ভাষা আন্দোলনে (১৯৫২) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের মিছিল। ছবি : সংগৃহীত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের বাতিঘর। বছরের পর বছর ক্ষমতাসীন দলগুলোর নানারকম অপচর্চার আঘাতে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এখনো এর আত্মা যে মারা যায়নি তার প্রমাণ পাওয়া গেলো হাসিনা পতনের আন্দোলনেও। আবারও এই বিশ্ববিদ্যালয়, শহীদ মিনার হয়ে উঠলো আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। এখান থেকে ওঠা এক দফার আওয়াজে পালালো হাসিনা।
তবে, এইবার কেন্দ্র হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ভূমিকা অন্যন্য গণঅভুথানের তুলনায় কিছুটা ম্লান। হাসিনার গুন্ডা বাহিনী আর পুলিশ মিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বন্ধ করে আন্দোলনকে অনেকটাই দমিয়ে ফেলেছিলো। তবে আশ্চর্য সাহস নিয়ে প্রতিবাদ করে ওঠে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সহ স্কুল-কলেজের ছাত্ররা। আর সাঈদ-মুগ্ধদের সাথে যোগ দেয় দেশের আপামর জনসাধারণ। আন্দোলন ধরে রাখার সেই মরনপণ লড়াইয়ের সুফল পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
শুধু কি তাই? আন্দোলনের পর দেশের একটা অংশে প্রলয়ঙ্করী বন্যার সময় একজোট হয়ে বন্যার্তদের সাহায্যে এগিয়ে এলো দেশের আপামর জনসাধারণ। আর সেই কর্মকান্ডেও আবার কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করার সুযোগ পেলো ঢাবি। দেশের মানুষ অকাতরে দান করলো টিএসসিকেন্দ্রিক ত্রাণ ভান্ডারে।
কিন্তু, এরপরই যেন এইসব অবদান ভুলে ঢাবির ভেতর একধরনের আলাদা হবার বাসনা জেগে উঠলো। টিএসসির দোকান উঠিয়ে দেয়া থেকে শুরু করে, বহিরাগত কমানোর আওয়াজ উঠতে লাগলো। ‘আমাদের ক্যাম্পাস আমরাই বুঝবো’ ধরনের স্লোগান উঠলো। অথচ, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় খরচ আসে সরকার তথা জণগণের কষ্টার্জিত উপার্জনের অর্থ থেকেই।
শুধু কি তাই? ঐতিহাসিকভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই জনপদের একটা আশা ও গৌরবের প্রতীক। পূর্ব বাংলার গরিব মুসলমান কৃষকের টাকায় কলকাতা শহর আর এর বনেদিয়ানা গড়ে উঠলেও এই অঞ্চলের মুসলমান চাষার সন্তানদের উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ ছিলো না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেই অভাব পূরণ করে পিছিয়ে থাকা মানুষদের জন্য দারুণ এক আশার সঞ্চার করে। স্বাভাবিকভাবেই, কেবল পড়ালেখা নয়, এই অঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন আর দায়িত্ব ধারণ করে বলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বারবার মানুষের আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। জনতার টাকায় গড়া, জনতার স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠতে চাইছে। বিশ্ব র্যাংকিং ব্যবস্থায়, এর অবস্থান যাই হোক না কেন, এখনও এই দেশের গরিব মেহনতি মানুষের আশার বাতিঘর হয়ে টিকে আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। একজন দরিদ্র কৃষক কিংবা রিকশাওয়ালা এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে তার সন্তানকে হয়তো দেখিয়ে বলেন, এই দারুণ বিদ্যাপীঠ তোমাকে মানুষের সম্মান দেবে, মুক্ত করবে দারিদ্র্য আর অশিক্ষার গ্লানি থেকে।
ঢাকার কেন্দ্রে হওয়াতে এমনিতেই ঢাবির পক্ষে ‘বহিরাগত’ আটকানো অসম্ভব। মেট্রোরেলের স্টেশন থেকে শুরু করে ঢাকা মেডিকেল, শহীদ মিনারসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা এর বুকে অবস্থিত। কিন্তু, এর বাইরেও ঢাবিকে এর আত্মা বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
আমরা সব স্বৈরাচারের আমলেই দেখেছি ঢাবিকে কলুষিত করার। সেসবের প্রভাবে এখানকার ছাত্রছাত্রীরা তিতিবিরক্ত হয়ে হয়তো নব উদারতাবাদের অনুপ্রেরণায় নিজেদের ‘আলাদা’ করার একধরনের গোষ্ঠী শ্রেষ্ঠত্ব অনুভব করতেই পারেন, কিন্তু দেশের সেরা মেধাবীদের বুঝতে হবে যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব আর অস্তিত্ব এর গণচরিত্রে। তা নষ্ট হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব থাকবে না।