বন্যা, এক তীর দুই নিশানা এবং পরীক্ষা বাতিল ও বই পোড়ানো
ভয়াবহ বন্যায় ডুবেছে বাংলাদেশে ১২টি জেলা। কারণ, ভারত তাদের বাঁধ খুলে দিয়েছে। অজুহাত হিসেবে বলা হচ্ছে, অতিবর্ষণের কথা। কিন্তু বাঁধ খোলার আগে প্রতিবেশী দেশের ক্ষতি জেনেও তারা কোনো প্রকার সতর্ক করা ছাড়াই কাজটি করেছে। এখন তারা বলছে, পানি বেশি হওয়ায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাঁধ খুলে গেছে। অনেকটা পলককাণ্ডের মতন। এমনি এমনি ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেছে আর কী। যখন অতিবর্ষণে বাঁধ উপচে যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে ভাসিয়ে দেবে উজানের পানি নিচের জনপদ। তখন কেন সতর্ক করা হলো না প্রতিবেশী দেশকে!
আমরা জানি প্রযুক্তির কল্যাণে এখন দু’সপ্তাহ আগেই বন্যার পূর্বাভাস পাওয়া সম্ভব। বৃষ্টি যে হবে তা এখন আগেভাগেই জানিয়ে দেয় আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেয়ার যন্ত্রগুলো। এমনকি আমরা নিজেদের সেলফোনের দিকে তাকালেই কয়েকদিনে পূর্বাভাস পেয়ে যাই। দশদিন আগে থেকেই গুগল জানায় কখন কোথায় বৃষ্টি হবে। আর আবহাওয়া পূর্বাভাস কেন্দ্রগুলোতে ব্যবহৃত হয় অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। সুতরাং, যদি বলা হয় অতিবর্ষণের পূর্বাভাস এবং তার থেকে সৃষ্ট বন্যার ভয়াবহতা বোঝা যায়নি, বুঝতে পারেনি, তাহলে সেটা স্রেফ অজুহাত।
ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কটা এখন আগের মতো নেই। নেই ভারতের দোষেই। তাদের একমুখী চিন্তা। একপাত্রে সব ডিম রাখা। জনগণের সাথে বন্ধুত্ব না গড়ে শাসকদলের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা। এসব বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষ এমনিতেই বিগড়ে ছিল। জুলাই ম্যাসাকারে ভারতের শাসকগোষ্ঠীর নীরবতা সেই বিগড়ে যাওয়াকে আরও বাড়িয়ে তোলে। আর সে কারণেই বর্তমান বন্যাকে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ রাজনৈতিক বন্যা হিসেবেই দেখছে। ফলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা মিছিল করেছে ভারতের বিরুদ্ধে। তারা এই বন্যাকে ভারতের শাসকগোষ্ঠীর আগ্রাসন হিসেবেই দেখছে। যাকে তারা বলছে, পানি আগ্রাসন।
অনেক মানুষই বলছেন, এত পানি তারা আর দেখেননি। তাদের অতীত স্মৃতিতে এমন বন্যা নেই। মানুষ ছাদে, টিনের চালে আশ্রয় নিয়েছে। স্রোতের জন্য তাদের উদ্ধার করা যাচ্ছে না। স্পিডবোট ভিড়তে পারছে না স্রোতের মুখে। আমি যখন লিখছি তখন গণমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে অন্তত ৮ জন মানুষ মারা গেছে বন্যায়। ভেসে গেছে ঘরবাড়ি, মানুষের সহায় সম্বল।
বিপরীতে বাংলাদেশের মানুষের ঐক্যের একটা নজিরও দেখা গেছে। সব অমঙ্গলের মাঝেই নাকি কিছু মঙ্গল থাকে। মানুষের ঐক্য হলো সেই মঙ্গল। সারাদেশের মানুষ, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তরুণা ঝাপিয়ে পড়েছে মানুষকে কূটনীতিসৃষ্ট বন্যার তাণ্ডব থেকে বাঁচাতে।
এই বন্যাকে কেন কূটনীতি সৃষ্ট বলছি তা ভারতীয় গণমাধ্যমের শিরোনাম দেখলেই বুঝতে পারবেন। বিশেষ করে মোদিমিডিয়া যাদের বলা হয় তাদের একটি হলো, ‘জি ২৪ ঘন্টা’। তারা বন্যা নিয়ে শিরোনাম করেছিল, ‘ভারত ছাড়ল জল! হাবুডুবু খেতে খেতে বাংলাদেশের কাতর আর্জি’। কতটা অসভ্য হলে একটি গণমাধ্যম এমন শিরোনাম করতে পারে। কতটা নিষ্ঠুর হলে ‘হাবুডুবু’ শব্দটি উল্লাসের সাথে ব্যবহার করতে পারে। জানি না, এমন শিরোনাম সাংবাদিকতার কোন নীতি-নৈতিকতার মধ্যে পড়ে! আমরা যে সাংবাদিকতা পড়ে এসেছি, এখনো পড়ছি এবং শিখছি, কোথাও এমন কথা নেই। এটা হলো প্রতিহিংসার কথা, সাংবাদিকতার কথা নয়। বিষয়টি মূলত প্রতিহিংসাই।
বন্যা বিষয়ে কিছু কারিগরি ব্যাখ্যা দিয়েছেন কেউ কেউ। আমি সে ব্যাখ্যায় যেতে চাইছি না। পানির হিসাব, বিপদসীমা কতটা অতিক্রম করলে আপনা-আপনি গেট খুলে যায়। সেই ব্যাখ্যাতে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করছি না। কারণ, পারিপার্শ্বিকতা এটা প্রমাণ করেছে যে, এই বন্যায় শুধু প্রকৃতিরই হাত নেই মানুষের হাতও রয়েছে। এখানে আরেকটি রাজনৈতিক কূটকৌশল সম্ভবত রয়ে গেছে, যা এখনো অনেকের চোখে পড়েনি। পড়লেও বন্যার আকস্মিকতায় সামনে আনতে ভুলে গেছেন। সেটা হলো গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী যে বিষয়গুলো চলমান ছিল, তাকে ডাইভার্ট করা। দেখুন, বন্যার পরে মামলা বা গ্রেপ্তারের উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। সরকার থেকে সাধারণ মানুষ সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বন্যা মোকাবেলায়। সুতরাং এই বন্যা কারো জন্য শাপে বর হয়ে দেখা দিয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে অন্তত তাই মনে হয়। এ যেন এক তীর দুই নিশানা।
২
এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা কেন বাতিল হবে না? যে ছেলেগুলো এতদিন আন্দোলনে ছিল। শহীদ হলো। এখনো শহীদের কাফেলায় যোগ হচ্ছে নতুন নতুন নাম। কেউ চোখ হারিয়েছে। কেউ হাত, কেউ পা। কেউ আহত হয়ে, গুলিবিদ্ধ হয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। চোখের সমুখে দেখেছে বন্ধু, ভাইয়ের মৃত্যু। বুলেটবিদ্ধ মানুষের যন্ত্রণা। তারা তো এখনো ট্রমার মধ্যে আছে। উন্নত দেশ হলে তাদের মনোরোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে কাউন্সেলিং করানো হতো এবং তাই উচিত।
এই ছেলেগুলোকে যারা পরীক্ষা হলে যাওয়ার কথা বলেন, তাদের মানবিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এদের নির্দ্বিধায় মানবতাবিরোধী বলা যায়। এদের অনেকেই হয়তো আন্দোলনের ধারেকাছে ছিলেন না। মানুষের মৃত্যুতে ঘরে বসে, টেলিভিশনে গুলিতে মৃত্যুর দৃশ্য দেখে পৈশাচিক আনন্দ লাভ করেছেন।
ওই পুলিশ কর্মকর্তার মতো বলেছেন, ‘গুলি করি, একটা মরে, একটাই যায়, বাকিডি যায় না।’ প্রয়োজন আরও হাজার হাজার হত্যার বিপরীতে ফ্যাসিস্ট র্যাজিম টিকে যাবে- এমনটাই ভেবেছেন কেউ কেউ। অথচ তেমনটা হয়নি। যদি হতো তাহলে হয়তো পরীক্ষার হলে অর্ধেক আসন খালি থাকতো। খালি আসনগুলির হয়তো কেউ মৃত, আহত কিংবা কেউ পলাতক। ধন্যবাদ পরীক্ষা বাতিলের জন্য। এই ছেলেদের এক ট্রমা থেকে আরেক ট্রমায় পর্যবসিত না করার জন্য।
৩
বই পোড়ানোর বিষয়ে কথা হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বই নয়, কারও কলিজা পোড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। পোড়ানো একটা প্রতিবাদের ধরণ। বিশ্বের অনেক নেতার কুশপুতুল পোড়ানো হয়েছে। এমনকি কোনো জায়গাতে পবিত্র কোরআনও পোড়ানো হয়েছে। তখন কিন্তু এই কেউ পোড়ানোর বিরুদ্ধে কথা বলেননি। কখন বলছেন, যখন ড. জাফর ইকবালের বই পোড়ানোর কথা বলা হয়েছে। আচ্ছা তাদের প্রশ্ন করি, অতীতে যাদের কুশপুতুল পোড়ানো হয়েছে পরবর্তীতে তারা কি অপাঙ্ক্তেয় হয়েছেন? তারা কি মুছে গেছেন? উত্তর হলো, না।
পোড়ানোর বিষয়টা মূলত সিম্বলিক। প্রতিবাদের ভাষা। দু-একটি বই পোড়ানো, বা সব বই পুড়িয়ে ফেললেও পিডিএফ এর যুগে বই হারায় না। জাফর ইকবাল মুক্তিযুদ্ধের সময় গর্তবাসী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তার কোনো মুভমেন্ট ছিল না। পরবর্তীতে তিনি যুদ্ধোত্তর যোদ্ধা সেজেছেন। নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাচ্চাদের আন্দোলনের সাথে বাটপারি করেছেন। একজন বাটপারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হতেই পারে এবং সেটা অনেক ফর্মেই হওয়া সম্ভব। তারমধ্যে বই পোড়ানো একটা। এই সিম্বলিক বিষয় নিয়ে যারা হাউকাউ করেন, তাদের চিন্তার দীনতা নিয়ে আফসোস হয়। সাথে প্রশ্ন ওঠে, এই সিম্বলিক প্রতিবাদে তাদের ভয়টা কোথায়?
ফুটনোট: বন্যা নিয়ে আরও লেখা যেত। কিন্তু হুট করে সব লিখা সম্ভব হয় না। বন্যা মোকাবিলার চেষ্টা চলছে। চলছে আলাপ-আলোচনা। শুনে, আরও ভালো করে বুঝে অনেক কিছুই লেখা সম্ভব হবে। লেখা সম্ভব হবে অন্য বিষয়েও। কোনো বিষয়ই দৃষ্টির বাইরে রাখা যাবে না। প্রশ্ন তুলতে হবে, তাহলেই উত্তর পাওয়া সম্ভব।