Logo
Logo
×

অভিমত

আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘুদের বন্ধু নয়, দুশমন

Icon

সহুল আহমদ

প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০২৪, ০৯:৫৫ পিএম

আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘুদের বন্ধু নয়, দুশমন

হাসিনাপুত্র জয় ভারতের বিভিন্ন মিডিয়াতে বা তার বক্তব্যতে বলার চেষ্টা করেন, আওয়ামী লীগ না থাকলে হিন্দু জনগোষ্ঠী খতরনাক হালতে পড়ে যাবে, বা অলরেডি পড়ে গেছে। ভারতের মিডিয়াপাড়াও একইভাবে বাংলাদেশকে একটি 'মৌলবাদী' দেশ হিসেবে তুলে ধরে যেখানে আওয়ামী লীগ হচ্ছে হিন্দু জনগোষ্ঠীর 'ত্রাণকর্তা'। শেখ হাসিনা পতনের পর ওনার নানাবিধ দিক/পক্ষ/বিপক্ষ বাদ দিয়ে ভারতের মিডিয়াপাড়া বাংলাদেশকে সেই একই ছকে তুলে ধরেছে। জয় যখন কোনোখানে বক্তব্য দিয়েছেন, তিনিও একই জুজুর ভয় দেখিয়েছেন। 

বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারতেছে না, এই নিয়ে অতীব ডানঘরনার ব্যক্তি ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক পক্ষই অস্বীকার করেন না। হিন্দু ধর্মাবলম্বী থেকে শুরু করে, সাঁওতাল, আহমেদিয়া পর্যন্ত - সকল বর্গের 'সংখ্যালঘু' নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। এইটা স্বীকার করেই আলাপ শুরু করি। 

পাশাপাশি, এটাও বলে নেওয়া ভালো, সম্প্রতি হাসিনার পলায়নের পর যে সকল হামলার ঘটনা ঘটছে, তার অধিকাংশ ক্ষেত্রে লীগের রাজনীতির সাথে যারা জড়িত ছিলেন তারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। ইতিমধ্যে সিলেটের কথা খোদ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদই বলেছে। অর্থাৎ, এটা ছিল আওয়ামী লীগের সাথে জড়িত লোকদের বিরুদ্ধে যে হামলা, তারই অংশ। ইতিমধ্যে পত্রিকাগুলোতেও সেই ধরনের প্রতিবেদন আসা শুরু হয়েছে।      

বর্তমানে ভারতে ও বাংলাদেশের আওয়ামী কালচারাল ইন্ডাস্ট্রি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত তোড়জোড়ে আওয়ামী লীগকে 'হিন্দুদের ত্রানকর্তা' বা 'বন্ধু' হিসাবে হাজির করার জোর কোশেশ চলছে। আমার আপত্তি এখানেই। এটা ধরতে পারা গুরুতর। এটা ধরতে না পারলে বোঝা যাবে না, কীভাবে 'ত্রাতা'র ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে সবচেয়ে নোংরা ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আওয়ামী লীগই করে যাচ্ছে। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে, তাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে, উপরন্তু মৌলবাদের জুজু ও ভয় দেখিয়ে, তাদের সেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বহাল রাখছে। 

আমি আওয়ামী জমানার কিছু তথ্য আপাতত তুলে দেই। আইন ও সালিশ কেন্দ্র ২০২১ সালে জানিয়েছিল যে, ২০১৩ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৯ বছরে হিন্দুদের উপর ৩৬৭৯ হামলা হয়েছে। তখন বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেছিলেন, এই সংখ্যা আরও বেশি হবে। ২০১৩ সাল থেকে ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত আসকের হিসাব অনুযায়ী, সংখ্যালঘুদের মন্দির, পূজামণ্ডপ বা মূর্তির ১৮৭৯টি হামলার ঘটনা ঘটেছে; ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘরে ২১৯০টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। আহত হয়েছেন ৯৫৮টি। 

এমনকি রানা দাশগুপ্ত ২০২১ সালেই স্বীকার করেছেন, আওয়ামী লীগ আসার পর তারা ভেবেছিলেন, হামলা কমবে বা বন্ধ হবে, আদতে সেটা বৃদ্ধি পেয়েছে। 

খোলামনে এই তথ্যউপাত্ত দেখলে এবং রানা দাশগুপ্তের কথা শুনলে বোঝা যাচ্ছে, আওয়ামী জমানা হিন্দু ও সংখ্যালঘুদের জন্য মোটেও 'ত্রাণকর্তা'স্বরূপ ছিল না। তারপরও যুক্তির খাতিরে অনেকে বলতে পারেন, এইসব হামলাতে জড়িত যারা ছিলেন তাদের রাজনৈতিক পরিচয় কী ছিল? গত পনের বছরের এই জায়গাটা খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য সর্বাধিক ক্ষতিকর দল হচ্ছে আওয়ামীলিগ। 

আমি কয়েকটা কেসস্টাডির কথা বলে ব্যাখ্যা করি।

কেস ১ :  ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে দুর্গাপূজা চলাকালে সারাদেশের প্রায় ১৫টি জেলায় এক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এই হামলাগুলোর ঘটনার সাথে বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততা লক্ষ্য করা যায়। যেমন, রংপুর পীরগঞ্জের বড় করিমপুর মাঝিপাড়া হিন্দুপল্লিতে হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার মো. সৈকত মণ্ডল ছিলেন কারমাইকেল কলেজের দর্শন বিভাগ ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি। এই সমন্বিত হামলার সময় চাঁদপুরে ছাত্রলীগের নেতা এবং স্থানীয় আওয়ামীলী নেতা শাহিদা বেগমের ছেলে আরিয়ান সাজ্জাদ স্থানীয় মুসলমানদের ‘কোরান অপমান’ এর প্রতিবাদে হিন্দুদের মন্দির ও পূজামন্ডপে হামলার আহ্বান জানান। বান্দরবানে আওয়ামী লীগ নেতা জহিরুল ইসলাম মন্দিরে হামলার শুরুতে উন্মত্ত জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন।   

কেস ২ : ২০২১ সালের ১৭ মার্চ হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের সমালোচনা করে এক যুবকের ফেসবুকে দেওয়া একটি স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে আগে থেকে ঘোষণা দিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করে শাল্লা উপজেলার একটি হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে কয়েক হাজার মানুষ হামলা চালিয়ে ৮৮টি বাড়িঘর এবং ৭/৮টি পারিবারিক মন্দির ভাংচুর করে এবং ব্যাপক লুটপাট চালায়। এই ঘটনায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) যাকে প্রধান আসামী হিসেবে গ্রেফতার করে সেই শহীদুল ইসলাম স্বাধীন ছিলেন আলোচিত ইউপি সদস্য ও যুবলীগ নেতা। 

কেস ৩ : এটা সাঁওতালদের নিয়ে। গুরুত্বপূর্ণ কেস। কারণ এতে সংখ্যালঘুদের হেফাজতে আওয়ামী প্রশাসনের ভূমিকা কী ছিল সেটাও স্পষ্ট হয়। ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের রংপুর চিনিকলের সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারে আখ কাটাকে কেন্দ্র করে পুলিশ সাঁওতালদের ওপর আক্রমণ করে তাদের বসতঘর আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে উচ্ছেদ করার ঘটনা ঘটে। তিনজন সাঁওতাল মারা যান। এক ভিডিওতে দেখা যায়, সাঁওতালদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হচ্ছে এবং সাঁওতালদের বসতির পাশেই দাঁড়িয়ে অনেক পুলিশ গুলি করছে এবং কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ছে। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে তাদেরই মধ্য থেকে মাথায় হেলমেট এবং বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পড়া একজন পুলিশ সদস্য সাঁওতালদের বাঁশ এবং ছনের তৈরি ঘরের কাছে গিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। মুহূর্তেই আগুন ধরে যায় এবং পাশের ছনের ঘরগুলোতে তা ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে সিভিল ড্রেসে কয়েকজনকে জনকে দেখা যাচ্ছে। সংঘর্ষের পর জেলা প্রশাসনের গঠন করা তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে স্থানীয় সাপমারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ছাত্রলীগ সভাপতি শাকিল আকন্দ বুলবুলকে মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিবেদনের মূল অংশে রংপুর চিনিকলের জমি নিয়ে এ পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দায়ী করা হয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিবকেও। যখন অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয় তখন অদ্ভূতভাবে পুলিশ সদস্যদের নাম যেমন বাদ দেওয়া হয়, তেমনি সাঁওতালদের উচ্ছেদের সময় তিন সাঁওতাল হত্যা মামলার প্রধান আসামি গাইবান্ধা-৪ আসনের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালম আজাদের নামও বাদ দেওয়া হয়। 

কেস ৪ : ২০১৬ সালের ২৯ অক্টোবর ফেসবুকে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ তুলে ব্রাম্মনবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার হরিণবেড় গ্রামের এক হিন্দু যুবককে পিটিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে একদল যুবক। পরদিন এলাকায় মাইকিং করে উপজেলা সদরে পৃথক দুইটি সমাবেশ থেকে ১৫টি মন্দির, হিন্দু সম্প্রদায়ের শতাধিক ঘরবাড়িতে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এরপর ৪ নভেম্বর ভোরে ও ১৩ নভেম্বর ভোরে আবারও উপজেলা সদরে হিন্দুদের অন্তত ছয়টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নাসিরনগর এলাকার সংসদ সদস্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী মোহাম্মদ সায়েদুল হক এবং আওয়ামী লীগ নেতা আর.এ.এম. ওবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকারের মধ্যে বিরোধের জের ধরে আক্রমণ করা হয় বলে সংবাদ মাধ্যম মারফত জানা যায়। এই ঘটনার মূল হোতা ছিলেন আওয়ামী লীগের হরিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দেওয়ান আতিকুর রহমান আঁখি। আওয়ামী লীগের পূর্বভাগ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমানের ভাই মো. আক্তার মিয়া ও নাসিরনগর সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল হাসেম এতে জড়িত ছিলেন। চার্জশিটভুক্ত তিন আসামি ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়নও পেয়েছিলেন। 

কেস ৫: ২০১৬ সালের ২২ মার্চ খুলনার পাইকগাছা উপজেলার সোলাদানা ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বিএনপির সমর্থিত প্রার্থী এনামুল হক জয়লাভ করেন। নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের প্রার্থী তার দলীয় ক্যাডার নিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা করেন। আক্রান্তরা জানিয়েছিলেন, ‘নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আবদুল মান্নান গাজী ও তাঁর ক্যাডার বাহিনী এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের পাঁচ শতাধিক ঘরবাড়ি ভাঙচুর করেছে। মিথ্যা মামলা দেওয়ায় পাঁচ হাজার নারী-পুরুষ এলাকা ছেড়ে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়েছে। তারা বেছে বেছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িতে হামলা চালাচ্ছে।’ এমনকি পুলিশ নিয়ে হয়রানি করার কথাও উল্লেখ করা হয় পত্রিকার সংবাদে। 

কেস ৬ : এই ঘটনাটা বেশি আগ্রহোদ্দীপক। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করে ক্ষমতাসীনদের দ্বারা সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেওয়ার নজির হচ্ছে ২০২২ সালে শ্রীমঙ্গলের প্রীতম দাশের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা। প্রীতম দাশ চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে শ্রীমঙ্গল শহরে সমাবেশের আয়োজন করেছিলেন। তিনি স্থানীয় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও পুলিশ প্রশাসনের টার্গেটে পরিণত হন। তাকে শায়েস্তা করতে মরিয়া স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের এক নেতা প্রীতমের পুরোনো ফেসবুক পোস্টের স্ক্রিনশট ভাইরাল করে প্রমাণের চেষ্টা চালান যে, প্রীতম ইসলাম ধর্মকে ‘অবমাননা’ করেছেন। ধর্মীয় পরিচয়ের দিক থেকে প্রীতম হিন্দু হওয়ায় তার বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্ম অবমাননার অপবাদ সহজেই বিশ্বাস্য হয়। স্থানীয় ক্ষমতাসীন পক্ষ সেই মওকা ছাড়ে নাই। প্রীতমের বিরুদ্ধে লাগাতার মিথ্যা ও বানোয়াট প্রচারণা চালিয়ে এক ধরনের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরিতে সাময়িকভাবে তারা সফল হয়। কিন্তু স্থানীয় ধর্মপ্রাণ মুসলিম সমাজ এবং কয়েকটি মসজিদের ইমামদের তৎপরতায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার প্রশমন করা সম্ভব হয়। তারা এলাকাবাসী বোঝান যে, প্রীতম ইসলাম ধর্মকে কোনো অবমাননা করে নাই। এতে করে শুক্রবারের জুম্মা নামাজের পরে ‘তৌহিদি জনতা’র ব্যানারে ক্ষমতাসীনদের পূর্বপরিকল্পিত মিছিল বের করা আর সম্ভব হয় নাই। স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা পুলিশের সহযোগিতায় প্রীতমের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করে এবং যথারীতি পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। এই মামলায় প্রীতম দাশ ১৩১ দিন কারাবন্দী ছিলেন। 

উপর্যুক্ত পরিসংখ্যান থেকে যা বোঝা যাচ্ছিল না, সেটা এই ছয়টা ঘটনা দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করতেছি। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা নেই, এমন কোনো কথা যেমন আমি বলছি না, তেমনি এটাও বলছি, হরে দরে বাংলাদেশের জনগণকে সাম্প্রদায়িক বলে গালি দেওয়াটাও কাজের কথা নয়। (আমাদের 'সাম্প্রদায়িকতা' বই আপনারা দেখতে পারেন, বিস্তারিত আলোচনা আছে)। এবং, এবার তো সমাজের সক্রিয়তা যেভাবে মন্দিরের সামনে গড়ে উঠেছিল, তাতে হরেদরে সাম্প্রদায়িক বলার অভ্যাসটা পরিত্যাগ করার দিকেই ইশারা দিচ্ছে বলে মনে করি। 

এই ছয়টা কেসস্টাডি থেকে স্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছে, প্রায় প্রতিটি আক্রমণেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জড়িত ছিলেন। তারা যেমন তাদের অন্তর্কোন্দলের বলি বানিয়েছেন হিন্দু ও সংখ্যালঘুদের, তেমনি 'তৌহিদি জনতা' নামক মব তৈরিতেও ছিলেন সমান সক্রিয়। একইভাবে সংখ্যালঘুদের ওপর যারা হামলা করেছেন, এসব চিহ্নিত লোককে তারা মনোয়ন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। তবে, কখনো কখনো ফেসবুকে সমালচনা শুরু হলে সেটা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছেন। আবার হামলাতে আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের সক্রিয়তা এবং বিচার কার্যক্রমে তাদের নিষ্ক্রিয়তা সাঁওতালদের ঘটনায় দেখা যায়। 

এটাও উল্লেখ করা জরুরি, আবুল বারাকাতের মতো চিহ্নিত আওয়ামী গবেষকরাই দেখিয়েছেন, স্বাধীনতার পর হিন্দু জনগোষ্ঠীর বসতভিটা সবচেয়ে বেশি যারা দখল করেছেন, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় হচ্ছে 'আওয়ামী লীগ'। 

সব বাদ দেন, কেবল এই ২০২৪ সালের জুন মাসের প্রতিবেদন দেখুন। রানা দাশগুপ্ত  শেখ হাসিনার কাছে আর্তি জানিয়েছিলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এলাকাটি আপনারই। আপনি একবার এলাকায় আসুন, আপনি দেখে যান, কীভাবে এখানকার সংখ্যালঘুদের জায়গা-জমি জবরদখল করেছেন বেনজীর আহমেদ। আমরা দাবি ও আবেদন জানাই, যাঁদের সম্পত্তিগুলো দখল করা হয়েছে, তাঁদের সম্পত্তিগুলো ফেরত দেওয়া হোক।’

এখন চিন্তা করেন, এই বেনজির কে? আওয়ামী লীগ যে ত্রাসের রাজনীতি কায়েম করেছে গত পনের বছরে তার সবচেয়ে বড় সহযোগী ও সুবিধাভোগী হচ্ছেন বেনজির আহমেদ। তিনি ছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান।  

অর্থাৎ, আওয়ামী লীগ একদিকে গত পনের বছর যাবত হিন্দু ও সংখ্যালঘুদের ওপর সর্বাধিক নিপীড়ন চালিয়েছে, প্রত্যেক নিপীড়নের পর সেটার দায় চাপিয়েছে জনগণের কাঁধে, জনগণকে 'মৌলবাদী' বানানোর পায়তারা করেছে এবং সেই 'মৌলবাদ' এর ভয় হিন্দু জনগোষ্ঠীর ভেতর সংক্রমণ করার কোশেশ করে নিজেরা আবার তাদের 'ত্রাতা' সাজার ভনিতা করেছে। সোজা ভাষায়, এই হচ্ছে সংখ্যালঘুদের নিয়ে আওয়মীলীগের নোংরা রাজনীতির ছক। 

সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বাংলাদেশে দীর্ঘদিন যাবত সিভিল সোসাইটি থেকে শুরু করে নানা মহল বলে আসছেন। নতুন যে সরকার এসেছেন, বা যারাই আসবেন পরবর্তীতে, এই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে জরুরি কাজ। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যে সংস্কারের কথা চাউর হয়েছে, সেটা ছাড়া যেমন সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়, তেমনি এই নিরাপত্তা নিশ্চিত না করেও সংস্কার সম্ভব নয়। 

কিন্তু, হাসিনা পতনের পরপর আওয়ামী লীগ ও ভারতের একপাল মিডিয়া যেভাবে হাসিনার হত্যাযজ্ঞকে ঢাকতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জড়াচ্ছে এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এই গণঅভ্যুত্থানের বিপরীতে দাড় করানোর পায়তারা করতেছে এটা বিপজ্জনক। তারা দীর্ঘদিন যাবত বাংলাদেশের হিন্দুদের জায়গা জমি বসত ভিটা দখল করে আসছেন, হিন্দুদের ওপর আক্রমণ করে আসছেন, অথচ, পতনের পরদিনই ভারতে গিয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য মায়াকান্না করছেন - এটা গভীর ও নোংরা রাজনীতি। 

হাসিনা ও আওয়ামী লীগ হিন্দু ধর্মাবলম্বী ও সংখ্যালঘুদের বন্ধু বা ত্রাতা নয়। বরঞ্চ সবচেয়ে বড় দুশমন। একদিকে, যেমন তিনি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছেন, অন্যদিকে এখন তিনি তাদেরকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার পায়তারা করছেন। অন্তত তাদের কথা থেকেই এটা স্পষ্ট।   

তুষারের কাছ থেকে ধার করেই বলি, 'বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের স্বাধীন কর্তাসত্তা ও দেশপ্রেমের ব্যাপারে মারাত্মক ধরনের অবজ্ঞা থাকলেই কেবল এমন পরিকল্পনা করা যায়। শেখ হাসিনার এই রাষ্ট্রদ্রোহী ষড়যন্ত্র সফল হবে না।'

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন