কোটাবিরোধী আন্দোলনের মধ্যদিয়ে সূচনা হওয়া ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে অধিকার আদায়ের তূর্য ধ্বনি বেজেছে সমগ্র জুলাই মাস ধরে। আগস্টের প্রথম সপ্তাহেই বৈপ্লবিক বিজয় দেখেছে স্বাধীনতার অপেক্ষায় থাকা কোটি প্রাণ। অতঃপর ছাত্র-জনতার সফল গণঅভ্যুত্থানে স্বাধীনতা পরবর্তী তৃতীয় বিশ্বের বাংলাদেশ সাক্ষী হলো তার ইতিহাসের এক নিকৃষ্ট স্বৈরাচার পতনের।
স্বৈরিণী শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন। শুধু তাই নয়, স্বৈরাচার শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের সকল এমপি, মন্ত্রী ও দলীয় ক্যাডাররা হয় পালিয়ে গেছে অথবা আত্মগোপনে। যা বিশ্বের যেকোনো স্বৈরাচার পতন পরবর্তী বিবেচনায় বিরল। আর দলটির অধিকাংশ নেতা-কর্মী প্রতিবেশী দেশের সীমান্ত পারাপার হতে গিয়ে গ্রেপ্তার হচ্ছে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে। স্বেচ্ছা নির্বাসনে নিজেদের বাঁচানোর এমন আকুতি এই স্বৈরশাসকের সকল দোসরদের প্রতি জনরোষের একটি বহিঃপ্রকাশ।
স্বৈরাচারের এমন পতনের পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে ধ্বংস প্রায় রাষ্ট্র পুনর্গঠনে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
আমার মতো অনেকেই মনে করছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে উপদেষ্টা সিলেকশন ও বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অধ্যাপক আসিফ নজরুলের ভূমিকা বেশ বলিষ্ঠ। সরকারের ভেতর তার প্রভাবও বিস্তর। এটি বেশ লক্ষণীয়। আসিফ নজরুলের পাবলিক ইমেজ বিশ্লেষণ করলে একথা বলা ভুল হবে না যে দেশের মানুষও আসিফ নজরুলের ওপর এই মুহূর্তে ভরসা করতে চায়। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে বর্তমান পৃথিবীতে কোনো মানুষই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়।
দেখা যায় আন্দোলনের ভাগ্য নির্ধারণ যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে তখন থেকে অভ্যুত্থান পরবর্তীতে সো-কল্ড সুশীল সমাজ, সাংবাদিক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনরত শিক্ষার্থী এবং অধ্যাপক আসিফ নজরুল নিজেও অভ্যুত্থানের সফলতা সম্পূর্ণ শিক্ষার্থীদের বলে দাবি করে আসছেন। গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপিত এই বিষয়টিকেই একাধিকবার প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট থেকেছেন এবং সচেষ্ট আছেন। এটিও প্রতিষ্ঠিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন; যে রাজনৈতিক দলগুলো বিগত ১৫ বছরে যা করতে ব্যর্থ হয়েছে ছাত্রসমাজ তা এক মাসে করে দেখিয়েছে। অবশ্যই এই ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে কমপক্ষে এক ঢিলে দুটো উদ্দেশ্যের বাস্তবায়ন সম্ভব। প্রথমত; নিজেদের ইচ্ছামতো একটি সরকার গঠন করা। দ্বিতীয়ত, বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে চাপে রেখে তাদের নিজেদের স্বাধীন মতো সরকারের মেয়াদ নির্ধারণ ও পরিচালনা করা।
কিন্তু আসিফ নজরুল ও শিক্ষার্থীদের ভুলে গেলে চলবে না; বিজয়ের কৃতিত্ব শুধুমাত্র ছাত্রদের ওপর চাপিয়ে সর্ব প্রথমেই তারা একটি বৈষম্য তৈরি করার ভ্রান্ত সূচনা করেছেন। কারণ, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ যখন এক দফায় পরিণত হয় তখন সেখানে সকল শ্রেণি-পেশা, ছাত্র-জনতা, দলমত নির্বিশেষে সমন্বিত অংশগ্রহণ ছাড়া চূড়ান্ত সফলতা সম্ভব নয়। রাজপথের আন্দোলনে সকল শ্রেণির মানুষের অংশ গ্রহণ ও শহীদদের অচেতন মুখের সংখ্যা, শ্রেণি ও ছবিগুলো একবার আলিঙ্গন করে নিলেই এই বাস্তবতার প্রতীয়মান হবে। শিশু থেকে শ্রমিক, ছাত্র থেকে ছাত্রনেতা, শহীদদের ভিড়ে ছাত্র জনতার লাশ কারো একক কৃতিত্ব বহন করে না।
The Human Rights Support Society's (HRSS) এর তথ্য অনুযায়ী দেশব্যাপী ছাত্র বিক্ষোভের সময় ৮১৯ জন মারা গেছে। তবে প্রকৃত মৃতের সংখ্যা কমপক্ষে এক হাজার ছাড়িয়েছে। যার মধ্যে শিশু-কিশোরের সংখ্যা কমপক্ষে ৮৯। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহাম্মেদ বীর বিক্রমের তথ্য অনুযায়ী; বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের ২০০ ওপরে নেতা-কর্মী শহীদ হয়েছে। জামায়াত বলেছে তাদের ৮৭ নেতা-কর্মী শহীদ হয়েছে। আহত কয়েক হাজার। গুলিবিদ্ধ হয়ে এখনো মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন অনেকেই। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। যার প্রকৃত সংখ্যা একটি নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দেশবাসী জানতে পারবে বলেই জনগণ আশা করছে। শুধু জুলাইয়ের ক্রাকডাউনে বিএনপির কত হাজার কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তার হিসাব ও কারণও আপনাদের অজানা থাকার কথা নয়।
ভুলে যাওয়া ঠিক নয় যে, গত ১৬ বছরে বিএনপি লক্ষ লক্ষ জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের জনপ্রিয়তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সরকারের পদত্যাগ চেয়েছে। যা কিনা একটি সভ্য দেশের সরকারের প্রতি অনাস্থা ও পদত্যাগের গণতান্ত্রিক নিয়মমাফিক উপায়। কিন্তু স্বৈরাচারী সরকার নিরীহ জনগণের প্রতি জুলুমের পন্থা অবলম্বন করে উল্টো দেশের সাধারণ জনগণের উপর হামলা মামলার খড়্গ নামিয়েছে। আর টিভির চওড়া পর্দায় আপনারা এসে বিএনপির আন্দোলনকে বিএনপি-জামায়াতের জ্বালাও-পোড়াও বলে অভিযোগ করেছেন। ভুলে যাওয়া ঠিক নয় যে আজ আপনারাই বিজয়ের কৃতিত্বে বৈষম্য তৈরি করে ফায়দা নিতে অকৃপণ।
ইতিহাসের একটি নিকৃষ্টতম স্বৈরাচারের পতনে যে অভ্যুত্থান সেটি কোনোভাবেই একদিন, বা এক মাসের সংগ্রাম হতে পারে না। এর জন্য একটি দীর্ঘ সংগ্রাম ও অভ্যুত্থানের ক্ষেত্র তৈরি হতে হয়। যে ক্ষেত্রটি তৈরি হয়েছে গত ১৬ বছরের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগে। শত শত নিরীহ মানুষের গুম-খুন, বিচারিক নিপীড়ন ও আয়না ঘরের উন্মোচন, বিচারিক নিপীড়ন সবকিছুই ভীত রচনা করেছে একটি সফল অভ্যুত্থানের ক্ষেত্র। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের এই অভ্যূত্থানে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, চিকিৎসক, কৃষিবিদ, রিকশাচালক, মুদি দোকানদার, গার্মেন্টস শ্রমিকসহ সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষ শহীদ হয়েছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তরিকুল ইসলাম, বুয়েটের আবরার, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদিজা, খিলগাঁয়ে ছাত্রদলের নুরুজ্জামান জনি, ইলিয়াস আলী অথবা মডেল-অভিনেত্রী নওশাবা, এমন শত শত ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ তৈরি করেছে অভ্যুত্থানের ক্ষেত্র। কিন্তু আপনারা হয়ত সেটি বুঝতে ব্যর্থ। কিংবা বুঝতে চাইছেন না। কারণ একজন সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলীর ওপর যে নৃশংসতা, ছাত্রদল নেতা জনির অনাগত সন্তানের নির্বাক পৃথিবী বা গুম হয়ে যাওয়া কোনো সন্তানের ফিরে আসার অপেক্ষায় কপালে ভাঁজ পড়ে যাওয়া মায়ের পৃথিবীর মায়া বিসর্জন দিয়ে অনন্তকালের যাত্রী হওয়ার ব্যথা দ্বিতীয় বা তৃতীয় পক্ষের দ্বারা কোনোভাবেই অনুধাবন সম্ভব নয়।
পিতার জানাজায় ডান্ডাবেড়ি পরা সন্তানের বোবা মুখের কি স্বৈরাচারের পতনে কোনো অবদান নেই? প্রবাসে বসে যে সকল দেশপ্রেমিক সৈনিকেরা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও অভ্যুথানের পক্ষে নিরলস পরিশ্রম করেছেন, সরব থেকেছেন; তাদের কি কোনো ভূমিকা নেই। যেখানে ছাত্র-জনতা রাজপথে যুদ্ধ করেছে সেখানে অনলাইন এক্টিভিস্টরা যুদ্ধের রসদ জোগানোর কাজ করেছে। বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছে স্বৈরাচারের উলঙ্গ বিকৃত চেহারা। তাদের কি স্বৈরাচারের পতনে কোনো অবদান নেই?
শুধু একথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে আমরা ৫২, ৬৯, ৭১ বা ৯০ এর গণ-আন্দোলনের ইতিহাস জেনেছি। যেখানে প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছাত্রদের ভূমিকা ছিল অগ্রভাগে। কিন্তু বিজয়ের সংগ্রামে ছিল আপামর জনতার অসীম আত্মত্যাগ। একজন প্রফেশনাল আর্মি যেমন সময়ের প্রয়োজনে বীর-বিক্রমে যুদ্ধ করে যুদ্ধ শেষে ব্যারাকে ফিরে যায়, তেমন বাংলাদেশের ঐতিহাসিক আন্দোলনে বিজয়ের পর ছাত্র-জনতাও ঘরে ফিরে গেছে। ঠিক অপরদিকে বিজয়ের কৃতিত্ব ছিনিয়ে নেওয়ার পর লুটপাটের রাজত্বও দেখেছে এদেশের জনগণ। ৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের কথাই ধরা যাক। দেশের ৭ কোটি মানুষের বিজয়কে কীভাবে আওয়ামী লীগ দখল করে নিয়েছিল তা অবশ্যই কারো অজানা নয়।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে একটি জাতীয় সরকার হতে পারতো। কিন্তু দেশের মানুষ কি দেখলো? সরকার, দেশ সবকিছুই এক দল ও এক ব্যক্তির হাতে বন্দি আর নিষ্পেষিত। দেশে রক্ষীবাহিনী তৈরি করে গণহত্যা আর লুটপাটের স্বর্গে পরিণত করেছিল শেখ মুজিবুর রহমান। যার শেষ পদক্ষেপ ছিল একদলীয় স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন। যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্য এত শৌর্যবীর্য প্রদর্শন, বক্তৃতা, মিছিল, সংগ্রাম সেদিন সবকিছু ধ্বংস করা হয়েছিল এক ব্যক্তির ক্ষমতালিপ্সার কারণে।
আওয়ামী লীগের শেখ মুজিব সে সময় লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করার কারণেই স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরেও আজ আমাদের, দেশ সংস্কারের কথা বলতে হচ্ছে। এখনও যারা শেখ মুজিবের বন্দনা করতে করতে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলেন তাদেরকে অনুরোধ করবো এই দ্বিচারিতা ও ভণ্ডামি থামান। স্ট্যান্ড উইথ দ্যা ফ্যাক্ট। বিজয় ছিনিয়ে নেওয়ার পরিণাম যে কতটা ভয়াবহ ও করুন হতে পারে তা বাংলাদেশের মানুষ ইতঃপূর্বেও অবলোকন করেছে।
এরিস্টটলের বলেছেন "Every Man by Nature a Political Animal" তাহলে, ছাত্র বলেন আর জনতা; আন্দোলনে অংশ নেওয়া প্রতিটি ইন্ডিভিজুয়াল ও তাদের পরিবার কোন না কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ লালন করে। আমার নিজ পরিবারেরই ১৭ থেকে ২৭ বছর বয়সের তিনজন জুলাই আন্দোলনে রাজপথে আন্দোলনের সম্মুখভাগে ছিল। তারাও শিক্ষার্থী কিন্তু বাস্তবতা হলো তারা কোটা বিরোধের জন্য নয় বরং পারিবারিক রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণেই আন্দোলনে শামিল হয়েছিল। অর্থাৎ, গণমাধ্যম পাড়ায় যে তৃতীয় পক্ষের ন্যাকামি চলেছে বা এখনও চলছে সেটি খুবই রহস্যজনক।
এদের অনেকেই সেই চিরচেনা মিডিয়া যারা গত ১৬ বছরের বিএনপির আন্দোলনকে জামায়াত-বিএনপির সন্ত্রাস ও ইসলামিস্ট বলে প্রচার প্রচারণা চালিয়েছে। এটি পরিষ্কার যে এখানে পক্ষ হল দুটি। একটি হল সরকারের পক্ষের শক্তি আর অন্যটি সরকার পতনের শক্তি। তবে হাঁ সুবিধাবাদী তৃতীয় পক্ষ যদি আসলেই এক্সিস্ট করে; নিঃসন্দেহে সেটি হবে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যার অধিকাংশ উপদেষ্টাই স্বৈরাচারের সহযোগী ছিলেন, দোসর ছিলেন। আর গুটি কয়েকজন তার ভুক্তভোগী। কারণ কথায় আছে নীরবতা সম্মতির লক্ষণ।
আজ ছাত্রদের এই যৌক্তিক আন্দোলনে আপনারা গুটি কয়েক শিক্ষক, শিল্পী, সো-কল্ড বুদ্ধিজীবী মাঠে নেমেছিলেন। কিন্তু গত ১৬ বছরের বিএনপির আন্দোলনে কেন মাঠে কাউকেই দেখা যায়নি? বিএনপি তো কখনো বলেনি যে তারা স্বৈরাচার হাসিনাকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করতে চায়। বিএনপি দেশের মানুষের ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও বাকস্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করেছে।
ইলিয়াস আলী গুম হওয়া বা ছাত্রদলের জনিকে বুকে ৫৬টি গুলি করে হত্যা করার পরও এই আপনারা তো প্রতিবাদ করেননি। রাজপথে বিএনপির আন্দোলনে সংহতি জানাননি। হারানোর এই তালিকা অনেক দীর্ঘ। কিন্তু আপনাদের প্রতিবাদ ছিল না এমনকি মৌন। তাহলে কি একথা বলা সমুচিত হবে না যে; আপনারা ছিলেন স্বৈরাচারীর সহযোগী। ইংরেজিতে যেটাকে বলা হয় complicit with the criminal । এমনকি আজকের উপদেষ্টাদের অনেকেই গত ১৫ বছরের বিএনপির আন্দোলনকে জামাত-বিএনপির জ্বালাও পোড়াও এবং এক্সট্রিমিস্ট বলেও অবিহিত করেছেন। শত-হাজার মানুষের গুম, খুন, বিচারিক নিপীড়ন কোন কিছুতেই আজকের সুশীল সমাজ, মিডিয়া, এমনকি আজকের বিজ্ঞ উপদেষ্টাদেরও বলিষ্ঠ ভূমিকায় দেখা যায়নি। বালুর ট্রাকে পিষ্ঠ গণতন্ত্র কিংবা নাজিম উদ্দিন রোডের অন্ধকারকাষ্টের স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে ইঁদুর-তেলাপোকার সাথে মানুষের বসবাস নিয়ে বিদেশি মিডিয়া গ্রাফিতি আঁকলেও আজকের এই সুধী সুশীল সমাজের কমফোর্ট জোনটি এদেশের মানুষ দেখেছে।
সোশ্যাল মিডিয়াতে এমনও দেখা গেছে যে, বর্তমান সরকারের উপদেষ্টার তালিকায় মেধার থেকে কোটার আধিক্য বেশি বলে ট্রোল করা হয়েছে। যদিও নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদের অন্তর্ভুক্তি ছিল যুগান্তকারী। কারণ তাদের সফলতা বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এক আমূল পরিবর্তন বয়ে আনবে বলে আমি বিশ্বাস করতে চাই। এদেশে রাজনীতি বা সরকার পরিচালনায় বুড়ো হওয়ার যে গৎবাঁধা নিয়ম চলে আসছে তা ভাঙতে এই তরুণ উপদেষ্টাদের সফলতা ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক নীতি নির্ধারকদের কাছে এক উজ্জ্বল উদাহরণ সৃষ্টি করবে।
মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কথাই ধরেন, উনি শুধু দেশেই নয় গোটা বিশ্বে সার্বজনীন একজন সম্মানিত ব্যক্তি। উনি বাংলাদেশিদের জন্য গর্বের। সার্বজনীন সজ্জন ব্যক্তিত্ব। গোটা বিশ্বে উনার অবাধ বিচরণ। গোটা পৃথিবীতে ইউনিভার্সিটির হলরুম থেকে মানবাধিকার বিষয়ক সেমিনার, জলবায়ু পরিবর্তন থেকে বৈষম্যহীন পৃথিবী বিনির্মাণের স্বপ্নের রোডম্যাপ বিশ্বকে নতুন রূপে অবলোকন করিয়ে থাকেন। কিন্তু গত একযুগেরও বেশি সময় ধরে নিজের দেশের জনগণের মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচারিক নিপীড়ন, বাক স্বাধীনতার হরণ সহ মানুষের মৌলিক মানবীয় অধিকার হরণের মত বিষয়গুলোর ওপর উনার কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না। নিজে লোহার খাঁচায় বন্দী হওয়ার আগ পর্যন্ত উনি শুধু ঘুমিয়েই ছিলেন না বরং স্বৈরাচারী হাসিনার সাথে আপস করতে মরিয়া ছিলেন। যা দেশের নির্যাতিত মানুষের বুকে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
এমন কিছুর প্রমাণ হিসেবে উনার এবং উনার মেয়ের বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারগুলো দেখে নেওয়া যেতে পারে। এর বিপরীতে নিজ ও দলের প্রতিকূল অবস্থায় থেকেও জাতীয় সংসদে বেগম খালেদা জিয়া নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস ও তার গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ড. ইউনূস সম্পর্কে বলেন "জাতির জন্য যারা সম্মান বয়ে আনে সেই কৃতি সন্তানেরা যেন দেশেও মর্যাদা পান তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। না হলে দেশ মেধা শূন্য হয়ে পড়বে"। অথচ ড. ইউনূস সাহেব মিথ্যা সাজানো মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে অন্যায়ভাবে বছরের পর বছর কারান্তরীন করে রেখে স্লো পয়জনিং করে হত্যার চেষ্টা করলেও কখনও এর বিরুদ্ধে একটা টু-শব্দও করেননি । ড. ইউনূস আসলে শান্তিপ্রিয় একজন ভীষণ আত্মকেন্দ্রিক মানুষ। এটা শুধু আমার কথা তা নয়, ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের সাবেক ডেপুটি চিফ অব মিশন জন ড্যানিলোভিজও সাউথ এশিয়া পার্সপেক্টিভসও এমন মতামত দিয়েছেন।
অপরদিকে একজন উপদেষ্টাতো স্বৈরিণী হাসিনাকে এতটাই শ্রদ্ধা করেন যে, শেখ হাসিনার নাম নিতে গেলে উনার মাথা অবনত হয়ে যায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় স্বৈরিণীকে পুনর্বাসন করতে চায়। তিনি হিটলারের নাৎসি বাহিনীর থেকেও ভয়ংকর আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করতে চায়। মনে হয় তিনি অন্তর্বর্তী সরকার নয়; আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা। আর এটা হওয়াই তো স্বাভাবিক। কারণ তিনিইতো ১/১১ এর কুশীলবদের অন্যতম একজন যাদের ষড়যন্ত্র ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় স্বৈরাচার হাসিনা ২০০৯ এ ক্ষমতা গ্রহণ করে। তারপর থেকে গত ১৬টি বছর স্বৈরিণী হাসিনা বাংলাদেশের মানুষের ওপর জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসেছিল। যার কারণে খালি হয়েছে শত সহস্র মায়ের বুক।
জুলাইয়ের আন্দোলনে স্বৈরাচারীর গুলিতে নিষ্পাপ শিশুদের ছিন্ন ভিন্ন অচেতন শরীর উনি অনুভব করতে পারেন না। শাহীন কলেজের শিক্ষার্থী রাতুলের শরীরে ২৬৫ স্প্লিন্টার নিয়ে বেঁচে থাকার যে নির্মম যন্ত্রণা, আহনাফের মাথার পেছন দিক দিয়ে গুলি লেগে ডান চোখ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া অথবা তখনও প্রাণ থাকা ইয়ামিনের শরীর পুলিশের সাঁজোয়া যান থেকে ছুড়ে ফেলার নির্মমতাও যদি এই শাখাওয়াত সাহেবকে হাসিনার প্রতি শ্রদ্ধায় অবনমিত করে, হৃদয় স্পর্শ না করে তবে উনাকে স্বৈরাচারের মদদ দাতা ছাড়া আর কিছু বলার সুযোগ নেই। নিষ্পাপ শিক্ষার্থীদের লাশের উপর দিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ বাচালতা করার পরও যে ব্যক্তি উপদেষ্টা পদে বীরদর্পে বহাল থাকতে পারে, সেই সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা নিয়ে প্রশ্ন করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। He is an absolute pervert.
এমনকি তিনি রাগ করে মিডিয়া বন্ধ করে দিবেন বলে স্পষ্টতই শপথ ভঙ্গ করেছেন। কিন্তু সরকার তার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ। শুধু তাইই নয় গত ১৬ টি বছর যারা স্বৈরাচারীর দোসর ছিলেন সেই জাতীয় পার্টির নেতা বা এ কে আজাদের মত লোকদের যখন বঙ্গভবনে শপথের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়, তখন এই সরকারের ভূমিকা নিয়ে আজ বা কাল প্রশ্ন উঠার সুযোগ রয়েছে।
বর্তমান সরকারের বেশিরভাগ উপদেষ্টা জনগণের প্রত্যাশিত নয়। তবে তাদের মন্দের ভালো বলা যেতে পারে। মনে রাখবেন ১৬ বছরের ভুখা এক জাতির সামনে পান্তা ভাতও সোনারগাঁওয়ের পোলাও-কোরমার মত মনে হয়। তাই আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।
দেশ পরিচালনা করতে যোগ্য কি শুধু টিভির পর্দার কিছু চেনা এনজিও কর্মী আর সুবিধা ভোগকারী আমলা? ১৭ কোটি বাংলাদেশি নাগরিকের মধ্যে কি আর কোনো যোগ্য মানুষ নেই যারা এই দেশটা পরিচালনা করতে পারে? দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন কৃষক বা মফস্বরের একজন শিক্ষকেরও দেশ চালানোর যোগ্যতা থাকতে পারে। তার জন্য পরিচিত মুখ হওয়া জরুরি নয়। প্রয়োজন শুধু দেশপ্রেম ও সততা। বিদেশি অর্থে দিনের বেলায় মানবতার মুখরোচক জ্ঞানগর্ভ বয়ান আর রাতের বেলায় বলরুমে পার্টি করা পরিচিত মুখগুলোই শুধু দেশ পরিচালনার যোগ্য এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। তা না হলে প্রকৃত বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়। রাষ্ট্র যদি সত্যিই মেধার ভিত্তিতে চলতে হয় তাহলে মাইনোরিটি, ধর্ম, বর্ণ, সকল পেশার ঊর্ধ্বে মেধার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব ভার অর্পিত হওয়া অত্যাবশ্যক। এখানে মুসলমান, হিন্দু, মাইনোরিটি বা সুশীল প্রতিনিধির বৈচিত্র্যতার সুযোগ নাই। যোগ্যতার ভিত্তিতে ২০ জন উপদেষ্টার ২০ জনই হিন্দু বা মাইনোরিটি থেকেও হতে পারে। কারণ আমরা সবাই বাংলাদেশি। এটাই আমাদের একমাত্র পরিচয় হওয়া বাঞ্ছনীয়।
স্বৈরাচার পতন পরবর্তীতে দেশে যে সকল নৈরাজ্য হয়েছে সেটিকে যেভাবে বিএনপির ওপর চাপিয়ে সরলীকরণ করার একধরণের উদ্দেশ্যমূলক অপচেষ্টা করা হচ্ছে। এমন অপচেষ্টার বিপরীতে বলবো; ইতিহাস ঘেটে দেখেন। ৭১ এ স্বাধীনতা পরবর্তীতে মুক্তি বাহিনীর লুটপাট সম্পর্কে অনেক ঘটনা ইতিহাসে পরিষ্কার করে লেখা হয়েছে। বিনা বিচারে কাদের সিদ্দিকীর মতো মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। ২৪শে ও লুটপাট হয়েছে, তবে তা ৭১ এর তুলনায় অতি নগণ্য।
৭১ এর স্বাধীনতা পরবর্তীতে দেশের মধ্যে কোনো শত্রু ছিল না। কিন্তু ২৪ শের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তীতে রয়ে গেছে ১৬ বছরের স্বৈরাচার ও তাদের দোসররা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো; ৭১ এর স্বাধীনতা পরবর্তীতে লুটপাট, হত্যার বিচার করেনি শেখ মুজিব। কিন্তু ২৪শে সরকার না হয়েও বিএনপির সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্ব থেকে বলিষ্ঠভাবে তাদের নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করেছে। দেশে হিন্দুদের বাড়ি-ঘর, মন্দির পাহারা দিয়েছে। স্বৈরাচারের ১৬ টি বছর বিরোধী দলের নেতা কর্মীদের দুর্বিষহ জীবনের গল্প আর যাইহোক টকশোর নরম চেয়ার বা সেমিনারে বসে জ্বালাময়ী বক্তৃতায় অনুভব করা সম্ভব নয়। সবকিছু থাকার পরও শুধু মাত্র দলীয় পরিচয় থাকার কারণে বছরের পর বছর স্ত্রী-সন্তান পরিজনের থেকে দূরে পালিয়ে থাকার করুন অভিজ্ঞতা তৃতীয় পক্ষ বুঝবে না এটাই স্বাভাবিক।
আপনারা চন্দন পালঙ্কে শুয়ে ১৬ বছরের দুর্বিষহ বাস্তবতা বুঝার চেষ্টা করছেন। ৫ অগস্ট স্বৈরিণী হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরবর্তীতেও দেশে আর্মি ডিপ্লয়েড ছিল। তাহলে এতগুলি পুলিশ স্টেশন ধ্বংস, পুলিশ হত্যা, বাড়ি-ঘর ও বিভিন্ন স্থাপনায় লুটপাটের ঘটনা কেন ঘটলো? আর্মি কি ইচ্ছাকৃতই নীরব ছিল? নাকি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল? নাকি এসব ঘটিয়ে বা ঘটতে দিয়ে ঘোলা জলে কেউ মাছ শিকার করতে চায়। যেহেতু এই মুহূর্তে দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি নিরঙ্কুশ বিজয়ী হয়ে এককভাবে সরকার গঠন করবে তাই বিএনপির ইমেজ নষ্ট করে কোনো পক্ষ ফায়দা নিতে চায় কি না তাও বিবেচনার বিষয়।
গত ১৬ বছরে স্বৈরাচারকে টিকিয়ে রাখতে পুলিশ, আমলা, বণিক, বিচারপতি, সেনা, শিল্পী বা তথা কথিত সুশীল সমাজের যে বা যারাই জড়িত বা সহযোগী হয়েছে তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এখানে বিন্দু মাত্র সহানুভূতি দেখানোর সুযোগ নেই। এদের সকলেই খুনির সহযোগী। অর্থাৎ তারাও খুনি। পুলিশ, আমলা, ব্যবসায়ীসহ তাদের সবাইকে চিহ্নিত করতে তদন্ত কমিটি করতে হবে। তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। পুলিশের কনস্টেবলরা ওপরের নির্দেশে কাজ করেছে বলেই পার পেয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ জুলাই আন্দোলনের বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে অনেক অতি উৎসাহী পুলিশ কর্মকর্তারা খুব কাছ থেকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক গুলি করে ছাত্র-জনতাকে হত্যা করেছে। তারা যে শুধুমাত্র তাদের সিনিয়রদের আদেশ মানতে বাধ্য হয়েছে সেটা বলার কোনো সুযোগ নেই।
স্বৈরিণী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেছে প্রায় তিন সপ্তাহ হয়ে গেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে আজ ১৭তম দিন। এখন পর্যন্ত স্বৈরাচারী হাসিনা সম্পর্কে এই সরকারের থেকে কোনো নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত আমরা জানতে পারিনি। বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন আহমেদকে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশের কারণে সেই দেশে মামলায় জড়াতে হয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনা ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই কীভাবে ভারতে পালিয়ে গেলেন এবং কোনো মামলা ছাড়াই সরকারি নিরাপত্তায় সেখানে অবস্থান করছে, সে বিষয়ে বর্তমান সরকার কি ভারতীয় হাই কমিশনের কাছে জানতে চেয়েছেন?
হাজার হাজার ছাত্র-জনতা হত্যা করার জন্য স্বৈরাচারী হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে কিন্তু বর্তমান সরকার এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বৈরাচারী খুনি হাসিনাকে ভারত সরকারের কাছে ফেরত চেয়ে কোনো আবেদন করেনি। তাহলে কি সরকার স্বৈরাচারী হাসিনাকে সেফ এক্সিট দিতে চাইছে। এসব কিছু জনগণের কাছে পরিষ্কার হওয়া দরকার। জন ড্যানিলোভিজের মত এদেশের মানুষও জানতে চায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কি প্রকৃতপক্ষে অন্তর্বর্তী সরকারকে সাহায্য করছে নাকি অন্তর্বর্তী সরকার সেনাবাহিনীকে সাহায্য করছেন, যা পরিষ্কার করা অতি জরুরি। কারণ ১/১১ এর অভিজ্ঞতায় মানুষের মধ্যে অজানা আতঙ্ক তাড়া করে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভোকাল সব উপদেষ্টাই বলছেন, এই সরকার জনগণ যতদিন চাইবে ততদিন থাকবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, কখন নির্বাচন হবে সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়। দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে আপনারা কখন আমাদের ছেড়ে দেবেন। আমরা ছাত্রদের আহ্বানে এসেছি। তারা আমাদের প্রাথমিক নিয়োগকর্তা। বিষয়টা খুব ইন্টারেস্টিং। জনগণের ইচ্ছা পরিমাপ করার জন্য আপনাদের মানদণ্ড কি? আপনি কোন মানদণ্ডের উপর জনগণের চাওয়া না চাওয়ার পরিমাপ করছেন সেটাতো বলছেন না। এই সরকার তো জনগণের ভোটে নির্বাচিতও নয়। তাহলে কি সরকারেরকে না বলার জন্য জনগণ আবার যতদিন মাঠে না নামছে ততদিন থাকবে, এটাই কি জনগণের চাওয়া না চাওয়ার মানদণ্ড? আবার বলছেন ছাত্ররা আপনাদের প্রাথমিক নিয়োগকর্তা। আপনারা আসলে কার প্রতি দায়বদ্ধ, ছাত্র, জনতা না কি রাজনৈতিক সংগঠন? নাকি আপনারা ছাত্রদের জনগণের মুখোমুখি করতে চান?
একথা বলা শ্রেয় যে, মানুষ মূলত প্রতিকূল অবস্থায় সৎ ও সংগ্রামী হয়ে থাকে। কারণ সে তখন কোনো না কোনো সুবিধাভোগী শ্রেণির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। কিন্তু যখনই সে অনুকূল অবস্থায় পৌঁছে যায় তখন সে নিজেও সুবিধাভোগী শ্রেণীর অংশ হয়ে যায় এবং প্রতিবাদীকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করে। ৭১ পরবর্তী আওয়ামী লীগ ও বর্তমানের জাসদের দিকে তাকালে এর জ্বলন্ত উদাহরণ পাওয়া যায়। সামাজিক ন্যায় বিচার ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য জাসদ স্বৈরাচার শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ করেছে, ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে সেই জাসদও ৭১ পরবর্তী আওয়ামী লীগের মত নীতি বিবর্জিত নিষ্ঠুর হয়েছে। একদা এক জনৈক আমাকে বলেছিলো; প্রতিটি মানুষের ভেতর এক একটি হাসিনা বসবাস করে। সে শুধু নিজের চিন্তা-ভাবনাকেই সঠিক মনে করে এবং যারা তার সমর্থন করে না তাদের সে সহ্য করতে পারে না। সবার আগে আমাদের সবাইকে আমাদের ভেতরের হাসিনাকে কবর দিতে হবে।
আপনারা বলছেন আগামীতে তরুণদের নেতৃত্বে সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। আজকের তরুণরাই আগামীর রাষ্ট্র পরিচালনা করবে এটাইতো স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা কীভাবে করবেন তা কেউ ক্লিয়ার করে বলছেন না। রাজনৈতিক দলগুলো আগামীর সংসদ নির্বাচনে তরুণদের প্রাধান্য দিবে নাকি ভিন্ন প্লাটফর্মে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরাই সরকার গঠন করবে? বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দরাও রাজনৈতিক দল গঠনের কথা বলছে। কারণ তারা আর কোনো স্বৈরাচার সরকার দেখতে চায় না। তাদের মতে বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তারা এও বলছে যে একজনকে বিদায় করে আরেকজনকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য তারা আন্দোলন করেনি। ভালো কথা, তাহলে রাষ্ট্র ক্ষমতায় কে বসবে সেটার সিদ্ধান্ত কে নিবে। বর্তমান সরকার নাকি শুধুই শিক্ষার্থীরা? বাকী জনগণের ম্যান্ডেটের কি হবে? এইসব অস্পষ্ট বিষয়গুলো পরিষ্কার করা জরুরি বলে মনে হয়।
প্রধান উপদেষ্টা বলছেন, ছাত্ররা আপনাদের প্রাথমিক নিয়োগকর্তা। অর্থাৎ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব করছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ক্ষমতাসীন সরকারের সহযোগিতায় বা আশীর্বাদে যদি কোনো দল গঠন হয় এবং সেই দল নির্বাচনে অংশ নেয় তাহলে সেই দলকে বহুল আলোচিত কিংস পার্টি বলে বিবেচনা করার সুযোগ রয়েছে কি না? আর তা যদি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা একটি গণতান্ত্রিক উপায়ের মধ্যে হয় তবে সকল রাজনৈতিক দলই শুধু নয় আমার বিশ্বাস বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপির) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানই সবার আগে সেই দলকে স্বাগত জানাবেন।
বর্তমান সরকার বলছেন, দেশের প্রতিটি সেক্টরে সংস্কার করতে যতদিন লাগবে সরকার ততদিন থাকবে। যে সংস্কার গত ৫৪ বছরে হয়নি সেই সংস্কার করতে আপনারা কতদিন চান সেটাতো জনগণের সামনে পরিষ্কার করতে হবে।
সম্প্রতি বিএনপির মহাসচিব বলেছেন যে, বর্তমান সরকার নির্বাচন বা কোন কোন সেক্টরে কি সংস্কার করবে সে বিষয়ে রাজনৈতিক দলের সাথে কোনো আলোচনা করেনি। এটাতো বড় উদ্বেগের বিষয়। ধরে নিলাম আপনারা ২, ৫ বা ১০ বছর ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্র সংস্কার করবেন। কিন্তু সেটা যদি স্বৈরাচারী কায়দায় হয়, অর্থাৎ রাজনৈতিক দল গুলির সাথে কোন প্রকার আলোচনা বা তাদের মতামতের ভিত্তিতে না হয় তবে সেই সংস্কারের টেকসই ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা থেকে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। কারণ ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সরকার সংসদীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে তা নিজেদের মত পরিবর্তন করে নিতে পারে। যা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত।
সবার আগে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের চিন্তা চেতনা ও মানসিকতায় সংস্কার করা জরুরি। রাজনৈতিক দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা ও প্রতিশ্রুতিশীল হওয়া জরুরি। রাজনীতিকদের স্বজনপ্রীতিকে কবর দিতে হবে। চাটুকার নয়, মেধা ও যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিতে হবে। আর সে জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দল ও অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও গঠনমূলক আলোচনা।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যদি সংস্কারের জন্য যৌক্তিক সময়ের প্রয়োজন হয় সেটি আলোচনার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির কাছ থেকে তাদের আদায় করে নিতে হবে। তাহলেই পারস্পরিক সহনশীলতা ও সরকারের কাজে দৃশ্যমান গতি আসবে। সরকারও স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করতে পারবে। কারণ দিনশেষে রাজনীতিবিদরাই এই দেশটি পরিচালনা করবে এইটা আমাদের ভেতর ধারণ করতে হবে এবং সেটি মাথায় রেখেই বর্তমান সরকারকে কাজ করে যাওয়া উচিত। অন্যথায় যত সংস্কারই করেন না কেন, রাজনৈতিক স্বচ্ছতা ও সদিচ্ছা না থাকলে আগামী শত বছরেও সংস্কারের প্রকৃত ফল পাবে না জনগণ।
জাহিদ হোসেন গাজী, যুক্তরাজ্য প্রবাসী আইনজীবী
E-mail: [email protected]