বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির মূল্যায়ন ও সামরিক বাহিনীর সংস্কার ভাবনা
ছবি: সংগৃহীত
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। হাসিনা অভ্যুত্থানকারীদের হাত থেকে বাঁচতে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। দেশ বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শাসন করছে। নানা প্রতিকূলতা, সংকট আর অস্থিরতার মধ্যে সবচেয়ে বড় ভাবনার বিষয় হলো দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মতৎপরতা। স্বৈরশাসকের দোসররা এখনো নানা তৎপরতা চালাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদে ফেলতে। আছে সাবেক সরকারের দোসরদের অসহযোগিতাও। এইসবের মধ্যে সবক্ষেত্রে সংস্কারের কথা বলছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই সংস্কারের আঁচও নিশ্চয় পড়বে নিরাপত্তা সংস্থাগুলোতেও। কারণ স্বৈরাচারী সরকার সামরিক বাহিনীকেও রাজনীতিকরণ করেছিল। তাই সামরিক বাহিনীকে প্রকৃত পেশাদার করে গড়ে তোলাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সামরিক বাহিনী সংস্কার ও তৎসংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিজের ভাবনা জানিয়েছেন সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর জেনারেল নাঈম আশফাক চৌধুরী। বাংলা আউটলুক পাঠকের জন্য তা তুলে ধরা হলো:
১. গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ কর্মপদ্ধতি, বিশেষত নিরাপত্তা খাতে সুচিন্তিত মূল্যায়ন প্রয়োজন। দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ প্রধান নিরাপত্তা যন্ত্র বাংলাদেশ পুলিশ গত ৫ আগস্টের পর থেকে অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। সেনাবাহিনীর দেওয়া নিরাপত্তায় ১৫ আগস্ট থেকে দ্বিধা ও অনাস্থার মধ্যেই পুলিশ তাদের কার্যক্রম শুরু করে।
পুলিশ, র্যাব ও আনসারদের নৃশংসতা ও অপেশাদার কর্মকাণ্ডই দেশকে আইনহীন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়। এখনো দেশের বিভিন্ন স্থানে আগের শাসনামলের দুষ্কৃতকারী ও অন্যান্য স্বার্থান্বেষী মহল নৈরাজ্য সৃষ্টি করে অন্তর্বতী সরকারকে ব্যর্থ করার চেষ্টা করছে। এমনই একটি ঘটনা গোপালগঞ্জে দেখাও গেছে। এছাড়া শেখ হাসিনা ভারতের মদদে ক্রমাগত উসকানি দিচ্ছেন এবং অপরাধী, মাস্তানদের রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ও ভারতীয় মিডিয়ায় ভুল তথ্য প্রচার করছেন। ভারতীয় মিডিয়া, বিশেষ করে বিজেপির প্রতি অন্ধ অনুগত গদি মিডিয়া বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। আর দুঃখের বিষয় হলো, দেশে এখনও গুরুত্বপূর্ণ বেসামরিক এবং সামরিক নিয়োগগুলি সাবেক স্বৈরাচার সরকারের প্রতি অত্যন্ত এবং অনৈতিকভাবে অনুগত কর্মকর্তাদের মাধ্যমেই হচ্ছে।
শুধুমাত্র শীর্ষস্থানীয় পদগুলোতে রদবদল সম্ভাব্য হুমকি ও চ্যালেঞ্জকে প্রশমিত করবে না। এমনকি এটা প্রধান উপদেষ্টা, সেনাপ্রধান এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জীবনের জন্য বিপজ্জনকও।
২. পালিয়ে যাওয়া শাসক অন্যান্য সব প্রতিষ্ঠান এবং সংস্থার মতো রাজনীতিকরণ, ব্যাপক স্বজনপ্রীতি, জবাবদিহিহীনতা এবং আরও অনেক কিছুর মাধ্যমে সব পেশাদার নিরাপত্তা প্রদানকারীর সংস্থারও পেশাদারিত্ব, চেইন অব কমান্ড ধ্বংস করে দিয়েছিল। তার উপরে, ভারতীয় গোয়েন্দা (RAW) সংস্থা সরাসরি বাংলাদেশের ভেতরে থেকে কাজ করেছে। আর তারা এই দেশে আবাস গড়তে পেরেছে আওয়ামী লীগের কিছু দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, প্রভাবশালী সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী, বেসামরিক ও সামরিক আমলাতন্ত্র মিলিয়ে বিগত সরকারের সমর্থনে।
ভারতের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য ছিল হাসিনার প্রত্যক্ষ সমর্থনে বাংলাদেশকে ভারতের একটি অঙ্গ রাষ্ট্রে পরিণত করা। ইসকনের মতো সংগঠন প্রকাশ্যে ও গোপনে হাসিনা সরকারের সমর্থনে বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে এবং ভারতের পক্ষে ব্যাপকভাবে কাজ করেছে। আশ্চর্যজনকভাবে, ভারতে পড়াশোনা করা সাবেক সরকারের এক মন্ত্রী প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন তিনি ইসকনের সদস্য (শিক্ষামন্ত্রী) ৷ ২০১৪ সালের পর থেকে সাবেক সরকার তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং জনপ্রিয়তা হারানোয় নিজেদের অস্তিত্বের জন্য এসব করেছিল ৷ বিনিময়ে, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে অনেক অসামঞ্জস্যপূর্ণ চুক্তি করতে পেরেছিল, যা ভারতের পক্ষে গেছে।
হাসিনার পতনের ফলে বাংলাদেশের ওপর থেকে ভারতের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে। এমনকি, আজ পর্যন্ত (২০০৯ সাল থেকে) ভারত শেখ হাসিনাকে একান্ত বাধ্য ও অনুগত পেলেও বাংলাদেশের মানুষের সমর্থন, শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি পায়নি। আর ভুয়া তথ্য ছড়াতে, বিরোধীদের দমন, সমস্ত সাংবিধানিক ও সরকারি সংস্থায় স্বজনপ্রীতি এবং ভারতের স্বার্থ সমুন্নত রাখার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের তথাকথিত থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) চালু করা হয়।
ব্যান্ডওয়াগন (একটি প্রবণতা যা এতই আকর্ষণীয় যে এতে সবাই প্রবেশ করতে চায়) পদ্ধতির সংস্কৃতি এবং বৈদেশিক নীতির মারাত্মক প্রভাব নিরাপত্তা খাত, কৌশল প্রণয়ন, পরিচালনা, প্রশাসন, নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, সংগ্রহ ইত্যাদিসহ প্রতিটি সেক্টরে পড়েছে। দুর্নীতি সব সংস্থাকে গিলে ফেলেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানরা ব্যক্তিগতভাবে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। যেকোনো জাতির জন্য তা চরম অসম্মানের যখন কোনো সংস্থার প্রধানরা দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় পড়ে। বলা হয়, ঘুষ ছাড়া বা আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে শক্ত যোগাযোগ বা দৃঢ় সমর্থন ছাড়া পুলিশ, আনসার এমনকি বিজিবিতেও খুব কম মানুষই চাকরি পেতেন। ঢাকা বা অন্যান্য লোভনীয় জায়গায় পোস্টিংয়ের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। শুধু তাই নয়, লাভজনক পোস্টিংকে ঘুষ, আত্মসাৎ, মাদক/মানব পাচার, অস্ত্র/অন্যান্য পণ্য পাচারের সম্ভাব্যতা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করলেও আশ্চয্যের কিছু নেই।
নিরাপত্তা বাহিনীর দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য, ভালো ব্যবস্থাপনা ও নীতির সঙ্গে আপোষ করা হয় এবং ধীরে ধীরে ক্ষয় ও অ-পেশাদারিত্বের দিকে এগিয়ে যাওয়া হয়। পেশাদারিত্বের চেয়ে আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া হতো। আওয়ামী লীগ ব্যতীত অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বা সহানুভূতিশীল কোনো আত্মীয়ের (এমনকি তৃতীয় বা চতুর্থ প্রজন্মের রক্তের সম্পর্কও) অস্তিত্বকেও পদোন্নতি বা ভালো পোস্টিং পাওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্যতা হিসেবে দেখা হতো। এটি সামরিক বাহিনীর সব পদ মর্যাদার সদস্যদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। কর্মকর্তারা পেশাদারিত্বের উপর নির্ভর না করে ভালো পোস্টিং পেতে বা একটু কঠিন নিয়মের পদোন্নতি বোর্ডে উত্তীর্ণ হতে রাজনৈতিক নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতা খুঁজতে শুরু করেন।
৩. অত্যাচারী শাসকের সহযোগী সামরিক বাহিনীর কিছু সদস্য ডিজিএফআইয়ের অধীনে ‘আয়না ঘর’ নামে একটি কলঙ্কজনক টর্চার সেল ডিজাইন, প্রতিষ্ঠা এবং পরিচালনা করেছিলেন। এখানে অনেক বিখ্যাত/সাধারণ লোককে বছরের পর বছর ধরে একটি বিচ্ছিন্ন এবং অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় রাখা হয়। সরকার থেকে ভিন্ন মত পোষণ করলে বা বিরোধী দলের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলে বিচার বিভাগের অজান্তেই তাকে অপহরণ করে সেখানে বন্দী করে রাখা হতো।
৪. বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার জন্য আগের শাসনামলে বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে বা সংঘটিত হয়েছিল। যেমন ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনাটি ষড়যন্ত্রের অংশ। এই ঘটনায় ৫৭ জন মেধাবী সেনা কর্মকর্তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। বিডিআরের ঘটনার পর সেনাকুঞ্জে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে অনেক কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সরকার ও সেনাবাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে আওয়াজ তোলায় তাদের অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। ২০১২ সালে মেজর জিয়ার মাধ্যমে সরকার পতনের তথাকথিত ষড়যন্ত্রের কথা বলে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। আর জেনারেল আজিজ (অবসরপ্রাপ্ত) ২০১৯ সালে এক নীতি বাস্তবায়ন করেছিলেন যার ফলে প্রায় ২৫০জন মেধাবী কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর নিতে হয়েছিল। এছাড়াও, তিনি তার মেয়াদে (২০১৮-২০২১) বিভিন্ন কারণে প্রায় ৭৩ জন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত বা বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠান। বলা হয়, জেনারেল আজিজ র’র যোগসাজশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছেন।
৫. ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন সফল গণঅভ্যুত্থান এবং অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর জাতি আশার আলো দেখতে শুরু করে। দেশ এখন সমৃদ্ধি, উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি ও বাঁক বদলের মুহূর্তে দাঁড়িয়ে। অন্যান্য সেক্টরের মতো নিরাপত্তা খাতকেও আমাদের ঢেলে সাজাতে হবে। আমাদের এই সংস্থাগুলির ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে হবে এবং তাদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে হবে।
৬. আমরা সবাই জানি নিরাপত্তা সেক্টর ব্যবস্থাপনা এবং তদারকি সংস্থা, পেশাদার নিরাপত্তা প্রদানকারী এবং বিচার ও আইনের শাসনের বিস্তৃত শাখা প্রশাখা নিয়ে গঠিত। ব্যবস্থাপনা এবং তদারকি সংস্থার আওতায় আছে—নির্বাহীগণ, জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ, আইনসভা, প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র, পরিকল্পনা এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা সংস্থা (আর্থিক নিরীক্ষা এবং পরিকল্পনা ইউনিট। আর পেশাদার নিরাপত্তা প্রদানকারীরা হলেন সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ বাহিনী, আধাসামরিক বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, কাস্টমস, অভিবাসন পরিষেবা, ফায়ার ব্রিগেড এবং বেসামরিক প্রতিরক্ষা, বিএনসিসি ইত্যাদি।
আর বিচার বিভাগ, আইন মন্ত্রণালয়, কারাগার, ফৌজদারি তদন্ত এবং প্রসিকিউশন পরিষেবা, মানবাধিকার কমিশন, ন্যায়পাল এবং প্রথাগত বিচার ব্যবস্থা ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের অংশ। যেহেতু নিরাপত্তা সেক্টরের পুরো কর্মক্ষেত্র অত্যন্ত বিস্তৃত, এই লেখায় শুধু সশস্ত্র বাহিনীর উপর দৃষ্টি ফেলা হবে এবং দুটি গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা সংস্থা যেমন এনএসআই এবং ডিজিএফআইয়ের কিছু দিক তুলে ধরা হবে।
৭. প্রথমত ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর দেশে এরকম জাতীয় ঐক্য আর কখনোই দেখা যায়নি। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দেশনায় ৯৫ শতাংশেরও বেশি মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। এটিই বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় শক্তি।
দ্বিতীয়ত, মাত্র কয়েকদিন আগেও যে জেন জেড প্রজন্ম বাংলাদেশের রাজনীতি ও অন্যান্য বিষয়ে নাক সিটকাতো, তারা এখন শুধু দেশের কল্যাণের কথাই ভাবতে শুরু করেননি, জাতি গঠনে এবং জাতিকে সঠিক পথ দেখাতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছেন। এই নজিরবিহীন পদক্ষেপ এবং পরিবর্তনকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হবে। আমরা সবাই তাদের হতাশা দেখেছি। আমরা সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেধার ভিত্তিতে সুযোগ ও পরিবেশের অভাব, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে রাজনীতিকরণ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অনাচার, সম্পদ ও সুযোগের বৈষম্য ইত্যাদি কারণে প্রতিভাবান তরুণরা বাংলাদেশ ছেড়ে উন্নত দেশে চলে যেতে দেখেছি।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর মধ্য ও নিম্ন স্তরের পদমর্যাদার ব্যক্তিরা আগের সরকারের দুঃশাসন, দুর্নীতি, অপকর্ম পছন্দ করেনি। তারা ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে ঐক্যবদ্ধ ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বরাতে দেশের প্রতিটি ঘটনার খুঁটিনাটি সম্পর্কে ভালোভাবে জানতেন।
চতুর্থত, ভারত এবং সম্ভবত রাশিয়া ছাড়া জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ওআইসি ইত্যাদিসহ প্রায় সব আন্তর্জাতিক স্টেকহোল্ডার এবং সমগ্র বিশ্ব বর্তমান সরকারের পক্ষে এবং তাদের সমর্থন রয়েছে। অন্যদিকে চীন ধীর চলো নীতি গ্রহণ করেছে এবং সম্ভবত নতুন সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা শুরুর জন্য একটি উপযুক্ত মুহূর্ত খুঁজছে দেশটি।
জরুরি ভিত্তিতে যেসব পদক্ষেপ নিতে হবে
৮. ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা সেক্টর নিঃসন্দেহে একটি সংবেদনশীল এবং জটিল জায়গা। আকস্মিক যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতির পাশাপাশি সতর্কতা এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপের দাবি রাখে।
অবিলম্বে আমাদের যেসব পদক্ষেপ নিতে হবে
ক. অবিলম্বে আগের শাসনামলের দুর্নীতিগ্রস্ত ও অপকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগ থাকা উচ্চ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক অবসর দিতে হবে। তারা যাতে দেশ ছেড়ে যেতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনদের কাছ থেকে তাদের বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগ ও প্রমাণ সংগ্রহ করে তদন্ত শুরু করতে হবে। প্রাথমিকভাবে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে সব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার হিসাব জব্দ করতে হবে। প্রাথমিকভাবে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে সব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নিতে হবে। তাদের সহযোগীদেরও খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে হবে।
খ. আগের শাসনামলের প্রতি অত্যন্ত অনুগত কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকারের ভিত্তি ধীরে ধীরে বদলাতে হবে।
গ. একজন দুর্নীতিগ্রস্ত সিনিয়র কর্মকর্তাকে শীর্ষে রাখার চেয়ে একজন ভালো জুনিয়র কর্মকর্তা দিয়ে একটি সংস্থা/প্রতিষ্ঠান/সত্তা পরিচালনা করা ভালো।
ঘ. আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে নির্বাচিত গোয়েন্দা সংস্থার সব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পরিবর্তন করতে হবে।
ঙ. মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিকী (অবসরপ্রাপ্ত) এবং জেনারেল আজিজের (অবসরপ্রাপ্ত) মতো পরিচিত সব দুর্নীতিবাজ অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিচারের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নিতে হবে। দেশের আইন অনুযায়ী অগ্রাধিকার দিয়ে তাদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। তাদের দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে। তাদের সহযোগী এবং প্ররোচনাকারীদের চিহ্নিত করতে হবে। দেশ ছেড়ে যাওয়া সব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। পলাতক থাকলেও বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। এটি বর্তমান এবং ভবিষ্যতের পদধারী সব পর্যায়ের সেনা সদস্যদের একটি পরিষ্কার বার্তা দেবে যে, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
চ. জেনারেল আজিজের সময় সামরিক বাহিনীতে চরম মাত্রায় রাজনীতিকরণ শুরু হয়েছিল। তাই কর্মকর্তাদের দিয়ে একটি বোর্ড গঠন করে ২০১৮ সালের পর থেকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল (এবং সমতুল্য) থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল (এবং সমতুল্য) পর্যন্ত পদোন্নতিগুলো পর্যালোচনা করতে হবে। ভুল/অনুপযুক্ত কর্মকর্তাদের পদোন্নতির জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের খুঁজে বের করতে হবে।
ছ. কর্মকর্তাদের দিয়ে বোর্ড গঠন করে তার মাধ্যমে ২০০৯ সালের পর থেকে গত সরকারের আমলে সংঘটিত সব বরখাস্ত এবং বাধ্যতামূলক অবসরের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করতে হবে।
জ. বিডিআর হত্যার তদন্ত পুনরুজ্জীবিত করতে হবে এবং সব অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
ঝ. সমগ্র বাহিনীজুড়ে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অবৈধ অ্যাসাইনমেন্ট/ভেন্ডর নির্বাচন, ক্রয়াদেশ দেওয়ার ক্ষমতার অপপ্রয়োগ, নির্মাণ, প্রকল্প, সরবরাহ ইত্যাদির অপব্যবহার বিশেষ করে ২০১৮ সালের জুনের পর থেকে হওয়া দুর্নীতিগুলো খুঁজে বের করতে হবে।
মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ
৯. মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদের ভিত্তিতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন:
ক. ডিজিএফআই এবং এনএসআইয়ের দৃষ্টি, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, কাজ, এখতিয়ার এবং কর্মসংস্থান পর্যালোচনা করতে হবে। এটি সংস্থাগুলিতে কর্মরত কর্মকর্তাদের জন্য উচ্চতর, এমনকি সরকারের বেআইনি আদেশ অস্বীকারে একটি ঢাল হিসেবে কাজ করবে।
খ. মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ইতিহাস লেখা।
গ. এই সম্পর্কিত যেসব বিষয় পর্যালোচনার প্রয়োজন সেসব নীতি পর্যালোচনা করা। নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়ন মেধার ভিত্তিতে হতে হবে। এটা কঠোরভাবে অনুসরণ করা আবশ্যক।
ঘ. বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, ডিজিএফআই এবং এনএসআই এবং বিগত সরকারের শাসনামলে স্বাক্ষরিত অন্যান্য সেনাবাহিনী/গোয়েন্দা সংস্থাগুলির সব চুক্তি এবং সমঝোতা চুক্তি পর্যালোচনা করতে হবে। বিশেষ করে যেগুলো ভারতের সঙ্গে হয়েছে।
ঙ. সামরিক বাহিনীতে পুরোনো ভালো ঐতিহ্য ও চর্চাগুলো ফিরিয়ে আনতে হবে এবং বাহিনীকে পেশাদারিত্বের দিকে নিয়ে যেতে হবে। সামরিক বাহিনীকে অবশ্যই তাদের চিরায়ত ভূমিকায় পুরোপুরি নিযুক্ত থাকতে হবে। র্যাব থেকে সব কর্মকর্তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। আর গুরুতর কোনো ক্ষেত্র বিশেষে বেসামরিক প্রকল্পে সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করা উচিত, তবে তা নিয়মিতভাবে নয়।
চ. রাওয়া RAOWA দেশপ্রেমিক প্রবীণদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যারা দেশের কথা ভাবে। এই সংগঠনটিও জেনারেল আজিজের আমলে আওয়ামী লীগের অন্ধ আনুগত্যে চলে যায়। এর পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা ও সংস্কার প্রয়োজন।
ছ. অবসরের পর অবসরপ্রাপ্ত সৈন্যরা শোচনীয় জীবনযাপন করেন। তারা না পারে কোনো ব্যবসা করতে এবং না পারে উদ্যোক্তা হতে। কিন্তু অবসরের পরও ১০ বছর তারা সেনাবাহিনীর সক্রিয় তালিকায় থাকে। বাংলাদেশ পুলিশের মতো তাদের জন্য রেশন অনুমোদিত হলে অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের জন্য তা খুব দারুণ এক সহায়ক ব্যাপার হবে। উল্লেখ্য যে, সেনাবাহিনী ও পুলিশ উভয়েই অবসর গ্রহণের পর রেশনের অনুমোদন চেয়েছিল। বিগত সরকার পুলিশের জন্য তা অনুমোদন দিয়েছিল, কারণ তারা শাসকদের অনৈতিক উদ্দেশ্যে সাধন করত। কিন্তু সেনাবাহিনীর জন্য তা অনুমোদন করেনি।
জ. ইতোমধ্যে অতিরিক্ত রোগীর চাপে ভারাক্রান্ত সিএমএইচে অবসর গ্রহণের পর অবসরপ্রাপ্ত সেনারা পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা পান না। এই দিকটিতেও মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলারও উপায় আছে।
যে পথে আগাতে হবে
১০. নিরাপত্তা খাতের সংস্কার খুব সাবধানে করা প্রয়োজন, কারণ এটি খুব জটিল বিষয়। আর দেশ এখন অনিশ্চিত অবস্থায় আছে। একজন নিরাপত্তা উপদেষ্টার অধীনে যোগ্য কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত দলকে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনায় এবং তিন বাহিনীর প্রধানদের সমন্বয়ে সংস্কারের পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়ন করা উচিত।