Logo
Logo
×

অভিমত

১৮ হাজারের বেশি আহত, শহীদের সংখ্যা জানা নেই, গোপনে চলছে খুনেদের পুনর্বাসনের কাজ!

কাকন রেজা

কাকন রেজা

প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:০৫ পিএম

১৮ হাজারের বেশি আহত, শহীদের সংখ্যা জানা নেই, গোপনে চলছে খুনেদের পুনর্বাসনের কাজ!

প্রথম আলো লিখলো, জুলাই বিপ্লবে আহতের সংখ্যা ১৮ হাজারের বেশি। শহীদের সঠিক সংখ্যা আমরা এখনো জানি না। এক পিতাকে দেখলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তানকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। যে সন্তান শহীদি তামান্নায় ঘরে ছেড়েছিলেন। কিন্তু ঘরে ফিরে যাননি। উদ্‌ভ্রান্ত পিতা দিগ্‌বিদিক ছুটে বেড়াচ্ছেন সন্তানের সন্ধানে। 

আমি এক পরিবারকে জানি, তাদের ছেলে শহীদ হয়েছেন। বাবা-মা বাকহীন। জানি তাদের কষ্ট বুঝবে না অরুণা বিশ্বাসের মতন মানুষেরা। আমি বুঝি, আমার ছেলেও শহীদ হয়েছে। যে ছিল একটি প্রধানতম গণমাধ্যমের ইংরেজি বিভাগের সাবএডিটর। ফাগুন রেজা। ফাগুন রেজা নাম দিয়ে গুগলে সার্চ দিলেই বেরিয়ে আসবে। ডয়চে ভেলে দীর্ঘ প্রতিবেদন করেছিলো তাকে নিয়ে। গণমাধ্যমকর্মীরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সমুখে মানববন্ধন করেছিল বিচারের দাবিতে। সারাদেশের অনেক জায়গাতেই বিচারের দাবিতে দাঁড়িয়েছিলেন গণমাধ্যমকর্মীরা। কিন্তু পাঁচ বছরের বেশি হয়ে গেলো বিচার হয়নি। শেষ হয়নি তদন্ত। 

মূলত কোনো কিছু বিরুদ্ধে গেলেই পতিত স্বৈরাচার বেছে নিতো গুম ও হত্যার পথ। জুলাই বিপ্লবেই ধারণা করা হচ্ছে দেড় হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। কীভাবে পাখির মতন মানুষ হত্যা করা হয়েছে এবং ঠান্ডা মাথায়। গাজীপুরের কোনাবাড়ির হৃদয়ের কথা বলি। আন্দোলনে অংশ নেয়া হৃদয়কে ধরে এনে ঠান্ডা মাথায় পিঠে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করা হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যায় হৃদয়। ৫ আগস্টের ঘটনা এটি। যারা এ ঘটনার ভিডিও দেখেছেন, তারাও নিশ্চিত ট্রমায় পড়ে যাবেন। এমন অসংখ্য দৃশ্য ভাসছে সামাজিক ও গণমাধ্যমে। যা দেখে মানুষের সুস্থ থাকার কোনো উপায় নেই। এই বর্বরতা মুক্তিযুদ্ধকালীন হানাদার বাহিনীকেও হার মানিয়েছে। 

এখন প্রশ্ন হলো মানুষ হত্যার নির্দেশ দিয়েছে কারা। সাধারণ পুলিশেরা বলছেন, তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে তারা গুলি করেছেন। কিন্তু হৃদয় হত্যাকাণ্ডে যে দৃশ্য দেখা গেলো সেখানে শুধু কর্মকর্তাদের দোষ দিয়ে পার পাওয়া যাবে না। হৃদয়কে যেভাবে ঠান্ডা মাথায় খুন করা হলো তা অবিশ্বাস্য। হুকুমের কারণে এভাবে হত্যা অসম্ভব ব্যাপার। তাহলে কি পুলিশের মধ্যেও একটি আলাদা খুনে বাহিনী তৈরি করা হয়েছিলো। আন্দোলনের ভিডিও ফুটেজগুলো লক্ষ্য করলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। একটা ফুটেজে দেখা গেলো এক কর্মকর্তা পুলিশদের গুলি করার নির্দেশ দিচ্ছেন। কিন্তু বেশিরভাগ পুলিশ গুলি করতে অনীহা প্রকাশ করছে। কিন্তু হাতেগোনা কয়েকজনকে দেখা গেলো তারা অতি উৎসাহে গুলি ছুড়ছে। শুধু ছুড়ছে না, রীতিমতো বুক মাথা লক্ষ্য করে ছাত্র-জনতার দিকে গুলি চালাচ্ছে। এই উৎসাহীরা কারা। 

মহিউদ্দিন খান আলমগীর তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তার ওখানে গেলেন ওই সময়ে ঢাকায় এসি পদে কর্মরত এক পুলিশ কর্মকর্তা। গেলেন প্রমোশন ও পোস্টিং এর জন্য। গিয়ে তার যোগ্যতার যে বয়ান দিলেন তা হলো, তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। তিনি ৫ মে শাপলা ম্যাসাকারে সাফল্যের সাথে অংশ নিয়েছিলেন। এছাড়া বিরোধী কর্মীদের কঠোর হাতে দমন করেছেন। এই হলো তার মোট যোগ্যতা। এই কথা যার কাছে শোনা তিনিও পুলিশের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। যিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অর্থাৎ যোগ্যতা হলো একটি রাজনৈতিক দলের কর্মী হওয়া এবং হত্যা ও ম্যাসাকারে হাত পাকানো। তাও আবার নিরীহ মানুষ হত্যা। এদেরও কেউ কেউ পুনর্বাসন করতে চান। আজব না?

আমার পরিচিত একজন লেখিকা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখলেন, ‘আজরাইল আপনার নিজ সন্তানের সামনে না দাঁড়ানো পর্যন্ত আপনি হত্যাকে জাস্টিফাই করে করেই যাবেন। কারণ, আপনি সিলগালা হয়ে গিয়েছেন।’ যারা এসব খুনেদের পুনর্বাসন করছেন তারা এবং সেই খুনেরা তাদের সন্তানের বেলায় এমন না ঘটলে হয়তো কখনো অনুভব করতে পারবেন না সন্তান হারানোর যাতনা। আমরা যারা সন্তানের লাশ কাঁধে নিয়েছি তারাই অনুভব করেছি পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বোঝাটাকে। তাই যখন খুনেদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া দেখি। চোখের সমুখে দেখি সেই পুরানো খুনেদের আস্ফালন তখন নিজেকে সামলানো কঠিন হয়ে যায়। অথচ অরুণা বিশ্বাসের মতন কথিত শিল্পীরা কী নির্দ্ধিধায় এই হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করে যান। পরে যখন কথা ওঠে, তখন বলেন, আমি জানতাম না এতকিছু হয়েছে। চঞ্চল চৌধুরীর মতন অভিনেতারা নির্বিকার পার পেয়ে যেতে চান সহজেই। খুনেদের মনোরঞ্জন ও উৎসাহদানকারী এসব লোকেরও শাস্তি হওয়া উচিত। 

বিপ্লবের একমাস পুরো হয়ে গেছে। কিন্তু বেশিরভাগ জায়গাতেই রয়ে গেছে পতিত স্বৈরাচারের ধ্বংসাবশেষ। কিন্তু এই ধ্বংসাবশেষ হলো ভয়াবহ রকমের টক্সিক। এই যে নানা রকম আলামত। ডাকাত, সাম্প্রদায়িক বিভেদের কিচ্ছা-কাহিনী, আনসার বিদ্রোহ, শ্রমিক বিদ্রোহের চেষ্টা। এর সবকিছুর পেছনেই রয়েছে সেই টক্সিক অবশেষের ক্রিয়া। সামনে যারা, তারা মূলত পাপেট, সুতো নাড়াচ্ছে সেই টক্সিক অংশটা। গত ৭ আগস্ট রাতওে চট্টগ্রামের চেরাগী পাহাড় এলাকায় সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা তৈরির চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয়দের ধৈর্য, সেনাবাহিনীর উদ্যোগ সেই অপচেষ্টাকে থামিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কতবার থামানো যাবে। টক্সিক অংশটাকে বাদ দেয়া না গেলে এরা একটার পর একটা সমস্যা দাঁড় করাবেই। 

শহীদদের প্রসঙ্গে আবার আসি। রাফসান গালিব লিখেছেন, ‘শহীদ ফারহান ফাইয়াজের বাবা৷ আজকে দেখা হইল। তার সাথে কথা বলতেছিলাম। কিন্তু কথা আগাইতে পারতেছিলাম না। কী কথা বলব, কী জিজ্ঞাসা করব? তরতাজা একটা ছেলে, একমাত্র ছেলেকে হারাইছেন উনি। একটা মেয়ে আছে। হুট করে জিজ্ঞাসা করে ফেললাম, ফারহান তো দেখতে আপনার মতোই হইছে। পরে আফসোস করতেছিলাম কেন এই প্রসঙ্গ তুললাম।’ রাফসান গালিব বুঝতে পেরেছেন তাকে এই প্রশ্ন করাটা ঠিক হয় নাই। আমাকে যখন আমার ছেলের কথা বলে কেউ, আমি চুপ করে থাকি। কিছুদিন আগে গণমাধ্যমের এক কর্তাব্যক্তির সাথে দেখা, তিনি বলছিলেন ফাগুনের কথা। বলছিলেন, ফাগুন কত ভালো ইংরেজি জানতো। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এত ভালো ইংরেজি জানা ছেলের প্রচণ্ড প্রয়োজন। উনি ফাগুনের প্রশংসা করছিলেন, আমি মুখ নীচু করেছিলাম, যেন আমার চোখের পানি তার দৃষ্টিতে না পড়ে। 

এই খুনিদের কোনোভাবেই পুনর্বাসন করা যাবে না। যারা করার চেষ্টা করবে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। কিন্তু ব্যবস্থা নেয়ার আলামত খুব একটা চোখে পড়ছে না। যা পড়ছে এখন পর্যন্ত তা আইওয়াশ মনে হচ্ছে। জানি না, হয়তো সরকার ধীরে-সুস্থে এগুতো চাইছেন। এমনটা হলে কোনো কথা নেই, না হলে কথা থেকেই যাবে। আমরা কথা বলে যাব। গত সতেরো বছর লিখে গেছি, কথা বলে গেছি। সন্তান হারিয়েছি। থামিনি। থামবো না। দেশের ভেতর থেকে আমরা হাতেগোনা কয়জন, প্রতিবাদ করেছি, লিখেছি। আমাদের লেখা বৃথা যায়নি। পতন ঘটেছে বিশ্বের সবচেয়ে জিঘাংসাপ্রবণ রেজিমের। আমাদের সন্তানরা সে রেজিমের পতন ঘটিয়েছে নিজেদের জানের তোয়াক্কা না করে। তাদের স্যালুট। জাতি ভরসা রাখে তাদের উপর। দুই তরুণ উপদেষ্টা বলেছেন, বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসন নয়। 

আমরাও তাই চাই। শহীদ ও আহতদের পরিবারও তাই চায়। তবে সংশয়ের সৃষ্টি হয় এখন পর্যন্ত হওয়া হত্যা মামলার ধরণ থেকে। ব্যারিস্টার সারা হোসেনও একই ধরনের সংশয়ের কথা বলেছেন। আমরা দেখছি হত্যা মামলায় এমন লোকের নাম ঢুকানো হয়েছে, যারা কোনোভাবেই সেই হত্যা মামলায় জড়িত নন। এমনকি বিএনপি নেতাকর্মীদেরও নাম হত্যা মামলায় দেয়া হয়েছে। অথচ যে মামলায় কোনো পুলিশ কর্মকর্তার থাকার কথা সেখানে তার নাম নেই। এমন ঘটনাও আমরা দেখেছি পুলিশ কর্মকর্তার নাম থাকায় পুলিশ মামলা নিতে চাচ্ছে না। রাজধানীতেই এমন ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি আমরা। সারাদেশেই এমন ঘটনা রয়েছে। ফলে এই মামলাগুলো কতটা কার্যকর হবে বা থাকবে এবং এ থেকে কতটা ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে তা সঙ্গতই প্রশ্নের উদ্রেক করে। 

সাভারের আশুলিয়ার নৃশংসতার কথাই বলি। ভ্যানে লাশ স্তূপ করার ঘটনা যদি প্রকাশ্যে না আসতো, তাহলে হয়তো খুনিরা পার পেয়ে যেতো। হয়তো বলছি কেন, নিশ্চিত পার পেয়ে যেতো। কিন্তু ওই যে প্রকৃতির বিচার। কী বীভৎস হত্যাকাণ্ড, লাশ পুড়িয়ে দেয়ার নিদারুণ পৈশাচিকতা। ভিডিও প্রকাশ্যে আসার পরও স্থানীয়দের অনেকেই গণমাধ্যমের কাছে ঘটনার বিষয়ে মুখ খুলতে চাননি। তারা বলেছেন, ‘পুলিশরা এসে শাসিয়ে গেছে। বলে গেছে, দিন এমন থাকবে না।’ চিন্তা করে দেখুন এখনো তারা সাহস পায় দিন ফিরে পাবার। কেন পায় সে কথা শুরুতেই বলেছি। খুনেদের পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে। সাথে চলছে পুনর্বাসন বাণিজ্যও। মোটা টাকার লেনদেনের কথাও বাতাসে ভাসছে। ভাসমান কথা সবসময়ই সত্যি হয় না। আমরাও চাই মিথ্যা হোক। শহীদেরা ন্যায় বিচার পাক। আহতরা চিকিৎসা এবং পুনর্বাসন। পুনর্বাসিত হোক শহীদের পরিবারও এবং তা সম্মানের সাথে। 

আগেই বলেছি, পুলিশের মধ্যে আরেকটা পুলিশ তৈরি করেছিলো ফ্যাসিস্ট রেজিম। বলেছি, বেশিরভাগ পুলিশেরই গুলিতে অনীহা ছিল। কিন্তু কিছু উৎসাহী পুলিশ, যাদের তৈরি করা হয়েছিল ফ্যাসিজম টিকিয়ে রাখার উপকরণ হিসেবে, তারাই গুলি চালিয়েছে। পুলিশকে মানবিক করা এখনো সম্ভব। পুলিশের উচ্চ পর্যায়ে আমার পরিচিত, বন্ধুজনরা রয়েছেন। যাদের জানি আমি সত্যিকার ভালোমানুষ হিসেবে। যাদের ইচ্ছে রয়েছে মানুষকে সেবা দেবার। কিন্তু ফ্যাসিজম তাদেরকে তা করতে দেয়নি। বরং যারা করতে চেয়েছেন তারা নিগৃহীত হয়েছেন। পুলিশের সেই সব মানবিক মানুষদের কাছে আবেদন, ফ্যাসিজমের ভূত বিদায় করতে নিজেরাও সচেষ্ট হোন। আপনাদের কপালে লাগানো কলঙ্ক তিলক আপনাদেরই মুছতে হবে। আমরা আপনাদের সাথে আছি। 

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন