Logo
Logo
×

অভিমত

রাষ্ট্র সংস্কার ভাবনা

Icon

ড আসরার তালুকদার

প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৫১ পিএম

রাষ্ট্র সংস্কার ভাবনা

ছবি: সংগৃহীত

গত জুলাই মাসে বৃটেনে সাধারণ নির্বাচন হয়ে গেল। লেবাররা ভূমিধ্বস বিজয় পেল। সিটের হিসাবে, ১৮৩২ সালের পরে এত বড় বিজয় আর কেউ পায়নি। এর আগের ২০১৯ সালের নির্বাচনে টরিরা ভূমিধ্বস বিজয় পেয়েছিল। মজার ব্যপার হলো আগের নির্বাচন থেকে লেবারদের ভোট কিন্তু বাড়েনি বরং কমেছে। 

টরিদের ভোটে নব্য গঠিত Reform UK পার্টির ভাগ বসাতে এই অবস্থা। এই ব্যবস্থায়, পার্লামেন্টে অনেক সিট পাওয়ার জন্য অনেক ভোটের প্রয়োজন পড়ে না। প্রয়োজন শুধু বিরোধীদের ভোট ভাগ হয়ে যাওয়া। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে, এ জাতীয় বিরাট ম্যাজোরিটির সরকার দ্রুত জনপ্রিয়তা হারায় আর আমাদের মতো দুর্বল গণতন্ত্রের দেশে, ভোট অধিকারই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়। 

বিগত ১৫ বছরে আমরা যে একটা ফ্যাসিবাদের কবলে পড়ে গেলাম তার পেছনেও ২০০১ সালে বিএনপির ভূমিধ্বস বিজয় এবং তারই ধারাবাহিকতায়, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের ভূমিধ্বস বিজয় বিরাট ভূমিকা পালন করেছিল। প্রাপ্ত ভোটের হিসাবে দেখা যায়, দুই নির্বাচনে, বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের ভোটে ঊনিশ বিশের চেয়ে বেশি পার্থক্য হয়নি। 

এই সমস্যা থেকে বাঁচতে অস্ট্রেলিয়া ভোট গণনার পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনেছে। এখানে মানুষ ব্যালট পেপারে তাদের পছন্দের ক্রম অনুসারে প্রার্থীদের নামের সামনে ১, ২, ৩ ও ৪ লিখে দেয়। ১ মানে ফার্স্ট চয়েজ, ২ মানে সেকন্ড চয়েজ ইত্য়াদি। গণনার শুরুতে শুধু ফার্স্ট চয়েছজ হিসাব করা হয়। যদি কেউ ৫০ ভাগের উপর ভোট পেয়ে যায়, তাকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। যদি কেউ ৫০ ভাগের উপর ভোট না পায়, তখন সেকেন্ড চয়েজ গণনা করে যোগ করা হয়। এইভাবে থার্ড ফোর্থ চয়েজ গণনা করা হয় যতক্ষণ না একজন প্রার্থী ৫০ ভাগের বেশী ভোট পেয়ে বিজয়ী হন।

মূলত এই পদ্ধতি ফ্রান্সের দুই রাউন্ডের ভোটেরই একটা বিকল্প। ফ্রান্সে প্রথম দফা নির্বাচনে, যদি কেউ ৫০ ভাগের উপর ভোট না পায়, তবে প্রথম দফার প্রথম আর দ্বিতীয় প্রার্থীর মধ্যে দ্বিতীয় দফা ভোটের আয়োজন করা হয়। অস্ট্রেলিয়ার মতো ধনী আর অল্প জনসংখ্যার দেশে এই পদ্ধতি সফল হলেও, বাংলাদেশের মতো অধিক জনসংখ্য আর দুর্বল স্বাক্ষরতার দেশে এই ব্যবস্থা অবাস্তব বলেই মনে হয়। 

বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা হতে পারে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা অনুপাতে দলগুলোর মধ্যে আসন বণ্টন। জুলাই বিপ্লবের প্রধান সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের কথায়ও জানতে পারলাম যে, তাদের বিবেচনাতেও এই পদ্ধতিটা রয়েছে। এই পদ্ধতির সঙ্গে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাটা শেয়ার করার জন্যেই আমার এই লেখা। স্পেনে এই পদ্ধতি বিদ্যমান। আর আমি ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত উচ্চ শিক্ষার জন্য় স্পেনে ছিলাম। 

এই পদ্ধতিতে কালো টাকার ব্যবহার অনেক কমবে। ময়দানের জনপ্রিয় নেতা নেত্রীদের সঙ্গে লোক চক্ষুর বাইরে থাকা দলের ত্যাগী আর গুণিরাও সুযোগ পাবে। তবে এই পদ্ধতির সবচেয়ে খারাপ দিক হলো দলের বাইরে গিয়ে স্থানীয়ভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচিত হওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। দলীয় প্রার্থীরও বিজয় নির্ভর করে দলের তালিকায় তার নাম কত নম্বরে রয়েছে। দলের ভেতর যদি গণতন্ত্র না থাকে, তবে এই পদ্ধতিতে সুফল পাওয়া কঠিন। এই ব্যবস্থা বরং দলীয় প্রধানকে আরো স্বৈরাচারী করে তোলে। বিশেষত আমাদের দেশে, যেখানে জামায়াতে ইসলামী আর কিছু ছোট ছোট বাম দল ছাড়া কোনো দলেই গণতন্ত্রের চর্চা নেই।

৯/১১ এর পর, যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্য যখন ইরাক আক্রমণ করল, স্পেন ছাড়া কন্টিনেন্টাল ইউরোপের আর কেউ এর সমর্থন দেয়নি। স্পেনেও জরিপের পর জরিপে দেখা গেল যে, ৯০ ভাগ মানুষই যুদ্ধের বিপক্ষে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আছনারের একক সিদ্ধান্তে স্পেন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। পরিণতিতে, পরবর্তী নির্বাচনে দলের পারাজয় ঘটে। দলের অনেক নেতা মনে করেছিল যে, দেশের অনেক ভালো অর্থনৈতিক অবস্থা তাদের রক্ষা করবে। তবে যারা বুঝতে পেরেছিল তারাও বলতে পারেনি, লিস্ট থেকে বাদ পাড়ার ভয়ে, অথবা সমন্বিত তালিকাতে নাম নিচের দিকে চলে যাওয়ার ভয়ে।

আমি স্পেনে লেখাপড়া শেষ করে চাকরির জন্যে জার্মানিতে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম, তারা পার্লামেন্টের ৫০ ভাগ আসনে সরাসরি নির্বাচন করে আর বাকি ৫০ ভাগ আসন প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা অনুপাতে দলের মধ্যে ভাগ করে দেয়। প্রত্যেক ভোটার দুটো করে ভোট দেয়। একটা সরাসরি ভোটে দাঁড়ানো প্রার্থীর জন্য, আর দ্বিতীয়টা তার পছন্দের দলের জন্য।

কোনো পদ্ধতিই শতভাগ শুদ্ধ হবে না। সবচেয়ে ভালো পদ্ধতিও বাংলাদেশের কনটেক্সটে সংযোজন বিয়োজন করতে হবে। তবে সব বিবেচনায়, জার্মান পদ্ধতির কাছাকাছি কোনো পদ্ধতি আমাদের জন্য সবচেয়ে ভালো হতে পারে।

সেই সাথে আমাদের এটাও উপলব্ধিতে আনতে হবে যে, শুধুমাত্র একটা ভালো নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন দেশের সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের। আমাদের জাতীয় জীবনের সবচে বড় বঞ্চনা হলো সরকার কার্যত জনগণকে প্রজা মনে করে। আমরা people republic এর বাংলা করেছি প্রজাতন্ত্র। সিভিল সার্ভিসের বাংলা করেছি সরকারি চাকরি। সিভিল সারভেন্টদের স্প্যানিস ভাষায় বলে রাষ্ট্রের কর্মচারী। প্রজা আর সরকারি চাকুরেদের দেশে গণতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠান পাওয়া সম্ভব না। দরকার সার্বজনীন নাগরিকের রাষ্ট্র। 

আমাদের মনোজগতের বিরাট পরিবর্তন প্রয়োজন। যার শুরুটা হতে হবে আমাদের ভাষার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। নিদেন পক্ষে প্রজাতন্ত্রের একটা ভালো প্রতিশব্দ দরকার। একটা জাতির জীবনে তার স্বাধীনতা সবচেয়ে বড় ঘটনা। কিন্তু কয়েক দশক পরপর যদি নতুন করে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয় তবে সেটা হয় চরম দুর্ভাগ্যের। আমাদের আবারো ফিরে পাওয়া স্বাধীনতা চিরস্থায়ী হওয়া একান্ত দরকার।

লেখক : অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন