মুজিবকে নিয়ে মিথের বাস্তবতা যাচাইয়ে উপযুক্ত সময় বইছে এখন
এহতাশাম হক
প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:৩৬ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
ছাত্রদের নেতৃত্বে বিক্ষোভে শেখ হাসিনার পতনের পর, বিক্ষুব্ধ জনতা তার ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের প্রতীক মনে করা ভবনগুলোকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। এসব ভবনের মধ্যে হাসিনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়ি— যেটি বর্তমানে জাদুঘর সেটিও ছিল।
শোক প্রকাশে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচীর সেই পুড়িয়ে দেওয়া জাদুঘর পরিদর্শন আবার বাংলাদেশে শেখ মুজিবের প্রতি চির শ্রদ্ধার বিষয়ে উদ্বেগও বাড়ায়।
ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের জন্য রোকেয় প্রাচীর এমন প্রকাশ্য শোক দেখে বুঝা যায় হাসিনার শাসনের সহিংসতায় প্রিয়জন হারানো পরিবারগুলির আহাজারিকে উপেক্ষা করা হয়েছে। অথচ জনগণের টাকায় মুজিবের উত্তরাধিকারকে মহিমান্বিত করতে বছরের পর বছর এই শাসন ব্যবস্থাটি পার করেছিল।
সেই সন্ধ্যায় রোকেয়া প্রাচী ধানমন্ডি-৩২ এর এক খুপড়ির মধ্যে বসে ছবি তোলেন। ছবিতে তার পেশাদার প্রবৃত্তি, অর্থ্যাৎ তিনি যে অভিনেত্রী তা ঠিক ঠিক ফুটে উঠেছিলে। কারণ ঠিক ওই সময় হাসিনা শাসনের হাজার হাজার ভুক্তভোগী কাছাকাছি হাসপাতালে কাতরাচ্ছিলেন।
মুজিবের জন্য তার এই লোক দেখানো শোক উদ্বেগজনকভাবে শেখ হাসিনার তৈরি করা ব্যাপক যন্ত্রণার থেকে বিচ্ছিন্ন বলে মনে হয়েছিল। কারণ, ভাবটা এমন যে, হাসিনার মনে লয় জাতির কাছে তার পরিবারের ঐশ্বরিক কোনো দাবি রয়েছে।
ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা শাসন যেভাবে শেখ মুজিবকে গৌরবান্বিত দেখায় তাতে উত্তর কোরিয়ার কিম জং উনকে গৌরবান্বিত করার বা মধ্যপ্রাচ্যের রাজ পরিবারগুলো তাদের সদস্যদের জন্মদিন যেভাবে উদযাপন করে তার প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে।
মুজিবের জন্মবার্ষিকীতে বিলবোর্ডে দেশ ভরে যায়। স্কুলের শিক্ষার্থীরা তার প্রতিকৃতিকে সালাম জানায়। আর সরকারি নথিতে তার জলছবি বসে এবং মোবাইল ফোনে কল দিলে ভেজে উঠতো তার পরিচিত কণ্ঠস্বর।
শেখ মুজিবকে শুধু ‘সম্প্রদায়ের পিতা’ হিসেবে না দেখে তাকে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে শেখ হাসিনার কর্মকাণ্ডকে নিছক ক্ষমতার অপব্যবহার হিসেবে দেখা ভুল হবে। সর্বোপরি এটি মুজিবের নিজেরই আকাঙ্ক্ষা ছিল। যেমনটি লেখক, ভ্রমণকারী এবং ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের ফরেন সংবাদদাতা গ্যাভিন ইয়াং ১৯৭৫ সালের ১৭ আগস্ট দ্য অবজারভারে লেখা ‘মুজিবস মডল্ড ড্রিম’ অংশে তুলে ধরেছিলেন।
বস্তুনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষ বিবেচনার অভাব
বাংলাদেশিদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সত্যিকার অর্থেই শেখ মুজিব ভুল করতে পারেন সেটা বিশ্বাস করেন না। তার রাজনীতির যে কোনো সমালোচনাকে তারা ধর্মদ্রোহিতা হিসেবে মনে করেন।
মুজিবের ১৯৭২ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত শাসনকে গ্যাভিন ইয়াং ‘অহংকারপূর্ণ, আত্মতৃপ্ত এবং অকার্যকর’ হিসেবে চিত্রিত করেছেন। আর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে স্টেনগানের গুলি যেন তাকে এক ধরনের পরিত্রাণের আবহে আচ্ছন্ন করেছিল।
এটা যুক্তিসঙ্গত মনে করা ঠিক যে, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত মুজিবের শাসনকালকে কেবল বস্তুনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষভাবে বিবেচনা করা হয় না বলেই তার নায়কোচিত ভাবমূর্তিখানা টিকে আছে। বিশ্বাসযোগ্য আন্তর্জাতিক সূত্রগুলো দিয়ে এই সময়কালটি যাচাই করলে মুজিবের নেতৃত্বের আরও সঠিক এবং পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যাবে।
১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট মুজিবের মৃত্যুকে দ্য গার্ডিয়ান ‘দুর্নীতি ও স্বৈরাচার পতনের প্রতীক’ হিসেবে চিত্রিত করে। নিবন্ধটির লেখক গ্যাভিন ইয়াং উল্লেখ করেন, মুজিব ব্যর্থ প্রশাসক হিসেবে প্রমাণিত হয়েছিলেন, তার চেয়ে বড় কথা, নিজের বিপুল জনপ্রিয়তার বিষয়টি তার মাথা খারাপ করে দিয়েছিল; তিনি অহংকারী, আত্মতৃপ্ত এবং অলস হয়ে পড়েছিলেন।
তৎকালীন বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্লেষকরা একমত যে, মুজিবের নেতৃত্বে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি প্রবল হয়ে ওঠেছিল।
স্বাধীনতার পর বন্যার্তদের সহায়তায় পর্যাপ্ত ত্রাণ আসলেও আওয়ামী লীগ নেতারা নিজেদের মধ্যে ভাগ-ভাটোয়ারায় উন্মত্ত হয়ে উঠে। এতে করে মুষ্টিমেয় বাংলাদেশি ছাড়া অনেকের জীবনকে দুর্দশায় ফেলে।
মুজিবের শেষ দিনগুলোকে ইয়াং এভাবে চিত্রিত করেছেন: তিনি (মুজিব) ১৯৭২ সালে যে গণতন্ত্র বেছে নিয়েছিলেন তা বাতিল করে দেন। জরুরি অবস্থা ঘোষণার মাধ্যমে তিনি দেশে একদলীয় শাসন কায়েম করেন এবং রাষ্ট্রপতি হন। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে থাকা কয়েকটি ছাড়া সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দেন। নিজের কিছু দুর্নীতিবাজ সহকর্মীদের সঙ্গে ভারসাম্য আনতে নতুন রাজনৈতিক দল করে তাতে আওয়ামী লীগের বাইরের কয়েকজনকে নেন।
শেখ মুজিবের শাসন সম্পর্কে আরও একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায় আমেরিকান লেখক, ইতিহাসবিদ এবং সাংবাদিক টিমোথি ডেমিয়েন অলম্যানের কাছ থেকে।
১৯৬৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত অলম্যান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ফ্রিল্যান্স সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন। বিশেষ করে তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধের ওপর অনুসন্ধানী এবং বিশ্লেষণাত্মক প্রতিবেদনে তৈরিতে জোর দিয়েছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৮ আগস্ট দিল্লি থেকে দ্য গার্ডিয়ানে পাঠানো প্রতিবেদনে তিনি লিখেন, বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষমতার ব্যক্তিগত ইতিহাস ছিল সর্বোচ্চ জাতীয় বীরের, যার মর্যাদা দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অযোগ্যতা এবং জবরদস্তির কারণে ক্রমশ ক্ষয় হয়েছিল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মুজিবের দুঃখজনক মৃত্যুর পর গার্ডিয়ানের ফরেন সংবাদদাতা ও ফরেন সম্পাদক মার্টিন উলাকট মুজিবের শাসন পদ্ধতিকে ‘অকার্যকর অবস্থানে উদ্বেগহীন’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন।
তিনি লিখেন, গণতন্ত্র বাতিলের পরও রাজনীতিতে কয়েক মাস ধরে তেমন কিছুই ঘটেনি—শেখ মুজিবের এমন স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ বা উদ্বেগহীন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল।
উলাকট আরও লিখেন, মুজিব তার অফিসে এমনভাবে বসে থাকতেন যেন তিনি মানসিকভাব মধ্যযুগীয় শাসক। বন্ধু ও সহকর্মীদের সঙ্গে হাসতেন, কৌতূক করতেন, গালগল্প করতেন, লেকচার দিতেন এবং প্রতিদিন তার কাছে সাহায্যের জন্য আসা দীর্ঘ সারিতে থাকা মানুষদের মুখোমুখি হতেন।
মিথ ভাঙার সময়
এই বর্ণনাগুলি যারা দেখেছে মুজিবের মেয়ে কীভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হবে। তিনি ঘন ঘন সংবাদ সম্মেলন করতেন, যা দেখতে অনেকটা মধ্যযুগীয় রাজ আদালদের আধুনিক রূপ। এই সংবাদ সম্মেলনগুলিতে কোনো সমালোচনা থাকতো না। দাসমনোবৃত্তির সাংবাদিকরা দলবেঁধে তার গুণাবলীর প্রশংসা করতো। তারা গত ১৬ বছরে হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশকে দুর্নীতিতে জর্জরিত করা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন করতো না।
বাংলাদেশের সামনের পথ খুব একটা মসৃণ হবে না। মুজিবকে ঘিরে থাকা এসব মিথের যদি না মোকাবিলা করেন, যা জাতির একটি অংশকে প্রভাবিত করেছে, যা তাকে দেখতে চায় না যে তিনি আসলে কে ছিলেন। তাহলে দারুণসব সুখ্যাতি পাওয়া বিশেষজ্ঞ এনজিও প্রশাসকরাও যথেষ্ট হবেন না।
মুজিব এমন একজন জাতীয় নেতা ছিলেন যিনি দেশ যে তার উপর আস্থা রেখেছিল তার প্রতিদান দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর যে দেশটি তিনি পেয়েছিলেন সেটিকে তিনি খুব খারাপ অবস্থায় রেখে গেছিলেন। আরও সহজ করে বললে, যখন সাধারণ বাংলাদেশিরা কঠিন দুর্দশার মধ্যে জীবন অতিবাহিত করছিল তখন তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের এক সেলে বসে তামাকের সৌখিন পাইপ টেনে সময় কাটাচ্ছিলেন।
লেখক: যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ সলিডারিটি ক্যাম্পেইনের প্রতিষ্ঠাতা এবং সাবেক লেবার কাউন্সিলর।