যে রাষ্ট্র ও রাজনীতির স্বপ্ন আমাদের এবং তা টেকানোর তত্ত্ব
জুলাই ম্যাসাকার। আগস্ট ভিক্টরি। এই দুই বিষয় যদি আমরা অনুভব করি তাহলেই আমাদের বর্তমান রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক চিন্তা সম্পর্কে বুঝতে পারবো। জুলাই ও আগস্ট ‘২৪ হলো সেই ইনক্লুসিভ রাষ্ট্র ও রাজনীতির দৃশ্যমান চিত্র। এই যে ঘটে যাওয়া বিপ্লবের দিকে তাকালে আমরা বুঝতে পারবো আসলে রাষ্ট্র ও রাজনীতিটা কী। এই বিপ্লবে আমাদের ভেতরে নিজেদের অজান্তেই একটা একাত্মতা অনুভব করেছি।
কীভাবে! বলছি শুনুন। আপনি জেনারেশন জেডের চিত্রকর্মের দিকে তাকান যা দেয়ালে আঁকা। হ্যাঁ, ক্যালিগ্রাফিও চিত্রকর্ম। গ্রাফিতিও তাই। এখানেই ইনক্লুসিভ বিষয়টি। একদিকে মাদ্রাসা ছাত্র আরবিতে ক্যালিগ্রাফি আঁকছে, পাশেই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আবু সাঈদ, মুগ্ধের ছবি আঁকছে। কারো সাথে কোনো সংঘাত নেই।
অথচ একসময় এখানেই ভাগ করে দেওয়া হতো। যার ফলে ইনক্লুসিভ রাষ্ট্র ও রাজনীতি আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। কিন্তু এবারের বিপ্লব যা জেনারেশন জেডের হাত ধরে এসেছে, তা করে দেখিয়েছে। মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সব এক হয়ে গেছে। ধর্ম ও সংস্কৃতির বিরোধ যেটা ছিল সেটাও মিটে গেছে। আমাদের জেনারেশন এক্স আর জেনারেশন জেড সব মিলেমিশে একাকার। এটাই বাংলাদেশের মানুষের মূল পালস। গান চলছে, শিক্ষার্থীরা গলা মেলাচ্ছে। মাদ্রাসা ছাত্ররা তাতে প্রতিবাদ করছে না। তারাও গাইছে, তাদের মত করে বাদ্যযন্ত্র ছাড়া। কোথাও বিভেদ নেই। সবাই সবাইকে স্পেস করে দিচ্ছে। এটাই সেই ইনক্লুসিভ রাষ্ট্র ও রাজনীতি। যে রাষ্ট্র ও রাজনীতি আমাদের স্বপ্ন ছিল।
এই যে স্পেস দেওয়ার অবস্থাটা সৃষ্টি হলো কীভাবে প্রশ্নটা এখানেই। আমার যাদের জেনারেশন জেড বলি। আমাদের আক্ষেপ ছিল তারা একটা মনিটর নির্ভর জেনারেশন। কিন্তু আমরা ভুলতে বসেছিলাম মনিটরে সবই চলে আসে গুগলের যুগে। পড়া যায় ইতিহাস, দর্শন থেকে বিজ্ঞান সব। যার ফলেই বিগত স্বৈরাচারের তৈরি করা বয়ান জেনারেশন জেডকে প্রভাবিত করতে পারেনি। আমাদের জেনারেশন এক্স, বিশেষ করে জেনারেশন ওয়াই এসব বুঝতেই পারেনি।
সো-কল্ড শিক্ষক এবং স্বৈরাচারের মন্ত্রী আরাফাত মার্কাদের মাথাই ঢুকেনি যে, ক্লাসের বানানো বয়ানের চেয়ে জেনারেশন জেড নির্ভর করেছে মনিটরের ওপর। তারা বানানো বয়ানের বিপরীতে সত্যটাকে খুঁজে বের করেছে। তারা বুঝেছে ইনক্লুসিভ রাষ্ট্র ও রাজনীতির অন্তরায় হচ্ছে অন্যকে স্পেস না দিয়ে পুরো স্পেসটাকে নিজে দখল করে রাখার চেষ্টা। তারা এসব বুঝেই নিজেদের মধ্যে একটি নিজস্ব চিন্তা দাঁড় করিয়েছে। তৈরি করেছে নিজস্ব তত্ত্ব।
আজকের বিপ্লবটা সেই তত্ত্বের ওপরই। অনেকে ’২৪ এর পরিবর্তনকে বিপ্লব বলে মানতে চান না। কারণ তাদের ধারণা আজও সেই বলশেভিক বিপ্লবকে কেন্দ্র করেই। অথচ সময়ের সাথে বিপ্লবের ধরনও পাল্টে যায়। নতুন তত্ত্ব আসে, নতুন চিন্তায় বিপ্লবের চেহারাতেও থাকে নতুনত্ব। সুতরাং যারা বলশেভিক বিপ্লবের সাথে কিংবা অতীতের যে কোনো বিপ্লবের সাথে বর্তমানের বিপ্লবকে মেলাতে চান, তারা ভুল করেন। যারা চিন্তার ধরণ পাল্টান না, সময়ের সাথে টিউনড হন না, তারাই মূলত মৌলবাদী এবং তারা মার্কসিস্ট হলেও।
