Logo
Logo
×

অভিমত

লাশকাটা ঘর, সাংবাদিক প্রিয়র লাশ ও জুলাই আন্দোলনের স্মৃতি

Icon

আসিফ বিন আনোয়ার

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:১৬ পিএম

লাশকাটা ঘর, সাংবাদিক প্রিয়র লাশ ও জুলাই আন্দোলনের স্মৃতি

সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়।

একটা একতলা বন্ধ ঘর। সামনে লেখা ‘মরচুয়ারি’। তার পাশেই আরেকটা বিচ্ছিন্ন একতলা ছোট ঘরের সামনে মানুষ ঠেলাঠেলি করছে। মরচুয়ারি’র অফিস। তিন-চারজন আনসার সদস্য ভিড় সামলাচ্ছে। কোনরকমে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখি একটা সরু টেবিল সামনে নিয়ে একটা বেঞ্চে দু’ তিনজন কর্মচারী বসে আছেন। তাদেরকে আপাদমস্তক ঘিরে রেখেছে জনা বিশেক মানুষ। সবাই টেবিলের উপরে ঝুঁকে আছে। ঝুঁকেই আছে। সরে গিয়ে কাউকে জায়গা দিচ্ছে না। বোঝাই যাচ্ছে এখানে শৃঙ্খলা বলে কিছু নেই। কিন্তু বিশৃঙ্খল অবস্থায় যেরকম হট্টগোল হবার কথা, তার বদলে একটা অস্বস্তিকর নিরব ধীরতা। 

২০ জুলাই সকাল বেলা। তখন সাড়ে এগারোটার মত বাজে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মরচুয়ারির এই অফিসে আমরা প্রিয়’র খোঁজে এসেছি। প্রিয় আমার স্ত্রীর ভাগ্নে। ওঁর (আমার স্ত্রী’র) ফুপাতো বোন কলি আপুর ছেলে। আঠাশ-ঊনত্রিশ বছর বয়স। একটা অনলাইন নিউজ পোর্টালে সাংবাদিকতা করত। ছিপছিপে গড়ন। মুখে সবসময় একটা লাজুক হাসি ধরে রাখত। ছাত্রত্ব ঘুচেছে বেশিদিন হয়নি। ছাত্র-আন্দোলনেও সে জড়িয়ে পড়েছিল। আগেরদিন রাত দশটার দিক থেকে বিচ্ছিন্ন খবর আসতে লাগলো সম্ভবত গুলি লেগেছে প্রিয়’র। কিছুক্ষণ পর জানা গেল প্রিয় আর নেই। গুলিবিদ্ধ মৃতদেহটা পুলিশ নিয়ে গেছে। খবর পেলাম ধানমন্ডি’র ল্যাব এইডের সামনে ঘটেছে এই ঘটনা। কেউ কেউ বলল সেন্ট্রাল, ল্যাবএইড আর পপুলার হাসপাতালে খোঁজ নিতে। পুলিশ নাকি লাশ আগে কাছের হাসপাতালগুলোতে নিয়ে যাচ্ছে। 

১৯ তারিখ রাত ১২টা থেকে কারফিউ শুরু। দু’দিন ধরে বন্ধ আছে ইন্টারনেট। হাসপাতালগুলো থেকে কোন খবর পাওয়া গেল না। পুলিশের চেনা লোক ধরে জানতে চাইলাম ধানমন্ডি বা কলাবাগান থানায় এই নামে কোন লাশ এসেছে কি না? তারা জানাল, আসেনি। সকাল বেলায় মোটামুটি নিশ্চিত খবর পেলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে আছে প্রিয়। এগারোটা থেকে দু’ ঘণ্টার জন্য কারফিউ তোলা হবে। আমার শ্বশুর আর আমি একটা অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ছুটলাম। পথে তুলে নিলাম মিতুল আপাকে। প্রিয়’র মা কলি আপুর বন্ধু। গিয়ে দেখলাম শ্রেষ্ঠ আগেই পৌঁছেছে সেখানে। শ্রেষ্ঠ আমাদের আরেক ভাগ্নে। প্রিয়’র খালাত ভাই। প্রিয়’র এক চাচী আগে থেকেই ছিলেন সেখানে। রেজিস্টারে নাম পাওয়া গেল না প্রিয়’র। আমি কি ভেবে বললাম একটু অজ্ঞাতনামা’র লিস্টটা দেখলে হত না? সেই লিস্ট এনে দেখা গেল, সেখানেও প্রায় দশটার মত লাশের বর্ণনা। শুধু একটা ক্রমিক নম্বর দেয়া আছে। নম্বরের একটা কাউন্টার লেবেল লাশের গায়ে সাঁটানো। বয়স, সময় ইত্যাদি মিলিয়ে দুটো লাশের শর্টলিস্ট করে লাশ সনাক্ত করতে গেল শ্রেষ্ঠ। প্রায় ৪০ মিনিট পর ফিরে এসে বলল পেয়েছে প্রিয়কে। আমার শ্বশুর ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, তাড়াতাড়ি ফর্মালিটি শেষ করবার জন্যে। শ্রেষ্ঠ আমাকে আস্তে করে বলল, ‘অবস্থা বেশি ভালো না খালু। একটা ঘুপচি বদ্ধ ঘরে বিশ-পঁচিশটা লাশ মেঝেতে ফেলে রেখেছে। একটা ফ্যান পর্যন্ত নেই। লাশগুলোর উপর চাদর নেই। এলোমেলো পড়ে আছে। একজনের পা উঠে আছে আরেকজনের গায়ে। আর রক্ত। ছোপ ছোপ চুঁইয়ে পড়া রক্ত।’ আমি বললাম ‘সেই সন্ধ্যার সময় গুলি লেগেছে, এখনো তাজা রক্ত দেখলে?’ শ্রেষ্ঠ বলল, ‘কি করে বলি? এত রক্ত, কোনটা কার বোঝার উপায় নেই।’  

প্রিয়’র বন্ধুরা এসে পড়ল এরই মধ্যে। দুই একজনকে পেলাম যারা ঘটনার সময় ছিল ওঁর সাথে। আগে মিছিলে গিয়েছিল ওরা সবাই। ফিরছিল। সেন্ট্রাল রোডে ওদের আরেক বন্ধু মেধা’র বাসা। মেধাকে বাসায় পৌঁছে দিতে ওরা চার পাঁচজন হেঁটে আসছিল। সায়েন্সল্যাব থেকে গ্রীন রোডে ঢুকে সেন্ট্রাল রোডের মাথায় আসতেই গুলির শব্দ কানে আসে। ওরা দৌঁড়ে সেন্ট্রাল রোডের ভেতরে ঢুকে যায়। প্রিয় ছিল সবার পেছনে। হঠাৎ ওরা পেছনে তাকিয়ে দেখে প্রিয় পড়ে গেছে। তখনো মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজ আসছে। ল্যাব এইডের আরেকটু পেছন থেকে কোণাকুণি গুলি করছে পুলিশ। গুলি থামলে ওরা সামনে এসে দেখে প্রিয়কে নিয়ে গেছে পুলিশ। মাথার পেছনে নিচের দিকের বাঁ সাইডে লেগেছে গুলি। সেন্ট্রাল রোডে ঢোকার মুখে রাস্তার পিচে রক্ত লেগে আছে।  

প্রিয়র লাশটা পুলিশ মর্গে ফেলে রেখে দিয়ে চলে গেছে। অজ্ঞাত পরিচয়ে একটা ডেথ সার্টিফিকেট করা হয়েছে, তাতে শুধু লেখা আছে ‘গানশট ইনজুরি’। এখন ঘটনাস্থল যে থানার অধীনে সে থানার পুলিশকে লাশের সুরতহাল তৈরি করে তারপর অটোপসির জন্য পাঠাতে হবে। 

এদিকে থানা নিয়ে প্রচন্ড কনফিউশন তৈরি হয়েছে। কলাবাগান, ধানমন্ডি আর নিউমার্কেট এই তিন থানার যেকোন একটা হতে পারে সংশ্লিষ্ট থানা। আমি ভাবলাম, যেহেতু ধানমন্ডি আর কলাবাগান থেকে কাল রাতে কোন খবর পাইনি, নিউ মার্কেট থানায় যোগাযোগ করা যাক। ততক্ষণে আবার কারফিউ শুরু হয়ে গেছে। প্রিয়র বন্ধুরা অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ছুটল নিউমার্কেট থানায়।  

এদিকে মরচুয়ারিতে তখনো বুলেটবিদ্ধ লাশ আসছে। খোলা আকাশের নিচে লাশের স্ট্রেচার রেখে রেজিস্ট্রি ফর্ম পূরণ করছে মানুষ। বেশিরভাগ লাশের বয়সই ২০ থেকে ৩৫ এর মধ্যে। সার্টগুলো খুলে নিয়েছে আগেই, বোধহয় ডেথ সার্টিফিকেট তৈরি করার জন্য পরীক্ষার সময়। বেশিরভাগের পরনে প্যান্ট, একজনের পরনে দেখলাম লুঙ্গি। একটা কমবয়সী ছেলের লাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। ফারদীন। আমার স্কুলফ্রেন্ড। স্কুলমাঠের শেষপ্রান্তের পুরনো পরিত্যক্ত বিল্ডিংটায় আমরা রহস্য খুঁজে বেড়াতাম একসাথে। একটু পর সম্বিত ফিরে পেলাম। এত বছর পরে ফারদীন নিশ্চয়ই আর দেখতে এই কিশোরের মত নেই। আর এই ছেলেটা ফারদীনের তুলনায় কিছুটা বেঁটে আর কৃশকায়। এতক্ষণ লক্ষ করিনি। আমার পেছনে দাঁড়ানো একজন মহিলা হঠাৎ বলে উঠলেন ‘এরা কি পায়েও গুলি করতে পারে না। সবাইকে বুকে আর পেটে গুলি করছে?’ কথাটা শুনে আশপাশ থেকে অনেকে তার মুখের দিকে তাকাল, কেউ জবাব দিল না। আমি ভাবলাম বলি ‘আর মাথায়ও’। আর বললাম না শেষ পর্যন্ত।    

এসআই এসে লাশ দেখে আবার স্পট পরিদর্শনে গেল। নিশ্চিত হতে হবে এই লাশ তার থানার এখতিয়ারভূক্ত কি না? শেষে নিশ্চয়তা পাওয়ার পর সুরতহাল তৈরি করে অটোপসির জন্য পাঠাতে পাঠাতে প্রায় ছ’টা বেজে গেল। লাশকাটা ঘরের সামনে তখন স্ট্রেচারের ঘাটতি। লাশগুলো চাদর ধরে এনে অবিন্যস্ত ফেলে রাখছে মেঝেতে। মেঝেতে আর দেয়ালে রক্তের ঘসটানো দাগ। বাইরে থেকে রক্ত-মাংস-ফিনাইলের ঝাঁঝালো গন্ধের ধাক্কায় আমি ছিটকে এসে বাইরের আম গাছতলায় দাঁড়ালাম। কে যেন বলল এখানে কফিন পাওয়া যাচ্ছে। একটা এখনই কিনে রাখুন। পরে নাও পেতে পারেন। নারায়ণগঞ্জের আসগর আলি সাহেব একটা কফিনের দর দাম করছেন। আমাকে বললেন তার শালা পেটে গুলি লেগে মারা গেছে। নারায়ণগঞ্জে একটা মুরগীর দোকান চালাত। গন্ডগোল শুরু হলে ক্যাশে তালা মেরে দোকানের শাটার লাগানোর সময় বাতাসে শিঁস দেয়া গুলি তার পেট ভেদ করে ঢুকে বুকের ডান সাইড দিয়ে বেরিয়ে গেছে। একটা ষোল সতের বছর বয়সী কিশোরী মেয়ে ফর্ম হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওর বাবা কার্ফিউর মধ্যে বাসা থেকে নিচে নেমেছিল সিগারেট কিনতে। আর বাড়ি ফিরতে পারেনি। 

আমরা ডোমকে রিকোয়েস্ট করতে গেলাম আমাদের পোস্টমর্টেমের সিরিয়ালটা একটু আগে করে দিতে। সেই রংপুর যাবে বডিটা। এত গরম। ডোম বললেন, ‘পাগল হয়েছেন? রাত থেকে এপর্যন্ত ৫৫টা লাশ। আমরাও মানুষ’। ময়নাতদন্ত শেষ হল রাত সাড়ে দশটায়। গোসল করিয়ে কাফন পরিয়ে, আমরা অ্যাম্বুলেন্সে রওয়ানা হলাম এগারোটার কিছু পরে। যাওয়ার পথে নেমে দেখে নিলাম সেন্ট্রাল রোডের সামনে প্রিয়র রক্ত লেগে থাকা রাস্তাটা। স্পষ্ট দাগ। ছোপ ছোপ। জমাট। তখনো কারফিউ চলছে। তাড়াতাড়ি গাড়িতে ওঠা দরকার।  আমরা উঠে পড়লাম। উঠলনা শুধু প্রিয়র বন্ধুরা। ওদের কোন ভয় নেই। ওদের কান্নাও নেই। শুধু প্রতিজ্ঞা আছে। ওরা যেন ভাবলেশহীন সংশপ্তক।   

অনেকবার লিখতে গিয়ে পিছিয়ে গেছি। এই দুঃস্বপ্নের সাথে আরেকবার বোঝাপড়া করতে সাহস হয়নি। শেষে ভাবলাম, এ গল্পটাও এই মহান গণআন্দোলনে আমাদের যৌথ-স্মৃতির অংশ। এই দলিল থাকা দরকার। 

একটা তিন বছরের মেয়ে আছে প্রিয়র। প্রিয়কে সে শুধু বাবা বলে ডাকে না। বলে ‘আমার প্রিয়-বাবা’। কি মিষ্টি লাগে শুনতে। যেন প্রত্যেক কথায় কথায় বাবাকে চিঠি লিখে চলেছে।

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন