসব বিসর্জন দিতে হলেও।
এর বড় একটা কারণ আওয়ামী লীগের মতো বিএনপির সফট পাওয়ার নাই। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে, মিডিয়া জগতে আধিপত্য নাই। সফট পাওয়ার ছাড়া যতোই জনপ্রিয়তা থাক, ক্ষমতায় আরোহণ করা, ক্ষমতাকে সুসংহত করা কঠিন।
গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার লড়াইয়ে বিএনপির সফট পাওয়ার লাগবে। বাকের ভাইদের লাগবে। আওয়ামী লীগের মতো সুশীল সমাজের সমর্থন যোগাড় করতে হবে। শক্তিশালী মিডিয়া তৈরী করতে হবে। এইসব শক্তি থাকলেই বিএনপি ক্ষমতায় যেতে পারবে। তবে, পার্থক্য হচ্ছে, বিএনপির লক্ষ্য থাকা উচিত এই শক্তিগুলো দিয়ে গণতন্ত্র, দেশ ও জনগণকে রক্ষা করা।
আর, এইসব শক্তি অর্জন করতে না পারলে আওয়ামী লীগ এর জোরে আবারও শক্তিশালী হয়ে দেশের সর্বনাশ করে ফেলবে।