আগস্ট বিপ্লবের বিরুদ্ধে স্লিপার সেল এর প্রতিবিপ্লবীরা সক্রিয় সুতরাং সাবধান
যারা গোয়েন্দা বিষয়ক ব্যাপারগুলো জানেন, তাদের কাছে ‘স্লিপার সেল’ শব্দটি খুব অপরিচিত নয়। বর্তমান পৃথিবীতে ‘স্লিপার সেল’ এর দুটো ভাগ আছে। একটা হলো ‘হার্ড’ যা সাধারণ যুদ্ধকালের শেষ সময়ে ব্যবহার হয়। অন্যটি ‘সফ্ট’ যা প্রোপাগান্ডা করতে ব্যবহার করা হয় এবং তাও শেষ সময়ে, সবকিছু ব্যর্থ হলে। আমরাও বর্তমানে এই ‘সফ্ট’ স্লিপার সেল এর কার্যক্রম দেখছি অনলাইনে। এর আগে তাদের সব প্রোপাগান্ডা ব্যর্থ হয়েছে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের কাছে। বলতে পারেন দৃশ্যত পরাভূত হয়েছে। এখন তারা তাদের শেষ চেষ্টা চালাচ্ছে এই স্লিপার সেল এর মাধ্যমে। সিপি গ্যাং পতিত স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে দারুণভাবে মার খেয়েছে এবং তা অনেক আগেই। তারপর মাঠে নেমেছিলো সিআরআরআই আরাফাতের নেতৃত্ব। তারা খুব খারাপ করছিলো তা বলা যাবে না। ‘বট’ এর কনসেপ্ট তারাই তৈরি করেছিলো এবং তার সফল প্রয়োগ করেছিলো তারা। ফেসবুকের কমেন্ট সেকশনে এখনো তার প্রমাণ রয়ে গেছে। এছাড়াও রয়েছে ভুয়া বিশেষজ্ঞ সৃষ্টির বিষয়টি। কদরুদ্দিন শিশির প্রমাণ করেছেন যে, বেশ কিছু ভুয়া বিশেষজ্ঞ সৃষ্টি করা হয়েছিলো প্রোপাগান্ডা করতে। ডরিন চৌধুরী তো এক্ষেত্রে একটা বিখ্যাত নাম। ভারতের এক অখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনারের ছবি দিয়ে তৈরি করা হয়েছিলো বিশেষজ্ঞ ডরিন চৌধুরী নামের চরিত্রটি। যে চরিত্র প্রবন্ধ ফেঁদেছিলো পতিত স্বৈরাচারের পক্ষে, তার উন্নয়নের আলাপে। কিন্তু সেসবও ধোপে টেকেনি এবং স্বৈরাচার পরাজিত হয়েছে। শুধু পরাজিত নয়, পালিয়েও গেছে।
বুঝলাম, স্বৈরাচার পালিয়ে গেছে, কিন্তু তার অবতাররা কি সব পালিয়েছে? না, পালায়নি। তারা ঘাপটি মেরে আছে নানান জায়গায়। বিশেষ করে তাদের সফ্ট পাওয়ার, বুদ্ধিবৃত্তিক শাখা এখনো রয়ে গেছে। স্টেট এর ভেতর যেমন ডিপ স্টেট থাকে, সেই বুদ্ধিবৃত্তিক শাখার মধ্যেই রয়েছে গেছে সেই ‘ডিপ স্টেট’ যাকে বলা হয় ‘সফ্ট স্লিপার সেল’। একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন এরা কারা। মনে হবে, এই তো কদিন আগেই তারা স্বৈরাচারের বিপক্ষে বলছিলো, হঠাৎ করেই তারা কেন আবার বিপ্লবের বিরোধিতা করতে শুরু করেছেন। স্লিপার সেল এর কাজই তাই। বলতে পারেন, প্রশ্ন তোলা তো গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত। একদম ঠিক। প্রশ্ন তুলতেই হবে। কিন্তু প্রশ্ন তুলতে গিয়ে যখন আপনি বলবেন, ‘আগেই তো ভালো ছিল’ তখন আপনার সেটা প্রশ্ন থাকবে না, হয়ে যাবে স্বৈরাচারকে জাস্টিফাই করার আলাপ।
বলতে পারেন, তবে কি মব এর বিরোধিতা করা যাবে না? অবশ্যই যাবে। এই যেমন মাজার ভাঙা হচ্ছে, এর বিরোধিতা করতে হবে। একটা অংশীদারিত্ব মূলক রাষ্ট্রে সবার বাস থাকবে। সেটা কারো ভালো লাগুক আর নাই লাগুক। যারা মাজার ভাঙছে তারা সুফিইজম সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তারা জানেন না এই ভূখণ্ডে ইসলাম প্রচারের মূলেই ছিল ফকির-দরবেশগণ। এটা যারা জানেন না, তারাই মাজার ভাঙার সাথে জড়িত। কিন্তু যারা জানেন, তারা কেন শুধু ‘গেল গেল’ বলে চিৎকার করছেন। অথচ তাদের উচিত ছিল মানুষকে জানানো, কীভাবে এদেশে মুসলিম ধর্মের প্রবর্তন হলো। কাদের হাত ধরে এদেশের মানুষ ইসলামের আহ্বানে সাড়া দিলো। তা না করে তারা কী করছেন, ‘গেল গেল’ মাতম করছেন। দোষ দিচ্ছেন বিপ্লবীদের। বলছেন, ‘এই স্বাধীনতাই কি আমরা চেয়েছিলাম’।
আমার পরিচিত, বলতে পারেন বন্ধুজন, বাংলা একাডেমির এক কর্মকর্তা। যিনি নিয়োগ পেয়েছিলেন স্বৈরাচারের সময়ে। সামাজিকমাধ্যমে তিনি ইদানীং ভয়াবহ রকম বিপ্লবী হয়েছেন। কথায় কথায় প্রশ্ন তুলছেন নানান কিছু নিয়ে। আর সেই সকল প্রশ্ন সবই বিপ্লবের বিরুদ্ধে। অথচ তিনি একবারও চিন্তা করেননি, আমরা যারা আছি, তারা এমন প্রশ্ন তার প্রিয় স্বৈরাচারের সময় তুলতে পেরেছি কিনা। তিনি একবারও ভাবেননি, এমন প্রশ্ন যদি স্বৈরাচারী রেজিমে তোলা যেত তাহলে পরিণতি কী হতো। অথচ তিনি এখন প্রশ্ন তুলছেন পরিণতির সেই ভয় ছাড়াই। এরচেয়ে বড় পরিবর্তন আর কী হতে পারে। মানুষের বাকস্বাধীনতা, মানুষের দাবি তোলার অধিকার সবকিছুই তো ৫ আগস্টের আগে নিষিদ্ধ ছিল। যারা তুলতেন তাদের গুম করা হতো আয়না ঘরে কিংবা খুন করা হতো। তিনি তুলতে পারছেন গুম-খুনের ভয় ছাড়াই। মিনিমাম হামলা-মামলার ভয় ছাড়াই। ড. ইউনুস বলছেন, প্রাণ খুলে তাদের সমালোচনা করতে। অথচ বিগত ফ্যাসিস্ট রেজিমে তেলাঞ্জলি ছাড়া আর কিছুই প্রযোজ্য ছিল না। ‘দাবি নয় প্রশংসা করতে এসেছি’ ফ্যাসিস্ট রেজিমে এই নীতিই চালু ছিল।
যারা প্রশ্ন তুলছেন বিপ্লবের বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে, তাদের মনে করিয়ে দিই ‘রিঅ্যাকশন ফোর্স’ এর কথা। আপনি বন্দুক থেকে গুলি ছুড়লে আপনার কাঁধে ধাক্কা লাগবে। কিন্তু বন্দুকের গুলি একজনকে খুন করলেও, রিঅ্যাকশন ফোর্স আপনাকে খুন করবে না। বিপ্লব হলো তাই। বিপ্লবে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী রেজিমের পতন ঘটেছে। পালিয়েছেন স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা। বিপ্লব হলো সেই গুলি, যা স্বৈরাচারকে খতম করেছে। আর এখন যা ঘটছে তা হলো ‘রিঅ্যাকশন ফোর্স’। এই রিঅ্যাকশন ফোর্স এর দরুন হয়তো আপনি সামান্য ধাক্কা খাবেন, কিন্তু স্বৈরাচার রেজিম যে ক্ষতি করেছে, করতো অর্থাৎ আপনাকে দৈহিক বা মানসিকভাবে হত্যা করা, তার কোনোটাই ঘটবে না।
প্রতিটি বিপ্লবের পরই প্রতিবিপ্লবের চেষ্টা হয়। রিঅ্যাকশন ফোর্স হচ্ছে প্রতিবিপ্লব। এই যে মাজার ভাঙা হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে লুটপাট হচ্ছে। চাঁদাবাজির বিষয়টাও রয়েছে। আর সামাজিকমাধ্যমে নানান বিষয়ে প্রশ্ন তোলাও তাই। এসব সকলই প্রতিবিপ্লবের চেষ্টা। আপনারা যদি লক্ষ্য করেন তাহলে দেখবেন, এই সব কর্মকাণ্ডের কারণে আড়ালে থেকে যাচ্ছে রাঘব-বোয়ালদের গ্রেপ্তার এবং বিচারের দাবি। আমরা হাতেগোনা কয়েকজনকে মাত্র গ্রেপ্তার হতে দেখেছি। কিন্তু বাকিরা এখনো সব আড়ালে। আমরা মাজার যারা ভাঙছে তাদের প্রতিরোধে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি এবং তা সংগত কারণেই। যেহেতু আমরা একটা ইনক্লুসিভ রাষ্ট্র গড়তে চাই। অংশীদারিত্ব মূলক রাষ্ট্র গড়ার ক্ষেত্রে এই বিভেদ সৃষ্টির পাঁয়তারা একটা বাধা। সুতরাং বাধ্য হয়েই আমাদের এ ব্যাপারে তৎপর হতে হচ্ছে। অথচ আমাদের এখন তৎপর হওয়া প্রয়োজন ছিল ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত যারা রাজপথে ছাত্র-জনতার উপর সশস্ত্র হামলা চালিয়েছিলো তাদের গ্রেপ্তার দাবিতে। এই যে স্বৈরাচারের মদদপুষ্ট লোকদের হাতে প্রকাশ্যে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র দেখা গেছে সেই সব অস্ত্র উদ্ধারের দাবিতে আমাদের তৎপর থাকার কথা ছিল। সাথে কথা ছিল হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটকারীদের গ্রেপ্তারে এবং বিচারের মুখোমুখি করার দাবিতে সোচ্চার হওয়ার। কথা ছিল শহীদদের তালিকা প্রস্তুত করা এবং তাদের পরিবারের পাশে থাকার। কিন্তু আমরা কি তা পারছি? পারছি না। ওই যে প্রথমে স্লিপার সেল দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেই স্লিপার সেল এর তৎপরতার কারণে। তারা বিভিন্ন ভাবে আমাদের চিন্তাগুলোকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছে, আমাদের কাজের ধারাকে বিঘ্নিত করার চেষ্টা করছে। অথচ আমাদের অনেকেই সেই স্লিপার সেলের ফাঁদে পা দিচ্ছেন। তারাও না বুঝে কথা তুলছেন স্লিপার সেল এর স্বৈরাচারের মদতপুষ্টদের মত।
জিন্নাহ’র জন্মদিন পালন করা নিয়ে কথা উঠেছে। এটা নিয়ে কথা বলার আগে আমি আমার পিতার একটা কথা আপনাদের বলি। আমার পিতা সবসময় বলতেন, ‘অতিবিপ্লবী মানেই প্রতিবিপ্লবী’। এই যে জিন্নাহর জন্মদিন যারা পালন করছেন, তারাও সেই প্রতিবিপ্লবী, সেই স্লিপার সেল এর অংশ। একটা মিছিলকে কীভাবে মবে পরিণত করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করলেও প্রতিবিপ্লবের ব্যাপারটা খোলাসা হয়ে যাবে। একটা প্রতিবাদী মিছিলে কয়েকজন প্রশিক্ষিত লোক ঢুকিয়ে দিন। সেই লোকরা হঠাৎ করেই পাথর ছোড়া শুরু করবেন, দেখবেন মিছিলের অনেকেই তাদের সাথে পাথর ছুড়তে শুরু করবে। ফলে একটা প্রতিবাদী মিছিল পরিণত হবে মবে। বিপরীত দিক থেকেও হতে পারে। একটা মিছিল আসছে, স্লোগান দিচ্ছে এমন সময় একজন উৎসাহী পুলিশ তাতে গুলি ছুড়লেন, ফলে প্রতিবাদী মিছিল পরিণত হলো মবে। জিন্নাহর জন্মদিন পালনও ঠিক তাই। অতিবিপ্লবের ধারণা প্রসূত।
যখন মানুষ ঐক্যের কথা বলছে, তখন পুরানো একটা বিষয়কে টেনে এনে সেই ঐক্যকে বিনষ্ট করার প্রচেষ্টা শুধু স্লিপার সেল এর পক্ষেই সম্ভব। বুঝলাম তারা ১৯৪৭ এর বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছেন। তারা বলতে চাচ্ছেন ১৯৪৭ না হলে ১৯৭১ হতো না। ভালো কথা বলবেন, কিন্তু প্রতিটা কথা বলার একটা উপযুক্ত সময় রয়েছে, এখন কি সেই উপযুক্ত সময়? যখন বিপ্লবের রেশ কাটেনি, বিপ্লবের কার্যক্রম চলমান, তখন তাকে বাধাগ্রস্ত করতে কেন এমন কথা তোলা! এখন সব কথাই বলতে হবে মেপে। মনে রাখতে হবে, এই বিপ্লব যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয় কোনো কথাতেই।
আরেকজনের কথা বলি। যাকে নিয়ে অনেকেই লিখতে বলেছেন। তিনি হলেন সৈয়দ জামিল আহমেদ। জ্ঞানী মানুষ, শিল্পকলা একাডেমির প্রধান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। অথচ তিনিও না বুঝে এমন একটা কথা বললেন, যখন সে কথা বলার সময় নয়। এবং তার বলা কথার বিপক্ষেও শক্তিশালী বক্তব্য রয়েছে, যা তার কথাকে নিমেষেই খণ্ডন করতে পারে। জানি, তার মূল বক্তব্যের একটা অংশ সে কথা। কিন্তু যে অংশটি এ সময়ে বিতর্ক তৈরি করতে পারে, তার পাওয়া পদটাকেও বিতর্কিত করতে পারে তখন কেন সে কথা বলা। এমন কথা বললে তো তাকেও স্লিপার সেল এর অংশ হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে এবং তা বাধ্য হয়েই। যদিও তিনি বলেছিলেন, ‘ওয়াজও আমাদের সংস্কৃতি’ এমন কথা।
শেষ কথায় বলি, বিপ্লবকালীন সময় এখন, বিপ্লব শেষ হয়নি। স্বৈরাচারী রেজিমের পুচ্ছদেশ এখনও রয়ে গেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত এই পুচ্ছ না কাটা হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত বিপ্লব শেষ হবে না। এই সময়ে আমাদের যেমন স্লিপার সেল সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে, তেমনি নিজেরা কথা বলার সময়ও সতর্ক থাকতে হবে যাতে সেসব কথা ইনক্লুসিভ রাষ্ট্র গড়ার পথে অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায়।