কূটতর্ক ছাগলের তিন বাচ্চা এবং সাউথ ব্লকের ফাঁদ
বাংলাদেশে ব্যাংক বলছে, লুটপাটের শূন্যতা পূরণ করতে ২ লাখ কোটি টাকা লাগবে। বুঝতে পারছেন তো লুটপাটের পরিমাণটা! আজ যখন লিখছি তখন ঘড়ির কাঁটা অনুযায়ী ৪ সেপ্টেম্বর। মাত্র একমাস আগে এ সময়ে আমরা ভীত। কাল সকালে বেরুলে বাসায় ফিরতে পারবো কিনা। আমাদের সন্তানরা বাসায় ফিরতে পারবে কিনা। এমন প্রশ্ন নিয়ে রাত গভীর হচ্ছে। ৪ আগস্ট দিনভর দেখেছি শহীদের মিছিল। একের পর এক তরুণের গুলিবিদ্ধ লাশ। আহতদের চিৎকার। কী ভয়াবহ অবস্থা। এখনো ঘুমাতে পারি না, কানে বাজে।
অথচ এরমধ্যেই এক শ্রেণির আঁতেল চিৎকার শুরু করেছে জাতীয় সঙ্গীত রক্ষা নিয়ে। জুলাই বিপ্লব ছিল ক্ষমতাকেন্দ্রের বিরুদ্ধে। যাদের হাতে নিষিদ্ধ ও চালু করার ক্ষমতা ছিল, তাদের বিরুদ্ধে। জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের কথা কি বর্তমান ক্ষমতাকেন্দ্র বলেছে? বলেনি। বলেছেন এমন একজন মানুষ যার জীবনের দীর্ঘদিন আয়নাঘরে কেটেছে। নিজের সোনালি দিনগুলো বিসর্জন দিয়েছেন। ঘর-সংসার সব হারিয়েছেন যিনি, তিনি বলেছেন জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন করা উচিত, এমন কথা। তিনি কি ক্ষমতাকেন্দ্র? তিনি বললেই কি জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন হয়ে যাবে? যাবে না। অর্থাৎ তিনি ক্ষমতাকেন্দ্র নন। তাহলে তার কথাকে ধরে নিয়ে অযথা বিতর্ক কেন? যুদ্ধের সাজ সাজ রব কেন?
কিছু লোককে দেখলাম তো প্রোফাইল পিকচার পরিবর্তন করছেন জাতীয় সঙ্গীতের লাইন লিখে। জাতীয় সঙ্গীত বিতর্কে যারা কোমর বেঁধে লেগেছেন তারা কি জেনে-বুঝে এসব করছেন, নাকি ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা। অথবা সাউথ ব্লকের নির্দেশ পালন করছেন। কথা পরিষ্কার, যিনি পরিবর্তনের বিষয়ে বলেছেন, তিনি কোনো রেজিমের মাথা না, ফ্যাসিস্ট না। তার জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের ক্ষমতা নেই। তিনি একজন আমজনতা মাত্র। সুতরাং আপনি কার, কীসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন!
একমাস হয়েছে মাত্র রক্তাক্ত বিপ্লবের। শিক্ষার্থীরা শহীদদের স্মরণে শহীদি মার্চ এর ডাক দিয়েছেন। এখনো প্রতিদিন বিপ্লবে আহতদের কেউ না কেউ শহীদের কাতারে দাঁড়াচ্ছেন। অসংখ্য মানুষ হাত-পা-চোখ হারিয়েছেন। দুনিয়া অন্ধকার হয়ে গেছে তাদের কাছে। তাদের পাশে দাঁড়ানো বাদ দিয়ে তুলছেন অযথা আলাপ। এখনো শিক্ষা হয়নি ভাইলোক। চেতনাসমৃদ্ধ গণ্ডা-গণ্ডা বই লিখে, প্রকাশ করে, স্কুল কলেজে পড়িয়ে লাভ হয়নি তো কিছু। জেনারেশন জেড আসল সত্যটা জেনে গেছে। সুতরাং বুঝুন মিথ্যার সম্মিলিত নিনাদে যা মূলত মূর্খের বিক্ষোভ তাতে কিছু হয় না। অতএব মানুষের ইমোশনের কথা ভাবেন, ছ্যাবলামোটা বাদ দেন।
জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে ঘুম হারাম হওয়া একজনের প্রোফাইলে গেলাম। রক্তাক্ত জুলাইয়ের কোনো চিহ্ন নেই তার পুরো প্রোফাইল জুড়ে। তার বদলে রয়েছে পুতুপুতু কাব্য, ফুল-লতা-পাতার ছবি। তিনি সঙ্গীত নিয়ে বিপ্লবী হয়ে উঠেছেন। অবশ্য তিনি গত ১৫ আগস্টে একবার বিপ্লবী হয়েছিলেন, কালো করেছিলেন প্রোফাইল পিকচার। এছাড়া ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আমাদের সন্তানদের মৃত্যু তার বোধকে সামান্যতমও নাড়ায়নি। একেবারে ‘আলো আসবেই’ গ্রুপের মতন উল্টো বিপ্লবের বিপক্ষে আলাপ চালিয়েছেন। অথচ তার দেশপ্রেম উথলিয়ে উঠলো জাতীয় সঙ্গীত প্রশ্নে। বানভাসি মানুষ নিয়েও তার আলাপ ছিল না। ছিল না ভারতের সৃষ্ট বন্যা নিয়ে কোনো প্রতিবাদ। আজব না!
ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার গল্পে আসি। সাউথ ব্লক বসে আছে, কখন কার মুখ থেকে কী ফসকায় তা ধরে মৃতদেহে জীবনদানের আশায়। এরা হলো ছাগলের এক নম্বর বাচ্চা। দু’নম্বর বাচ্চা হলো পতিত স্বৈরাচারের সফ্ট পাওয়ার। যারা সাউথ ব্লকের দেখানো পথে দৌড়ায়। ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা হলো, যারা সাউথ ব্লককে কথা বলার সুযোগ করে দেয়। এই যেমন জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে একটা অযথা বিতর্কের সুযোগ করে দেয়া হল। পতিত স্বৈরাচারের সফ্ট পাওয়ারগুলো ওয়ার্ক করছে এবং তার লয় ধীর হলেও। তারা জানে, এখন কথা বললেও পতিত স্বৈরাচারকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। কিন্তু কথা জারি থাকলে, জুলাই ম্যাসাকারের ইতিহাসকে দৃশ্যপটের বাইরে রাখা যাবে। মানুষ কুতর্কে লিপ্ত থাকবে। এদের সাথে যোগ দেবেন না বরং শহীদদের কথা বলুন। যারা আহত হয়েছে তাদের চিকিৎসার দাবি জানান। যারা পঙ্গু হয়েছে, অন্ধ হয়েছে তাদের পুনর্বাসনের আওয়াজ তুলুন। বাদ দিন অযথা কূটতর্ক। আপনি আপনার কাজ করে যান। পতিতদের সফ্ট পাওয়ারকে ওয়ার্ক করার সুযোগ করে দেবেন না। এতে দেশের ক্ষতি হবে। পুনর্বাসনের কাজ পিছিয়ে যাবে। দেশ সংস্কারের গতি রুদ্ধ হবে। লাখ কোটি টাকা যারা লুট করেছে তাদের সেফ এক্সিট পাওয়া সহজ হবে।
চেয়ে দেখেন, তারা প্রতি পদে-পদে এই সরকারকে বিব্রত করতে চাচ্ছে। বিভ্রান্ত করতে চাচ্ছে। যাতে সরকার বড় কোনো ভুল করে ফেলে। সরকারকে সব দেখেশুনে এগুতো হচ্ছে। বিগত স্বৈরাচার প্রশাসন সাজিয়েছে যেভাবে, তিন স্তর পর্যন্ত তাদের লোক বসিয়ে রেখেছে। তারা চেষ্টা করছে একের পর এক সমস্যার সৃষ্টি করতে। জুডিশিয়াল ক্যুয়ের চেষ্টা থেকে আনসার বিদ্রোহ এখন জাতীয় সঙ্গীত বিতর্ক সব একই সুরে বাঁধা। সুতরাং বিপ্লবের সাথী ও সহায়কদের চিন্তা করে পা ফেলতে হবে, ফাঁদে পা দেয়া যাবে না। কূটতর্কের দোকান খোলা যাবে না। এসব দোকানকে উপেক্ষা করতে হবে। মাওলানা রুমি বলেছিলেন, উপেক্ষার চেয়ে বড় কোনো অস্ত্র নেই।