নতুন বিপ্লবে কোনো একক নেতৃত্ব থাকে না। মাস্টারমাইন্ড কথাটা ইদানীং উঠে আসছে। কথাটা যারা তুলে আনছেন তারা যদি জেনে বুঝে আনেন তাহলে ধরে নিতে হবে তারা প্রতিবিপ্লবী। কারণ ’২৪ এর বিপ্লবের কোনো একক নেতৃত্ব নেই। একক নেতৃত্বেে সময়ে বিপ্লব সংঘটিত করার চিন্তা স্রেফ বাতুলতা মাত্র। এবারের বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে একটি সমন্বিত ধারায়। সেই ধারাটি বোঝার ক্ষমতা আমাদের দেশের প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলোর ছিল না। একক নেতৃত্বে বিপ্লব ঘটানোর চেষ্টা দৃশ্যত ব্যর্থ হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো ব্যর্থ হয়েছে।
কারণ, তারা স্পেস ছাড়তে চায়নি। আর চাইলেও সেই ছাড়াতেও ছিল স্বার্থগত চিন্তা। যা ’২৪ এর বিপ্লবের মূল চিন্তার বিপরীত। যার ফলেই স্বৈরশাসন টিকে গেছে দেড় দশকেরও বেশি। জেনারেশন জেড এই ব্যাপারটি ধরতে পেরেছিলো। যে কারণে তারা একক নেতৃত্বের চিন্তা না করে সকলকেই নেতা করে তুলেছিলো। তারা বুঝেছিলো মূর্তি বানানো যেমন সহজ, ভাঙাও তেমন সহজ। তাই তারা কারো মূর্তি বানাতে চায়নি।
ফ্যাসিজম জন্ম নেয় সিম্বল থেকেই। তাই তারা সিম্বলিক কোনো কিছু করতে চায়নি। আওয়ামী লীগ প্রচলিত ধারার রাজনৈতিক দল বলেই বিষয়টা ধরতে পারেনি। তাই তারা ছয় সমন্বয়ক আটকে ভেবেছিল, আন্দোলনের নেতৃত্ব খতম করে দেয়া গেছে। কিন্তু সেই যে সর্বব্যাপী নেতৃত্ব সে কারণেই ছয় সমন্বয়ককে আটকে কোনো লাভ হয়নি। এগিয়ে এসেছে অন্যরা। স্তরের পর স্তর নেতৃত্ব তৈরি করা ছিলো। এক স্তর গেলে আরেক স্তর সামনে এসে দাঁড়াবে। চমকে গিয়েছিল স্বৈরাচার। তারা বুদ্ধিতে পরাজিত হয়ে শক্তিতে টিকে থাকতে চেয়েছিল। নির্বিচার গুলি, পাখির মতন মানুষ হত্যা তারই ফসল। ভ্যানে লাশের স্তূপ তার প্রমাণ।
কেন জেনারেশন জেডের প্রয়োজন হলো বিপ্লব ঘটাতে। এমন প্রশ্ন করতে গেলে বলা যায় এটা অবশ্যম্ভাবী ছিল। কারণ জেঁকে বসা স্বৈরাচারের আসন টলাতে দরকার ছিল শুদ্ধ রক্তের। যাতে কোনো পাপ-পঙ্কিলতা-লোভ নেই। পুরানো রক্তে এসব থাকায় বিপ্লব সংঘটিত করা সম্ভব হচ্ছিল না। লোভ যাদের আছে তাদের দ্বারা আর যাই হোক বিপ্লব সম্ভব নয়। এখানেই গতানুগতিক আন্দোলন আর বিপ্লবের পার্থক্য। যার প্রমাণ আমরা বারবার দেখতে পাচ্ছিলাম। চেষ্টা যে হচ্ছিলো না তা নয়। কিন্তু তা ব্যর্থ হচ্ছিল।
বিএনপির মতন একটি বড় রাজনৈতিক দল বিশাল সমাবেশ, রোডমার্চসহ সকল কর্মসূচি করেও আন্দোলন জমাতে পারছিল না। কারণ তারাও আওয়ামী লীগের মতন প্রচলিত ধারার দল। তাই তারা তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। তরুণ প্রজন্ম দেখছিল ইনক্লুসিভ রাষ্ট্র গড়ার যে উপাদান তা এসব প্রচলিত দলগুলোর মধ্যে অনুপস্থিত। কারণ এসব দলের মধ্যে রাজনৈতিক তত্ত্বের কোনো জায়গা নেই। বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা যা তত্ত্ব নির্মাণ করে তা নেই।
উল্টো এসব দলে যারা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করেন তারা অবহেলিত, কোণঠাসা। সঙ্গতই এসব দল নতুন তত্ত্ব তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছিল। তত্ত্ব তৈরি না হলে কৌশলও তৈয়ার হয় না। ভুল কৌশলে, পুরানো ধারার পুনরাবৃত্তি বিএনপির মতন রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন ব্যর্থ করে দিচ্ছিল। মানুষও ভরসা করে উঠতে পারছিল না তাদের ওপর। বিপরীতে জেনারেশন জেড এসব ব্যর্থতার কারণ খোঁজার চেষ্টায় ছিল। তারা প্রতিটা ব্যর্থতাকে বিশ্লেষণ করে নতুন তত্ত্বের তালাশে ছিল। যে তত্ত্ব সাধারণ মানুষকে জাগিয়ে তুলতে পারে। যে কৌশলে বিপ্লবে একাত্ম হতে পারে মানুষ। তাই হয়েছিল। দেড় যুগের বেশি সময় জেঁকে বসা স্বৈরাচারকে পালাতে হয়েছিল সেই কৌশলের কাছে পরাজিত হয়ে।