ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন একটি চিত্র। ছবি: সংগৃহীত
স্বৈরশাসনের পর বাংলাদেশের মানুষকে এখন বন্যা মোকাবিলায় নামতে হচ্ছে। নিরন্তর সংগ্রামে বেঁচে থাকাই এ জনপদের বৈশিষ্ট্য।
এরকম সংগ্রামে বাংলা বহির্বিশ্বের সমর্থন-সহায়তাও কম পায়নি। কিন্তু ইদানিং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে অপপ্রচারই যেন বেশি চলছে। জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থান ও তার পরিণতি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আন্তর্জাতিক পরিসরে অপপ্রচার বেশ বেড়েছে।
মুক্তি ও মানবিক মর্যাদার লক্ষ্যে পরিচালিত এরকম একটা গণআন্দোলনের বিরুদ্ধে কোথা থেকে, কারা ভুলবার্তা দেয় সেটার খোঁজ-খবর নেয়া নিশ্চয়ই জরুরি কাজ। তবে ২/১ জন ব্যক্তির পক্ষে সেসবের পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধান দুরূহ। কারণ এরকম অপ-প্রচারের আছে বহু ঢালপালা এবং বহু উৎসমুখ।
সদ্য-বিগত স্বৈরতন্ত্র এবং দেশ পুনর্গঠনের নতুন প্রচেষ্টা নিয়ে বিদেশমুখী প্রচারে বাংলাদেশকে এখনি গুরুত্ব দিয়ে ভাবা দরকার।
এ কাজে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর প্রেস-উইং একটা ভূমিকা রাখতে পারতো। কিন্তু সেখানে হয়তো পুরোনো জমানার মানুষরাই আছেন।
বাংলাদেশে থাকা আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা বা ‘আই-এনজিও’গুলো একাজে দারুণ একটা উপায় হতে পারতো। নতুন সরকার এসব বিষয়ে নিশ্চয়ই নজর দিবেন।
--
বাংলাদশে যেসব আই-এনজিও আছে তার কয়েকটি বেশ বড়। গত পাঁচ দশকের উন্নয়ন-সংগ্রামে তারাও অংশীদার।
এসব সংস্থার আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বেশ বড়। আন্তর্জাতিকভাবে তাদের কথাবার্তাকে বড় বড় মিডিয়া হাউজ এবং বুদ্ধিজীবী-গবেষকরা বেশ দাম দেন, শোনেন, বিশ্বাস করেন। এসব সংস্থার বাংলাদেশ অফিস থেকে কেন্দ্রীয় অফিসগুলোতে বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে নিয়মিত বার্তা পাঠাতে হয়। এবারও ছাত্র-জনতার আন্দোলনকালে এসব সংস্থা ‘কান্ট্রি অফিস’ থেকে ‘হেড অফিসে’ নিয়মিত আন্দোলনের বিবরণ ও মূল্যায়ন পাঠিয়েছে। এরকম কিছু বিবরণে দেখা যাচ্ছে, ছাত্র-জনতার সংগ্রামকে কিছু কিছু আই-এনজিও পরিচালক ভুলভাবে তুলে ধরেছেন হেড অফিসগুলোতে। সেগুলো আবার ঐসব হেড অফিস থেকে বিশ্বজুড়ে তাদের সকল ‘কান্ট্রি অফিসে’ গেছে।
একটি বড় আই-এনজিও’র বাংলাদেশ থেকে পাঠানো জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহের এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে তারা হেড অফিসকে জানাচ্ছে, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে ছাত্র আন্দোলন সহিংসতার কাছে হাইজ্যাক হয়ে গেছে…ছাত্র নেতারা যদিও বলছেন, তারা এসব সহিংসতায় যুক্ত নন, কিন্তু তারা না-করলে কে এসব করেছে? এই প্রতিবেদনে সর্বশেষ আন্দোলনে ‘জঙ্গি’ ব্যাপারটাও আরোপিত হয়েছে।
যে আই-এনজিওটির প্রতিবেদন থেকে এখানে উদ্ধৃতি দিলাম তারা বাংলাদেশে তরুণদের সঙ্গে কাজ করার জন্য বেশ কৃতিত্ব দাবি করে থাকে। সেটা মিথ্যাও নয়। কিন্তু তারা বহির্বিশ্বে তরুণদের কাজ সম্পর্কে এরকম বার্তা কেন দিল?
সেটা নিয়ে অনুসন্ধানকালে আরেকটা অদ্ভুত বিষয় দেখা গেল। বাংলাদেশের অনেক অনেক আই-এনজিও’র ডিরেক্টরই বিদেশি। আরও সরাসরি বললে, অনেক বড় বড় আই-এনজিও’র স্থানীয় পরিচালক ভারতীয়। বলা বাহুল্য, নিশ্চয়ই কোন-না-কোন পেশাগত যোগ্যতায় তারা এখানে এসেছেন। কিন্তু স্থানীয় জনগণের সঙ্গে, জন-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ততার জন্য স্থানীয় জাতি-ধর্ম-সংস্কৃতির মানুষ যেকোন বিদেশি সংস্থার পরিচালক হিসেবে অধিক বাস্তবসম্মত। বিশেষ করে বাংলাদেশের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থের দিক থেকে এটা জরুরি।
অনেক সময়ই দেখা যায়, পশ্চিমের দেশগুলো, সেখানকার নীতিনির্ধারকরা—বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিকে ভারতীয় সংস্কৃতি এবং ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের চোখ দিয়ে দেখতে আগ্রহী থাকেন। এটা হলে যে সমস্যা হয় সম্ভবত সেটাই এবার হলো।
এতবড় একটা জন-আন্দোলন, যাকে বাংলাদেশের স্থানীয় সমাজ একটা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করছে—অথচ উন্নয়ন-সংগঠকরা তাকে সহিংসতা বলে চিত্রায়িত করে বিদেশে বার্তা দিচ্ছেন। স্বভাবত পশ্চিমে এটা ভুল ইঙ্গিত ছড়াবে।
এরকম অবস্থায় বাংলাদেশের নতুন সরকারের আই-এনজিওগুলোর সঙ্গে বসা দরকার। দেশ গঠনে তাদের কার্যক্রম বাড়াতে উদ্ধুব্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে স্থানীয় সমাজের, স্থানীয় সংস্কৃতির, স্থানীয় জাতি-ধর্মের মানুষদের গণতান্ত্রিক আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেন কাজগুলো হয় সেটাও দেখা দরকার। এটা এখনকার একটা জরুরি কাজ।
--
আন্তর্জাতিক সমাজকে অবশ্যই বাংলাদেশকে স্থানীয় চোখ দিয়ে দেখতে পারতে হবে। একজন ব্যক্তি যেমন ভুল করতে পারে। একটা সমাজও অনেকসময় ভুল পথে হাঁটতে পারে। এখানকার সমাজের কোন যৌথ ভুল হলে সেটাও স্থানীয়ভাবে সংলাপের ভেতর দিয়ে সংশোধন করে এগোতে হবে। কিন্তু ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টের ঘটনাবলী নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সমাজের একটা বড় অর্জন। একে ভুলভাবে চিহ্নিত করার প্রচেষ্টা থামাতে হবে অবশ্যই।
বাংলাদেশের পুনর্গঠনে আন্তর্জাতিক সমাজের বাড়তি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে সবার আগে দরকার ইতোমধ্যে তৈরি হওয়া ভুলবার্তাগুলোর সংশোধন এবং ভবিষ্যতে যাতে এরকম ভুলবার্তা না যায় তার কাঠামোগত সংশোধন।
আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক