Logo
Logo
×

অভিমত

সভ্যতাগত পরিচয় কেন এবং কেন নয়?

ড. আশফাক আনুপ

ড. আশফাক আনুপ

প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৪১ পিএম

সভ্যতাগত পরিচয় কেন এবং কেন নয়?

ড. আশফাক আনুপ। ছবি: সংগৃহীত

সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের হাত ধরে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন আমরা দেখলাম তার পুরোভাগে যে রাজনৈতিক সংগঠনটিকে আমরা সক্রিয় থাকতে দেখেছি, সেই ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’র সাংগঠনিক ঘোষণাপত্রে এর অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে ‘সভ্যতাগত রাষ্ট্র বিনির্মান’-এর উল্লেখ দেখতে পাই। যদিও, সেখানে এই ধারণাটি স্পষ্ট করা হয়নি। একই ধরনের কথা শুনতে পাই প্রধান উপদেষ্টার সদ্যনিযুক্ত বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলমের সাম্প্রতিক ইষদস্পষ্ট বক্তব্যে- ‘… আপনার সামনের ভবিষ্যতটা কী হবে? … আপনি দুইটা সিভিলাইজেশন স্টেট’ (ভারত ও চীন) এর মাঝখানে বসে আছেন… আপনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রটাকে কোথায় দেখতে চাচ্ছেন? ... সভ্যতা বলতে কোনো ইসলাম, হিন্দু এসব আমি বলতেছিনা। এটা হচ্ছে বেঙ্গল বেসিনে আমরা বইসা আছি… একটা সিভিলাইজেশনাল কনফ্লুয়েন্স ঘটছে এইখানে… এইটা কতটুকু শক্তির জায়গা? দেয়ার আর মেনি “ইসলামস” ইন দিস ওয়ার্ল্ড; আমার এইখানেও একটা ইসলাম আছে… আমি কতটুকু সেইটাকে গ্লোবালি রিপ্রেজেন্ট করবো।’ এরপরে অবশ্য ছাত্রশক্তির সদস্য সচিব ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ হাসান পাকিস্তানের বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাতকালে গতকাল আরো বেশকিছুটা পরিষ্কার করে ওনাদের এই সভ্যতাগত পরিচয়ের বিবরণ দিয়েছেন ‘ইন্দো-মুসলিম সভ্যতার অংশ হিসেবে উপমহাদেশে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক ও সভ্যতাগত সম্পর্ক রয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক ও ভারসাম্যপূর্ণ দক্ষিণ এশিয়া গড়তে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার প্রয়োজন৷’  তবে, এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে এই ক্রমশপ্রকাশমানতা আরো কিছুদিন চলবে। এর পেছনে কারণ কি তা খুঁজতেই এই লেখার অবতারণা।  

স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী পৃথিবীতে কম্যুনিজমকে এক হাত নেবার পরে নব্য উদারতাবাদের সামনে তখন অস্তিত্বের প্রশ্ন- এখন কী হবে? ফলতঃ পশ্চিমা রাজনৈতিক বিশ্লেষণে ভূরাজনৈতিক ভবিষ্যদ্বাণী করার প্রবণতায় জোয়ার আসে। এরমধ্যে সবথেকে প্রভাবশালী দু’টো তত্ত্বের একটি আসে ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা’র হাত ধরে। রাজনীতিবিজ্ঞানে ‘এন্ড অব হিস্টোরি’ বা ‘ইতিহাসের ইতি’ ডাকনামে পরিচিতি এই তত্ত্বের মূলকথাটি এই— বিশ্বব্যাপী নব্য উদারতাবাদি আদর্শগুলোই হতে যাচ্ছে ইতিহাসের সরলরৈখিক বিবর্তনের সর্বশেষ ধাপ। বিশ্বজুড়ে নানান ভিন্নতা থাকবে, সংঘাত থাকবে ঠিকই, কিন্তু সকল সমাজই দিনশেষে আর্থসামাজিকভাবে নব্য উদারতাবাদি আদর্শগুলোকেই প্রতিষ্ঠা করার দিকে ধাবিত হবে। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানকে ফুকুয়ামা নব্য উদারতাবাদের চূড়ান্ত জয়যাত্রার সূচনা ও ইতিহাসের ইতি ঘটার আরম্ভ হিসেবে নির্দেশ করেন।

এর ঠিক অব্যবহিত পরেই এই তত্ত্বটির প্রধান প্রতিতত্ত্ব হিসেবে উঠে আসে স্যামুয়েল হান্টিংটনের ‘ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন’ বা ‘সভ্যতার সংঘাত’ তত্ত্বটি। যার মূলকথাটি এমন— স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বে ইতিহাসের বিবর্তন স্থির তো হবেই না, বরং ভূরাজনৈতিক সঙ্ঘাতের নতুন ভিত্তি হিসেবে উঠে আসবে কয়েকটি প্রধান বৈশ্বিক সভ্যতা। আগামী বিশ্ব মূলত হতে যাচ্ছে এইসব পরষ্পরবিরোধী সভ্যতার সংঘাতের ক্ষেত্র যেখানে প্রধান মোকাবিলা হতে যাচ্ছে ‘পশ্চিমা সভ্যতার’  সাথে ‘ইসলামি সভ্যতার’। এই সভ্যতার সংঘাতের বিজয়ীপক্ষই ইতিহাসের ভবিষ্যতকে রূপায়িত করবে। 

পশ্চিমা ভূরাজনৈতিক নীতিনির্ধারণে এই দুটো তত্ত্বই সর্প এবং ওঝা হিসেবে কার্যকর হয়ে চলেছে গত প্রায় চার দশক যাবত। উপরিতলে এগুলোকে পরষ্পরবিরোধী তত্ত্ব বলে দাবি করা হলেও, পশ্চিমা, বিশেষত মার্কিন নব্য-উপনিবেশবাদী পররাষ্ট্রনীতিতে ফুকুয়ামা এবং হান্টিংটন যথাক্রমে সফট পাওয়ার ও হার্ড পাওয়ারের প্রধান চালিকানীতি হিসেবে কাজ করছে। সহজ করে বললে বলা যায়, ‘এন্ড অব হিস্টোরি’ তত্ত্ব বিশ্বায়িত পৃথিবীর যে চূড়ান্ত নব্য উদারতাবাদি স্বপ্ন দেখায়, সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন করা হচ্ছে নানান কল্পিত সভ্যতার পরষ্পরবিরোধী সঙ্ঘাত উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে। এজন্যই আমরা দশকের পর দশক ভর ‘ইসলামিক’ বা ‘চৈনিক’ বা ‘গোঁড়া খ্রিষ্টিয়’দের সভ্যতার সাথে লড়ে ‘পশ্চিমা’ সভ্যতার আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক উদারতা, গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠা বা উদ্ধারের গল্প দেখে ও শুনে চলেছি আজতক। এখানে একটা ব্যাপার বোঝা জরুরি। ভূরাজনৈতিক ভবিষ্যদ্বাণীগুলো (prophecy) কোনো অলৌকিক যাদুমন্ত্র না; এগুলোর সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ভর করে মূলত তিনটি সম্ভাব্য চিন্তাভঙ্গির (school of thought) আংশিক, পূর্ণ বা মিলিত বাস্তবায়নের উপরে। প্রথমটি অনুকরণ (replication) তত্ত্ব, দ্বিতীয়টি কাকতাল (coincidence) তত্ত্ব এবং তৃতীয়টি পুনরাবৃত্তি (recurrance) তত্ত্ব। হান্টিংটনের হাত ধরে ফুকুয়ামার কল্পিত পৃথিবীর দিকে যে যাত্রা, সেখানে আদতে কাকতাল বা পুনরাবৃত্তির কিছু নেই; গোটা ব্যাপারটিই ‘এজ অব এক্সপ্লোরেশন’ কালীন ইউরোপীয় উপনিবেশিক অভিযানগুলোর মতো একই প্রক্রিয়ার পৌনঃপুনিক অনুকরণমাত্র। এই তত্ত্বগুলো কেবল সেই অনুকরণের জন্য দরকারি কাঠামো প্রদান করে।

এই সভ্যতার সঙ্ঘাতকে সক্রিয়করণের জন্য দুনিয়াব্যাপী সভ্যতাগত পরিচয়ের উৎপাদন ও অনুকরণের প্রক্রিয়াটি তাই নিয়মিত চলমান। মানব সমাজ ও রাজনীতির বিবর্তনে রাজ্য ও সাম্রাজ্য যেমন স্বাভাবিক ধাপ, ঔপনিবেশিকতা ঠিক তেমনটাই অস্বাভাবিক ঘটনা। তাই রাজ্য বা সাম্রাজ্যপ্রসূত গোষ্ঠীচেতনা যে পরিচয়ের রাজনীতির জন্ম দেয় তা মৌলিকভাবেই তথাকথিত এই সভ্যতাপ্রসূত রাজনৈতিক প্রচেষ্টা থেকে ভিন্ন। ঐতিহাসিক জাতীয়তাবোধ বা সাম্রাজ্যিক সীমানা যে জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়, তা থেকে উপনিবেশসুখী এই সভ্যতাভিত্তিক পরিচয় ভিন্ন। বলাই বাহুল্য, শেষোক্তটি কৃত্রিম। যুক্তি আসতে পারে যে, সভ্যতাগত পরিচয়ের ব্যাপারে ইতিবাচক থাকা মানেই তো ‘সভ্যতার সঙ্ঘাত’-এর ধারণায় বিশ্বাস রাখা না। এব্যাপারে অধ্যাপক অমর্ত্য সেন বলছেন, ‘এমনকি “সভ্যতাগত সঙ্ঘাত” তত্ত্বের ‘বিরোধীরাও’ এই তত্ত্বের বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করে তুলতে পারে যদি তারা গোটা বৈশ্বিক জনসমগ্রের এই (সভ্যতাকেন্দ্রিক) একক শ্রেণীবিভাগকে স্বীকার্য হিসেবে ধরে নেয়। …উভয় চিন্তাধারাই ‘কোনো এক সভ্যতার অংশ হওয়ায় মানুষ মাত্রই কাউকে একই ছাঁচে অনুধাবন ও বৈশিষ্ঠায়িত করা যায়’ এধরনের সরলায়িত ধারণায় বিশ্বাস করে।’  অধ্যাপক সেন উদাহরণ হিসেবে দেখিয়েছেন যে হান্টিংটনের সভ্যতাভিত্তিক বিভাজনে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সমস্তটুকুকে ‘হিন্দু সভ্যতা’ হিসেবে দেখানোর বিষয়টিকে ভারতরাষ্ট্রের হিন্দুত্ববাদিরা কীভাবে লুফে নিয়েছে। 

এমনকি, সাম্প্রতিক সময়েও যখন রাহুল গান্ধী ‘ভারত কোনো জাতি নয়, বরং সংলাপ’ এমন বয়ানকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন, তখন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডানপন্থি অধ্যাপক ড. অবিনাশ প্রকাশ সিং’দেরকে আমরা বলতে শুনি যে, ডানপন্থিগণ ভারতকে জাতিরাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয়জাতি নয় বরং ‘সভ্যতা রাষ্ট্র’ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন এবং এই সভ্যতাভিত্তিক পরিচয়কেই ভারতরাষ্ট্রের অন্তর্গত বৈচিত্রের রক্ষাকবচ বলে মনে করছেন! যদিও ডানপন্থি শাসিত ভারতরাষ্ট্রে বৈচিত্র ও ভিন্নতার বাস্তবতা যে আদতে কেমন তা আমরা সকলেই জানি! ‘জাতি নয়’ বলার মাধ্যমে ভারতীয় ‘জাতিরাষ্ট্রের’ যে ধারণাটিকে দ্বন্দ্বের সামনে নিয়ে ফেলেছেন রাহুল গান্ধী, সেই দ্বন্দ্ব উৎরাতে ডানপন্থিদেরকে আমরা ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদ’ নামক রাষ্ট্রীয়-জাতীয়তার ধারণার পরিবর্তে ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’ নামক সভ্যতাগত পরিচয় আঁকড়ে ধরতে দেখি।  

উল্লেখ্য, ভারতরাষ্ট্রীয় ডানপন্থিদের রাষ্ট্রচিন্তার ব্যাপারে নাহিদ বা মাহফুজ ঠিকই বলেছেন- যা আগেই আলোচিত হয়েছে। যদিও চীনের ব্যাপারে তাদের বোঝাপড়ার সঠিকতা প্রশ্নবিদ্ধ—কেননা চীন সভ্যতাগত পরিচয়ের পরিবর্তে রাষ্ট্রীয়ভাবে চৈনিক জাতীয়তাবাদের ব্যাপারেই বরাবর উচ্চকিত। শুধু তাই নয়, চীন ভৌগলিক জাতিভিত্তিক পরিচয়ের সামাজিক প্রপঞ্চকে নিজদেশে সমর্থনের পাশাপাশি ‘বেইজিং কনসেনসাস’-এর মাধ্যমে ‘ওয়াশিংটন কনসেনসাস’-এ প্রস্তাবিত নব্য উদারতাবাদি বৈশ্বিকতাবাদি অর্থনৈতিক ব্যবস্থারও সরাসরি বিকল্প প্রস্তাব করে। বৈশ্বিক পুঁজির বিপরীতে- রাষ্ট্রচালিত, স্থানীয় প্রয়োজনভিত্তিক অর্থনীতি ও জাতীয় পুঁজি গঠনের ব্যাপারে উন্নয়নমুখি রাষ্ট্রগুলোকে উদ্বুদ্ধ করে, যা তাদের স্ব স্ব ভৌগলিক জাতীয়তাবাদের সহায়ক। সুতরাং চীনকে সভ্যতারাষ্ট্র হিসেবে ধরে নেয়াটা চীনের নিজস্ব নীতিরই পরিপন্থী; তবে মার্কিন ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তা লাভজনক। 

চিত্র ১. বাংলা অঞ্চলে পরিচয়বাদী রাজনৈতিক ধারাসমূহের মিথস্ক্রীয়া এবং স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের ক্রমবিবর্তনের ধারা [১৯৭২ > ১৯৭৯ > ২০২৪(?)] ও সম্ভাব্য বাঁক।  

যাহোক, ছাত্রশক্তির কুশিলবগণের বক্তব্যের বিবর্তনে ফেরত আসি। বেশকিছুদিন পানি মাপার পরে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সামষ্ঠিক পরিচয়ের ব্যাপারে তাদের মুখ থেকে প্রথমে ‘সভ্যতা’, পরে ‘না মুসলিম, না হিন্দু, তবে বৈশ্বিকভাবে উপস্থাপনযোগ্য বঙ্গীয় ইসলামি সভ্যতা’’ এবং এখন ‘ইন্দো-মুসলিম সভ্যতা’- এই ক্রমবিকাশ লক্ষণীয়। 

উল্লেখ্য, সর্বসম্প্রতি প্রকাশিত ‘ইন্দো-মুসলিম’ পরিচয়টি অবশ্য এই ভূখন্ডে নতুন নয়। আদতে সর্বভারতীয় একজাতিতত্ত্বের প্রতিক্রিয়ায়, ভারত মহাদেশের উম্মাহপন্থিদের ‘রিয়েলপলিটিক’-এর সূত্রে বিকাশলাভ করা ‘হিন্দুস্তানি মুসলমান’ পরিচয়টির সমার্থক এই পরিচয়টি, যা দ্বি-জাতিতত্ত্বের মূলকথা (চিত্র ১ দ্রষ্টব্য)। তবে, এও শেষ কথা নয়। যেহেতু দ্বি-জাতিতত্ত্ব আদতে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদেরই নামান্তর, একে ‘জাতীয়তাবাদ’ না বলে, বিশ্বজনীন সভ্যতা হিসেবে উপস্থাপন করার কৌশলগত কোনো একটি কারণ নিশ্চয়ই আছে। আমার আশা আরো খানিকটা পানি মাপা শেষ হলে নাহিদ বা মাহফুজ বা তাদের সংগঠনের অন্য কারো কাছ থেকে আমরা আরো স্পষ্টভাবে এই পরিচয়ের পরিচয় পাবো। আপাতত কিছু প্রশ্ন ও অনুমান রাখা যাক। 

চিত্র ২. স্যামুয়েল পি হান্টিংটন এর ‘ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনস অ্যান্ড দ্য রিমেকিং অব ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ অনুসারে সভ্যতাবিভক্ত পৃথিবীর মানচিত্র।
প্রথমত, বাংলাদেশ রাষ্ট্রে প্রচলিত জাতীয়তাবাদের ধারণাগুলোকে মেয়াদোত্তীর্ণ ধরে নিয়ে, হান্টিংটনদের পরিপত্র মেনে (বা না মেনে) বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য যদি কোনো বিশ্বজনীন সভ্যতাগত পরিচয়কে গ্রহণ করতে হয়, তবে সেই পরিচয় যে কেবল ‘ইন্দো-মুসলিম’ পরিচয়বাদেই থেমে থাকবে তার নিশ্চয়তা নেই। বরং এই আলাপের পাশাপাশি হান্টিংটনের মানচিত্রটি রেখে চোখ বুলালে মনেই হবে যে, মাঝে-সাঝে বঙ্গীয় ইসলামের স্বাতন্ত্র দাবি করা হলেও জ্ঞানত বা অজান্তে বৈশ্বিক ‘ইসলামিক সভ্যতা’র অংশ হিসেবেই বাংলাদেশের জনগণের সামষ্ঠিক ‘সভ্যতাগত’ পরিচয়ের চাকাকে পুনরাবিষ্কারের চেষ্টা চলছে এখন (চিত্র ২ দ্রষ্টব্য)। তবে সেটা মূল সমস্যা না। সমস্যা হলো, এর পাশাপাশি যখন আমরা দেখছি যে সরকারঘনিষ্ট মওদুদিবাদীদের সাথে দেওবন্দিদের অভূতপূর্ব কৌশলগত করমর্দন হচ্ছে, খেলাফতপন্থি হিজবুত তাহরীর’-এর প্রকাশ্য পৌনঃপুনিক মিছিল করছে, আনসারুল্লাহ বাংলার প্রধান তাত্ত্বিকের হঠাৎ কারামুক্তি ঘটছে—এজাতীয়ত ঘটনাগুলোর বিন্দু মেলালে বোঝা যাচ্ছে যে সভ্যতা উৎপাদনের সমান্তরালে হান্টিংটনের প্রফেসি মেনে ‘সভ্যতার সঙ্ঘাত’ উৎপাদনের কার্যক্রমও এখানে চলমান। যা একটি বিপদসঙ্কুল অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থায় থাকা রাষ্ট্রে ব্যাপক ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার নামান্তর। 

অবশ্য অনুমিত এই ভূরাজনৈতিক সংঘাতের অনুমানে ওনারা একমত না হতে পারেন। সেক্ষেত্রে সম্পূরক প্রশ্ন চলে আসে। আপনাদের উদ্দেশ্য যদি ‘ভূরাজনৈতিক সংঘাত’ না থাকে, তবে দেশের প্রচলিত জাতীয়তাবাদি পরিচয়(গুলো)কে উপেক্ষা করে সংঘাতসুখি পশ্চিমা ভূরাজনৈতিক কৌশলকে সরাসরি সহযোগিতা করে এমন যুযুধান নয়া পরিচয়ে প্রবেশ করতে আপনাদের এতো আগ্রহ কেন? 
বাংলাদেশকে বৈশ্বিক সংঘাতের ক্ষেত্র হিসেবে কাঠামোগতভাবে প্রস্তুত করা বাদে আর ঠিক কী জন্য এর প্রয়োজন? নতুন যে পরিচয় কোটি কোটি সমস্যাসঙ্কুল মানুষের জন্য বাস্তব জীবনে প্রায়োগিক না হয়ে, বৈশ্বিক সংঘাতকে দেশে আমন্ত্রণ করে আনতে পারে, সেই পরিচয়ের ডঙ্কাটি বারবার বাজানো হচ্ছে কাদের স্বার্থে?

লেখক : প্রভাষক, কিংস কলেজ লন্ডন, পরিচালক, বাঙালিত্ব গবেষণা উদ্যোগ।

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন