প্রথম আলোর লোগো
পছন্দসই ইস্যু ধরে ধরে পরিমিত প্রতিবাদ আর নিজের অপছন্দের কারও ভাল কাজেও নির্লজ্জ নীরবতার নীতি অবলম্বন করা বাংলাদেশের পোষ্য বুদ্ধিজীবিতার এক অনন্য বৈশিষ্ট্য । বৈশ্বিক পরিসরের বাস্তবতা কিংবা নীতি শাস্ত্র অনুযায়ী সত্য-মিথ্যা, রাত-দিন, সাদা-কালো, ভালো-মন্দ, অধম-উত্তম জাতীয় বিপরীত জোড় তথা বাইনারি অপোজিশন সর্বজন স্বীকৃত। তবে বাংলাদেশের কথিত এই বুদ্ধিজীবীতায় এর কোনও বাস্তব উদাহরণ পাওয়া যায় না বললেই চলে। বরঞ্চ বিশেষ উদ্দেশ্য সামনে রেখে তারা খুঁজে নেয় সত্য ও মিথ্যার মধ্যে কোনো একটি অর্ধসত্য কিংবা অর্ধমিথ্যাকে যা আবার প্রয়োজন অনুযায়ী রদবদল করা যায়। আর এই কাজটিই দীর্ঘদিন সতর্কতার সঙ্গে করে যাচ্ছে একটি দৈনিক। নাম ‘প্রথম আলো’।
সত্যোত্তর যুগের উদাহরণ টেনে এটাকে অনেকে অপব্যাখ্যা করতে পারেন। কিন্ত তাদের চিহ্নিত কিছু অসৎ উদ্দেশ্য জনগণের সামনে আগেই উন্মোচিত হওয়ায় সেটা কোনোভাবেই ধোপে টেকে না । Crises of the Republic; lying in politics, civil disobedience on violence, thoughts on politics, and revolution এর ক্ষেত্রে হান্নাহ অ্যারেন্ট (Hannah Arendt) খুব সুন্দর করে দেখিয়েছেন সত্যোত্তর কথাটি সাম্প্রতিক নানা অভিধার সঙ্গে কীভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। আমরা উত্তরাধুনিকতাবাদ কিংবা বহু বিশ্লেষিত প্রপঞ্চ হিসেবে আপেক্ষিকতাবাদকে টানতে পারি। ওদিকে রাজনীতিতে মিথ্যাবাদিতার বিভিন্ন রূপ যেমন অসত্যতা, ছলনা-প্রতারণা, ইচ্ছাকৃত মিথ্যা প্রভূতি নিয়েও বিশ্লেষণের নানা মত ও পথ রয়েছে। উদ্দিষ্ট পত্রিকায় যে সংবাদ ছাপা হয়, যে মন্তব্য প্রতিবেদন আসে কিংবা কলাম লেখা হয় তার বিভ্রান্তিকর উপস্থাপনার হেতু তথৈবচ।
নৈতিক, জ্ঞানতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক বিতর্ক নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে হতে পারে। কিন্ত উদ্দেশ্যমূলক অর্ধসত্যগুলোকে যখন রংচং মাখিয়ে সত্য হিসেবে প্রমাণ করা হয় কিংবা অর্ধেক মিথ্যার উপর সত্যের প্রলেপ দিয়ে পুরো ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়া হয় সেটা ঐতিহাসিক বাস্তবতায় ভয়ানক, বর্তমানের প্রেক্ষিতে জিঘাংসামূলক এবং ভবিষ্যতকে হুমকির দিকে ঠেলে দিতে পারে। এই অনভিপ্রেত বিষয়টি জেনে শুনেও দীর্ঘদিন অনুশীলনের মধ্যে রেখেছে জনপ্রিয় দৈনিক প্রথম আলো।
জুলাই বিপ্লব পরবর্তীকালের অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের চিরচেনা এই জাতীয় দৈনিকটির অস্থিরতা, খণ্ডিত সংবাদ উপস্থাপনের পাশাপাশি আগেই ভালো ছিলাম ধাঁচের বস্তাপচা সংবাদ প্রচারের সঙ্গে কিছু মতামত ও মন্তব্য কলাম ঠিক এপথেই হাঁটছে। তারা সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা প্রবাহকে খণ্ডিত তথ্য প্রমাণের মধ্য দিয়ে আরোপিত সত্য হিসেবে তুলে ধরছে। পাশাপাশি ধামাচাপা দিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘ পনের বছরের সব ভয়াবহ অপরাধ। ঠিক এই সংবাদকে সামনে রেখে অভিন্ন পত্রিকায় লেখা হচ্ছে কলাম ও মন্তব্য প্রতিবেদন যা খণ্ডিত সংবাদের একাংশের ভাব সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদ তোষণ এবং নির্যাতিতের কণ্ঠস্বর রোধের অপচেষ্টা হিসেবে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায়।
উদাহরণ হিসেবে নেওয়া এক দৈনিক প্রথম আলোয় গত ২৪ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে ছাপা হওয়া ‘বিএনপি নিজেকে কতটা বদলিয়েছে’ শীর্ষক নিবন্ধটিকে। জুলাই বিপ্লব শেষ হওয়ার ঠিক পর পর দেশের ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে সংঘটিত কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে ফোকাসে লেখাটি রচনা করেছেন সোহরাব হাসান। সর্ষের ক্ষেতে কোনো ফুলের ডগায় বসে থাকা মৌমাছিকে যেভাবে জুম করে ছবি তোলেন ফটোগ্রাফাররা ঠিক সেভাবে তিনি গত ১৬ বছরে ঘটে যাওয়া শতসহস্র অপকর্ম-কুকর্ম পাশ কাটিয়ে থেকে বেছে নিয়েছেন সাম্প্রতিক সময়ের বিশেষ কিছু বিষয়। সামাজিক বিজ্ঞানের গবেষণায় যেমন নানা প্যারামিটার রেখে স্যাম্পলিং করা এখানে সোহরাব হাসানের কাছে ‘অপরাধকর্ম’ থেকে স্যাম্পলিং তথা নমুনায়নের মানদণ্ড বিএনপি।
শুরুতে সুন্দর একটা ভূমিকা দিয়ে পাঠককে আকৃষ্ট করতে তিনি প্রসঙ্গত ‘ধ্বংস নয়, প্রতিশোধ নয়, প্রতিহিংসা নয়, ভালোবাসা, শান্তি ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলি।’ শীর্ষক বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্য দিয়ে শুরু করেছিলেন। কিন্ত ক্রমশ তিনি বেছে বেছে বাংলাদেশেল নানা স্থানে দীর্ঘ দেড় যুগের নিষ্পেষণের বিপরীতে সংঘটিত বিচ্ছিন্ন কিছু অপরাধকে চিহ্নিত করেছেন। সেগুলোকে ফোকাসে রেখে বারংবার প্রমাণের চেষ্টা করেছেন- ‘দীর্ঘ পনের বছরের স্বৈরাচারের কোনো দোষ ছিল না। উপরন্তু সেই স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতনের পর বর্তমান পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে যার মূল দায় বিএনপির’। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন বাংলাদেশের প্রধান যে বিরোধী রাজনৈতিক দলটি এতোদিন ফ্যাসিবাদ পতনের আন্দোলন করে এসেছে দেশের সব সংকটের মূল দায় তাদেরই।
তিনি মিথ্যাচারকে নতুন মাত্রা দিয়েছেন মাসখানেক আগে জেল থেকে ছাড়া পাওয়া কল্পিত এক বিএনপি নেতার সঙ্গে হওয়া তার সংলাপের মধ্য দিয়ে। কল্পিত এই সংলাপে তিনি লাফ দিয়ে প্রশ্ন করেছেন ‘আপনারা অন্তর্বর্তী সরকারকে কত দিন সময় দেবেন? সেখানে উত্তর হিসেবে তিনি লিখেছেন ‘যত দিন সংস্কারকাজ শেষ করতে লাগে, তত দিনই দেব’। এক্ষেত্রে তিনি মূলত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দীর্ঘ মেয়াদ প্রাপ্তির আরাধ্য দাবি কল্পিত বিএনপি নেতার জবানে পাস করিয়ে নিয়েছেন?
তারপর তিনি দ্বিতীয় দফায় আরেকটি প্রশ্ন সাজিয়ে লিখেছেন ‘তৃণমূলের নেতা–কর্মীদের সামলাতে পারবেন তো? এখানেও তার ভয়াবহ বানোয়াট একটি উত্তর দৃশ্যমান। তার ভাষায় ‘তিনি অনেকটা হতাশার সুরে বললেন, ‘সামলাব কী? কেন্দ্রের নেতারাই তো মারামারি করছেন। আগে মারামারি থামাক, এরপর নির্বাচনের কথা ভাবা যাবে।’ অর্থাৎ স্বৈরাচার পতনের পর দেশের সার্বিক পরিস্থিতির দায় পুরোপুরি তিনি বিএনপি’র উপর চাপিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে এগিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে চাইছেন সুকৌশলে কিছু কল্পিত সংলাপের মধ্য দিয়ে।
দীর্ঘ লেখায় তিনি এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন ‘আমাদের দেশে ক্ষমতাসীনরা গায়ের জোরে সবকিছু করতে চান’ কিন্ত তিনি কোনোভাবেই এরসঙ্গে বিএনপিকে যুক্ত করতে পারেন নাই। কারণ তিনি যে সময়ের বাস্তব হোক আর কল্পিত হোক একটা গল্প ফেঁদেছেন সেই সময়কাল বিএনপি’র ক্ষমতার প্রতিনিধিত্ব করে না। বরঞ্চ এই সময়টাতে বিএনপি’র বেশিরভাগ নেতাকর্মীকে অনর্থক হয়রানি, জেল-জুলুম, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হামলা-মামলা, হত্যার হুমকি এমনকি আয়নাঘরে গিয়ে মানববেতর জীবন যাপন করতে হয়েছে।
ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলমসহ অনেক সামনের সারির নেতাকে গুম হতে হয়েছে। তাদের শীর্ষনেতা সালাউদ্দিন আহমেদকে গ্রেফতারের পর পাওয়া গিয়েছে পাশের অন্য একটি দেশে। প্রতাপশালী ফ্যাসিবাদী সরকারের কোনো অপকর্মের বিরুদ্ধে সামান্য প্রতিবাদ করতে গিয়ে সরাসরি গুলি খেয়ে মরতে হয়েছিল অনেক বিএনপি নেতাকর্মীকে। কৃষ্ণপদ রায়, আছাদুজ্জামান মিয়া, দীপক কুমার দাস, শিহাব উদ্দিনসহ প্রায় ১৫ জনের উপস্থিতিতে ২০১৫ সালের ২০ জানুয়ারি ঢাকার খিলগাঁও এলাকায় গুলিতে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়েছিল ছাত্রদল নেতা নুরুজ্জামান জনিকে।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনার শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি বাংলাদেশের বিভিন্ন বিভাগে মহাসমাবেশের ডাক দেয়। তখনও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী বাহিনীর হামলায় শহীদ হতে হয় আব্দুর রহিম, নুরে আলম, শাওন প্রধান, শহিদুল শাওন, আব্দুল আলিম, আফম কামাল, নূরে আলম, তানু ভূঁইয়া, মোহাম্মদ ইউসুফ এবং নয়ন মিঞাসহ অনেক নেতাকর্মীকে। এর বাইরে ক্ষমতাসীনদের দেশব্যাপী সন্ত্রাস, রাষ্ট্রীয় মদদে ব্যাংকলুট করে বিদেশে টাকার পাহাড় তৈরি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অনিয়ম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নৈরাজ্যসহ প্রতিটি অন্যায়ের সময় সোহরাব হাসান সাহেবদের কলমে লেখার মতো কালি ছিল না, হারিয়ে গিয়েছিল মুখের ভাষা, সীমিত হয়েছিল ভাব প্রকাশের উপযোগী শব্দভাণ্ডার।
শুধুই কী সোহরাব হাসান! তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রথম আলোর পোষা আরো কিছু কলমযোদ্ধা। ঠিক যেমন বৃষ্টির সময় কোনো শেডের নিচে আটকে পড়া জনতা বৃষ্টি ছাড়তেই হুমড়ি খেয়ে রাস্তায় নামে উনারা সেভাবেই জামার হাতা গুটিয়ে পরনের লুঙ্গি মালকোচা মেরে নেমেছেন কলম-কিবোর্ডের এক ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে। ‘সুস্থ রাজনীতি চর্চার প্রক্রিয়া শুরু হোক এবার’ কিংবা ‘নেতাকর্মীদের বেতন দিন, মানুষকে চাঁদাবাজি থেকে মুক্তি দিন’ ধাঁচের প্রায় প্রতিটি লেখা পড়তে গেলে মনে হয় একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলকে যেন টার্গেট করে আক্রমণ করা হয়েছে। তাদের লেখা পড়ে মনে হচ্ছে- যেন ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ পালিয়ে যায়নি, পতন হয়েছে বিএনপি’র!
বাস্তবতা হচ্ছে; দীর্ঘদিন স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অধীনে থাকার পর ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছে। এমন রাজনৈতিক শূন্যতায় হাসিনার লাঠিয়ালের ভূমিকায় থাকা দেশের পুলিশ বাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়; আর স্বৈরাচারী সরকারের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে নানা অপকর্ম করায় জনগণ সরাসরি তাদের শত্রুজ্ঞান করছে। ওদিকে দেশের বিচার বিভাগ থেকে হুট করে চেষ্টা করা হয়েছে প্রতিবিপ্লবের। আনসার বাহিনী গিয়ে আক্রমণ করছে ছাত্রছাত্রীদের। রাস্তায় যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করার মতো ট্রাফিক পুলিশও নাই বলে বাধ্য হয় স্বেচ্ছাসেবী ছাত্ররা দায়িত্ব নিয়েছে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের।
ইচ্ছা করেই তৈরি করা এমন ঘোলাটে পরিচ্ছিতিতে একদিকে পেশাদার দুষ্কৃতিকারীদের সাথে নিয়ে ডাকাতিতে নেমেছে ছাত্রলীগ-যুবলীগ, অন্যদিকে সংখ্যালঘুদের উপর কিছু হামলা করে এবং আরো কিছু কাল্পনিক ও অতিরঞ্জিত হামলার কাহিনী সোস্যাল মিডিয়া ও ভারতীয় গণমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে হাজারো শহীদ আর আহতদের উপর থেকে মিডিয়ার ফোকাস সরানো হচ্ছে। এমন বিশৃঙ্খল পরিবেশে কিছু মানুষ লুটপাট করার সুযোগ খুঁজবে, কিছু মানুষ তাদের উপর ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে চাইবে কিংবা কিছু মানুষ গত ১৫ বছরে নিজেদের হারানো বা দখল হয়ে যাওয়া সম্পদ পুররুদ্ধার করা চেষ্টা করবে এটাই স্বাভাবিক।
এই ‘কিছু’ মানুষের ভিড়ে যদি দেশের কোনো রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে কতিপয় নেতাকর্মী কিংবা তাদের নাম ভঙ্গিয়ে অন্য কেউও যদি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সুযোগ নেয় সেটাও তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। দেখতে হবে এমন ঘটনাগুলো থামানোর জন্য ঐ রাজনৈতিক দল কোন নির্দেশনা দিয়েছে কিনা কিংবা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে কিনা? আমরা দেখতে পেয়েছি- বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সরাসরি ঘোষণা দিয়ে বিশৃঙ্খলায় জড়িত ব্যক্তিদের দল থেকে বহিষ্কার করেছেন ও বিভিন্ন ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছেন।
অবাক হওয়ার কিংবা লজ্জার বিষয় সোহরাব হাসানের লেখাটিতে কোথাও দোষী নেতাকর্মীদের বহিষ্কারের কিংবা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি, সামান্যতম প্রশংসা করা হয়নি এমন পদক্ষেপের! উপরন্তু তিনি স্বপ্নের ঘোরে ভাবছেন ১৫ বছরের জঞ্জাল একসপ্তাহে সাফ হয়ে দেশ উন্নত বিশ্বে পরিণত হবে। অথবা তিনি হয়তো তার প্রিয় স্বৈরতান্ত্রিক শাসন কাঠামো ভেঙে পড়া ও স্বৈরশাসকের বিদায়কে মেনে নিতে পারছেন না।
উদ্দিষ্ট লেখাটির মতো পরিকল্পিতভাবে আরও অনেক লেখাতে ঠিক এমনটাই করা হচ্ছে। সেখানে শব্দের মারপ্যাঁচে কিছু ব্যাকুল বাসনা ব্যক্ত করার পাশাপাশি মনের সব ক্ষোভ উগরে দেওয়া হয়েছে দীর্ঘ দেড় যুগের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে বিপন্ন একটি রাজনৈতিক দলের নির্যাতিত নেতাকর্মীদের উপরে। যুক্তিবিদ্যার চিরচেনা শব্দে ‘পক্ষপাতদুষ্ট বাছাই’ তথা ইংরেজি ভাষায় যাকে চেরি পিকিং (Cherry picking) বলা হয় এটা তার নিকৃষ্টতম উদাহরণ নিঃসন্দেহে।
খেয়াল করলে দেখা গিয়েছে সোহরাব হাসানের উদ্দিষ্ট নিবন্ধের নাম ছিল ‘বিএনপি নিজেকে কতটা বদলিয়েছে’? গণতন্ত্রমনা মুক্তিকামী মানুষেরও ঠিক তেমনটাই প্রশ্ন ‘সোহরাব হাসান ও তার মতো অন্য লেখকদের পাশাপাশি সফট সাপোর্টিং ফ্যাসিবাদী কালচারাল ন্যারেটিভ উৎপাদনকারী পক্ষপাতদুষ্ট দৈনিক পত্রিকাগুলোও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ‘নিজেকে কতটা বদলিয়েছে? আপাত দৃষ্টিতে তাদের মধ্যে তেমন কোনো দৃশ্যমান বদল তো নেইই। উপরন্ত তারা ঘুরে ফিরে সুযোগ পেলেই পলাতক স্বৈরাচার যুগের বন্দনা এখনও জারি রেখেছে নানাভাবে।
জনমানুষের মধ্যে একটি ধারণা প্রতিষ্ঠিত যে প্রথম আলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ করে, দুর্নীতির সমালোচনা করে। তাদের দুর্বিনীত অবস্থান দখলদারিত্ব এমনকি ব্যাংক লোপাট এবং অর্থপাচারের বিরুদ্ধেও। ওদিকে খোদ প্রথম আলোর ওয়েবসাইটে দৃশ্যমান তালিকা থেকে দেখা গিয়েছে প্রথম আলো ট্রাস্ট ১০ জন ট্রাস্টির সমন্বয়ে পরিচালিত হয়। তাদের মধ্যে পঞ্চম জন সিঙ্গাপুরে অর্থপাচারকারী হিসেবে কুখ্যাত মুহাম্মদ আজিজ খান। তিনি একাধারে ট্রাস্টি, প্রথম আলো ট্রাস্ট। তবে তার মূল পরিচয় চেয়ারম্যান, সামিট করপোরেশন লিমিটেড। একইভাবে এই তালিকায় থাকা ব্যক্তিবর্গ নানাভাবে ফ্যাসিবাদ তোষণ এবং বিবিধ দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত। বিষয়টি প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রথম আলোর দ্বিচারিতা স্পষ্ট করেছে।
সংখ্যালঘু ইস্যুতে নতুন এক ধরনের বয়ান দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে প্রথম আলো। প্রতিদিন রাতের শেষ প্রহরে গাবতলী দিয়ে যতগুলো মহিষভর্তি ট্রাক ঢাকায় প্রবেশ করে তার সবগুলোর মাংস পরদিন সকালে যেমন গরুর মাংস হিসেবে বিক্রি হয়; প্রথম আলোর সংখ্যালঘু নীতি ঠিক তেমন। তারা সংখ্যালঘু বলতে বোঝে শুধুই আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের। এমনকি বিশেষ সংস্কৃতির অধিকারী চাকমা, মারমা, খাসিয়া, মনিপুরী, গারো কিংবা সাঁওতালদের ক্ষেত্রেও তাদের ধারণা অভিন্ন। এজন্যই তারা কল্পনা চাকমার অন্তর্ধান নিয়ে যুগের পর যুগ সংবাদ ছেপে গেছে, মাইকেল চাকমার গুম হওয়া নিয়ে কালেভদ্রে কথা বলেছে, কিন্ত ওমর ফারুক ত্রিপুরাকে গুলি করে হত্যার পর সেই সংবাদ তেমন কেনো গুরুত্ব পায়নি প্রথম আলোর পরিবেশনায়।
বর্ষীয়ান ব্যারিস্টার মঈনুল ইসলামকে একটি টকশোতে করা মন্তব্যের জের ধরে ‘নারীর অবমাননা’ শীর্ষক অভিযোগে হাস্যকরভাবে কারাগারে প্রেরণের ক্ষেত্রে প্রথম আলো ছিল নীরব। ঠিক একইভাবে ২০২৩ সালের ২৬ মে শুক্রবার বেলা পৌনে ১১টার দিকে জিনজিরা রোডে ছাত্রলীগ-যুবলীগ আক্রমণ চালায় একজন সংখ্যালঘু নারী নেত্রী নিপুণ রায়ের উপর। মেরে তার মাথা ফাটিয়ে দেওয়ার পরেও শুধু বিএনপি করার কারণে তিনি নারী কিংবা সংখ্যালঘু কোনোরকম স্বীকৃতিই পাননি। উপরন্তু সংবাদ প্রকাশ করা হয় ‘দুপক্ষের সংঘর্ষ’ হিসেবে। ২০২৩ সালের ২৯ জুলাই শনিবার বেলা ১২টার দিকে পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগ-যুবলীগ মিলে সাপের মতো পিটায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে। সেখান থেকে পুলিশ তাকে তুলে নেয়। ডিবি কার্যালয়ে নেওয়ার পর বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তিনিও যথারীতি সংখ্যালঘু হয়ে উঠতে পারেননি। আর যথারীতি প্রথম আলোর শিরোনাম ছিল ‘পুলিশের পিটুনি, ডিবিতে নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হলো গয়েশ্বরকে’।
জুলাই বিপ্লব শুরু হলে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ধারাবাহিক হামলার পাশাপাশি ছাত্রজনতার উপর নির্বিচার গুলি চালায় পুলিশ ও বিজিবি। এতে হাজারের উপর ছাত্রজনতা শহীদ হয়েছেন। সেইসঙ্গে আহত হয়েছেন কয়েকহাজার। অগণিত লাশ নিয়ে পুরো দেশে যেখানে শোকের মাতম চলছে প্রথম আলো সবার দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে ৭ আগস্ট ২০২৪ কবীর বকুলকে দিয়ে মিথ্যা সংবাদ ছাপায় ‘কোন প্রতিহিংসায় পুড়ল রাহুলের বাড়িটি’। চারদিকে শোকের মাতম, স্বজন হারানোর বেদনা আর আহতদের আর্তনাদ ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে সংখ্যালঘু ইস্যু। ভারতসহ বিশ্বের নানা দেশের গণমাধ্যমের দৃষ্টি তারা সেদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল এই সংবাদ প্রকাশের মধ্য দিয়ে। পরে রাহুল আনন্দ নিজেই জানান তার বাড়িতে কেউ আগুন দেয়নি। অন্য কোনো ভাবে আগুন লেগেছিল সেখানে। তবে ততক্ষণে সর্বনাশ যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে।
তরুণদের সক্রিয় অংশ্রগ্রহণে এবং রাজপথের সংগ্রামে তাদের সীমাহীন আত্মত্যাগে সদ্য সমাপ্ত জুলাই বিপ্লব আমাদের সামনে নতুন এক বাংলাদেশকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। বৈষম্যহীনতার প্রতিপাদ্য সামনে রেখে সবার জন্য বাসযোগ্য গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, মুক্তমত ও পথের অনুসারী সমৃদ্ধ এবং আধুনিক বাংলাদেশ গড়তে হলে সবার আগে দেশের গণমাধ্যম এবং সেখানে প্রতিনিধিত্বকারী লেখক-কলামিস্ট ও বুদ্ধিজীবীদের এই নষ্ট সেকেলে ধারা থেকে বেরিয়ে আসার বিকল্প কোনো পথ নেই। পাশাপাশি তাদেরকে এটাও বুঝতে হবে যে নিরপেক্ষতার মোড়কে ফ্যাসিবাদ তোষণ ও পুনর্বাসন বর্তমান বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। জুলাই বিপ্লবোত্তর নতুন বাংলাদেশে এসে সবকিছুই বদলেছে, তাই সবার মনে এখন প্রশ্ন জেগেছে প্রথম আলো বদলাবে কবে?
লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।