বাংলাদেশ আবার জিতলো। আমরা যারা সরাসরি এই বিজয়ের মুহূর্তটি লাখো জনতার সাথে উপভোগ করলাম তারা জীবনে এই অভিজ্ঞতা ভুলতে পারবো না। প্রবল প্রতাপশালী খুনি হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করেছে জনতা। যেই মুহূর্তে শাহবাগ চত্বরে খবর এলো যে খুনি হাসিনা ক্ষমতা ত্যাগ করেছে, গোটা দেশের মতো সেখানকার জনগণ উদ্বেল হয়ে উঠলো। দেখা গেলো, এক লোক সবার থেকে উঁচুতে উঠে বাংলাদেশের পতাকা পতপত করে উড়াচ্ছে। লোকটার পরনে লুঙ্গি আর উপরের অংশ খালি। তবু সে কি উচ্ছ্বাস! মুক্তির আনন্দ!
বাংলাদেশের অবস্থাও এখন ঠিক যেন এমন। হাসিনা দেশটাকে একদম ভেতর থেকে ক্ষয় করে ফেলেছে। আমরা সংবাদে দেখতে পাই, কতো ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার টাকা তারা পাচার করেছে, লুট করেছে। কেউ কেউ দেখাচ্ছেন, এক হাজার টাকার নোট পাশাপাশি রাখলে এই নোটগুলোর দৈর্ঘ্যে পৃথিবীর সমান হবে আর উপর নিচে রাখলে এভারেষ্টের। এই টাকাপয়সা লুট করে গড়া হয়েছে বেগমপাড়া। দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী দেশগুলোতে বিলাসব্যসন করেছে লুটেরা আর তাদের পরিবার। গরিব দেশের মেহনতি মানুষের রক্তপানি করা সম্পদের এহেন অবিশ্বাস্য লুটপাট পৃথিবীতে বিরল। অবশ্য, শুধু অর্থ আর সম্পদের লুটপাট নয়, হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৫ বছরে দেশের সমস্ত প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে গেছে।
আদালত কলুষিত হয়েছে, হাতের পুতুল হয়ে ছিলো সরকারের। ব্যাংকগুলো খালি হয়ে গেছে, অর্থনীতি ধ্বংস। দলীয়করণের প্রভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো জনগণের নিরাপত্তার বদলে পরিণত হয়েছে খুনে যন্ত্রে। র্যাবের মতো প্রতিষ্ঠান পরিণত হয়েছে কন্ট্রাক্ট কিলার বাহিনীতে। আয়নাঘর বানিয়ে নির্মমতম অত্যাচার করা হয়েছে লুটেরাদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললেই। যাদেরই তাদের অপছন্দ হয়েছে, যাদের কথা সহ্য হয়নি, তাদের নানা রকম ট্যাগ দেওয়া হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের মতো মহান ঘটনাকে কলুষিত করেছে চেতনার হোলসেলার সেজে। অথচ মানুষের মুক্তির ছিঁটেফোঁটাও তাদের চেতনায় ছিলো না। উন্নয়নের নামে চলেছে অসীম দুর্নীতি। দুই টাকার জিনিসের জন্য বিশ টাকার টেন্ডার করেই ক্ষান্ত হয়নি, সেগুলো নিয়ে বড়াইও করেছে। দেশটা যেন শুধু তাদের, বাকিরা সব ক্রীতদাস, তাদের কাজ এদের আরাম-আয়েশের চিরন্তন যোগান দেয়া। মুখে অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের শত শত একর জমি দখল করেছে বেনজীর গং। পাহাড়ে ছড়িয়েছে আতংক। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার নাম করে রাজনৈতিক ফায়দা আর পয়সা লুটের মচ্ছব করেছে।
সরকারি চাকরির বৈষম্য নিয়ে ছাত্ররা আন্দোলন করেছে। কারণ এইসব চাকরি পেতো কেবল সরকারি দলের কর্মী অথবা বিপুল ঘুষ দিতে পারা লোকেরা। সামান্য কেরানি থেকে সর্বোচ্চ পদের অফিসারে নিয়োগ ঘুষের বিনিময়ে হওয়াটাই বাংলাদেশে রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছিলো আওয়ামী লীগ আমলে। কেউ কেউ বলতে পারেন, এ তো আমাদের সব সময়েই কমবেশি ছিলো। কিন্তু আওয়ামী লীগ আমলে সবকিছুর মাত্রা ছাড়িয়েছিলো। যে শিশুটির জন্ম আওয়ামী আমলে সে দেখলো, এই দেশে সব ক্ষেত্রে দুর্নীতিই যেন নিয়ম। একটা দেশের জন্য এর চেয়ে খারাপ আর কি হতে পারে!
স্বভাবতই, এই দেশে যারা মেধাবী তাদের মূল লক্ষ্য হয়ে উঠলো কোনোমতে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া। যারা অনেক কষ্টে মাটি কামড়ে থাকলো তাদের জন্য রইলো কেবল হতাশা। শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় আমাদের যোগ্য, উপযুক্ত নাগরিক গড়ে উঠার পথ বন্ধ হলো। অন্যদিকে প্রবল অসাম্যে গরিব মানূষের সংখ্যা বাড়লো শহরে আর গ্রামে। এদের একটা বড় অংশ, মেধাবীদের মতোই, চেষ্টা করলো দেশ ছাড়ার। মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশে কামলা দেয়ার অসম্ভব জীবন, পরিবার ছেড়ে বহুদূরে থাকার কষ্ট বেছে নিলো, কেবল টিকে থাকার জন্য। বাংলাদেশের সমস্ত স্বপ্ন, সমস্ত আশা ধূলিসাৎ। কেবল আওয়ামী দালালদের রংঢং করা উন্নয়নের বুলি আর ডাকাতি করা কাঠামোর নিচে দেশের সমস্ত স্বপ্ন শেষ।
শাহবাগে অর্ধ উলঙ্গ মানুষটার চেয়েও দেশের অবস্থা যখন শোচনীয় তখন যেন অনেকটা অলৌকিকভাবেই আসলো মুক্তির সুযোগ। দেশের সমস্ত রাজনৈতিক দল যখন ব্যর্থ, তখন আবারো ছাত্ররাই এগিয়ে এলো দেশের মুক্তিদূত হয়ে। ওরা বৈষম্যর বিরুদ্ধে কথা বললো। ডাইনি হাসিনা আর তার সহচররা যথারীতি অবজ্ঞা করলো, ঠাট্টা করলো। অধিকার চাওয়ায় ওদের বললো রাজাকার। ছাত্ররা ফুঁসে উঠলো। ক্ষমা চাইতে বললো, সব হারালেও ওরা ইজ্জতটা হারায়নি তা বুঝিয়ে দিলো।
ক্ষমতার দম্ভে থাকা শাসকদল ভাবলো ওদের এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দেবে। যেমনটা ওরা একসময় সড়ক নিরাপদ করতে চাওয়া শিশুদের হাতুড়িপেটা করে উড়িয়ে দিয়েছিলো। কুখ্যাত ছাত্রলীগকে মাঠে নামানো হলো। কিন্তু পোড় খাওয়া প্রজন্ম এখন বড় হয়েছে, ওরা রুখে দাঁড়ালো দানবের বাচ্চাদের।
এরপর মাথা খারাপ করে ডাইনি নামালো তার সশস্ত্র বাহিনীকে। যেই বাহিনী জনগণের টাকায় প্রতিপালিত হয়, তারাই জনতার বুকে গুলি করলো। নিরস্ত্র জনতাকে শত্রুজ্ঞান করে নির্মমভাবে মারলো। সাহসী আবু সাঈদের ছবি গোটা দেশকে শোকে, ক্রোধে উদ্বেলিত করলো।
তাই, অস্ত্রের বিরুদ্ধেও মরিয়া মানুষ নেমে আসলো রাস্তায়। পিলপিল করে নেমে আসা মানুষকে গণহত্যা করা হলো। কিন্তু তাতেও স্বৈরাচারের ফায়দা হলো না। গুলি ফুরালেও মানুষের দম ফুরালো না। নিহত সহযোদ্ধাদের নিয়েই তারা প্রতিরোধ গড়লো খুনিদের বিরুদ্ধে। সেই প্রতিরোধে মিললো সব শ্রেণির মানুষ। যেইসব বাচ্চারা সমাজে সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, তারা জীবনের মায়া করলো না। নারীরা নেমে এলো রাস্তায়। একই সাথে হিজাব আর টিশার্ট পরা নারীরা হাতে হাত রেখে লড়াই করলো। শ্রমিক শ্রেণির মানুষেরা যোগ দিলো এই কাফেলায়।
কয়েকশো মানুষ মেরে, ইন্টারনেট বন্ধ করে, রাস্তায় সেনাবাহিনী নামিয়ে সেযাত্রায় সামলে নিলো সরকার। সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে কেউ কেউ তাঁদের প্রতি সম্ভ্রমে আবার কেউ কেউ প্রবল রক্তপাতের আশংকায় রাস্তা ছাড়লো ঠিকই কিন্তু তাঁরা আশায় রইলো এই প্রবল অন্যায়, এই প্রবল গনহত্যার বিচার হবে। তবে, এই সাময়িক বিরতিকে জনবিচ্ছিন্ন সরকার ভাবলো জনতার অক্ষমতা হিসেবে। তাই সেই অবস্থাতেও তারা নিজেদের দম্ভ বজায় রাখলো।
প্রহসনের বিচার বসিয়ে কোটা সংস্কার আর মিথ্যা কথা বলে জনতাকে প্রবোধ দিতে লাগলো। সেই বহু ব্যবহারে পচে যাওয়া বিএনপি-জামাত আর জংগী জুজুর ভয় দেখাতে লাগলো। উলটো জনতাকেই দোষী সাব্যস্ত করতে লাগলো। আদালতে লাখো লাখো অজ্ঞাতনামা লোকের নামে মামলা দিলো যাতে একদিকে লোকজনকে ভয় দেখানো যায়, অন্যদিকে যাকে তাঁকে তুলে এনে টাকাপয়সা কামানো যায়। আন্দোলনের নায়ক, বৈষম্য বিরোধী জোটের সমন্বয়কদের তুলে নিয়ে যাওয়া হলো ভাতের হোটেল নামে কুখ্যাত হারুনের ডিবি অফিসে। ওদের এমনভাবে অপমাণ করা হলো যা দেখে এমনকি আওয়ামী নিয়ন্ত্রিত আদালত পর্যন্ত বললো এইসব মশকরা বন্ধ করতে। জনতা বুঝলো, এদের পতন ছাড়া দেশ বাচানোর আর কোন রাস্তা খোলা নেই। এরজন্য যদি সবার মরতে হয় তাই-ই সই।
ফলে, ছাত্র-জনতার নয় দফা নেমে এলো এক দফায়। শেখ হাসিনার অপসারণ। ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড ভীত অথচ আরো বেশি কঠোর হওয়া সরকার এই জনদাবীকে গুড়িয়ে দেয়ার জন্য সর্বোচ্চ নৃশংসতার জন্য প্রস্তুত হলো। এইবার লেলিয়ে দেয়া হলো আওয়ামী লীগের কর্মীদের। এরা দেশের জনগণের উপর হায়েনার পালের উপর লাফিয়ে পড়লো। কিন্তু, দেশের মানুষ তখন আর কিছুকে ভয় পায়না। মানুষের দাবড়ানি খেয়ে উলটা হায়েনার দল পিছু হটলো। বেশিরভাগ জায়গাই মুক্তিকামী জনতা দখল নিলো। হাসিনার সমস্ত আশার দরজা বন্ধ হতে লাগলো। শোনা গেলো, সেনাবাহিনীও গণহত্যার ব্যাপারে বিরক্ত হয়ে উঠেছে কারন বহির্বিশ্বের চাপে জাতিসংঘে শান্তি মিশনসহ বিভিন্ন সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হবে কোনরকম গণহত্যায় জড়িত থাকলে। হাসিনার ভাঙ্গা নৌকা থেকে শামীম ওসমানের মতো ইদুরেরা লাফিয়ে পালাচ্ছে বিপদের গন্ধ পেয়ে। সেনাবাহিনীও অস্তগামী সূর্যের পুজা করা থেকে বিরত থাকবে বলে লোকে আশা করতে লাগলো। কিন্তু ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কামানো লুটেরার দল মরণ কামড় দেবে না তা কি হয়!
ছাত্রদের ভাষায় ৩৬ জুলাই (আগষ্ট ৫) শুরু হলো বাংলাদেশের ইতিহাসের ঐতিহাসিক দিন হিসেবে। ছাত্রজনতা এইদিন ঢাকা মার্চ করবে। ঘেরাও করবে গণভবণ। প্রবল শংকার সঙ্গে বিজয়ের আকাঙ্ক্ষায়। রাতের শেষের পর দিনের আলো দেখার স্বপ্ন। কিন্তু, অন্ধকারতম রাত কতো দীর্ঘ হবে, উৎকণ্ঠায় গোটা দেশ। তরুনরাসহ অনেকেই শপথ নিলো, জীবন যাবে তবু মুক্তি না নিয়ে ঘরে ফিরবে না। লাখো লাখো মানুষ।
সেদিন সকালে ঢাকার বেশ কয়েকটি প্রবেশপথে সংঘর্ষ হলো। ঢাকার ভেতর আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র শহীদ মিনার আর শাহবাগে থমথমে পরিবেশ। সেনাবাহিনীর সাজোয়া যানের ভিড়েই প্রবল সাহসী কিছু মানুষ। জীবন দিয়ে হলেও দেশকে মুক্ত করার আকাঙ্ক্ষায়। বাংলাদেশ হারবে না।
একটু পর দেখা গেলো সাঁজোয়া গাড়িগুলো একটা একটা করে সরে যাচ্ছে। পুরো দেশে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় জানার উপায় নেই কি হচ্ছে। বাসায় থাকা শুভানুধ্যায়ীরা ফোনে জানাচ্ছেন একটা কিছু হচ্ছে। এরপর জানা গেলো সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। লোকে দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে শুরু করলো। তার কিছুক্ষন পর সব সাঁজোয়া যান সরে গেলো। আমরা জানতে পারলাম খুনী হাসিনা পদত্যাগ করেছে। বাংলাদেশের মানুষের জয় হয়েছে।
মুক্তির আনন্দ ছড়িয়ে পড়লো রাজপথগুলোতে। এরপর দেখা গেলো সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য। দলে দলে মানুষ ছুটে আসছে শাহবাগের দিকে। জানা গেলো যাত্রাবাড়ি থেকে আসছে তিন থেকে চার লাখ মানুষ। উত্তরা দিয়ে লাখের বেশি। সূর্য তখন মাথার উপরে তাপ ছড়াচ্ছে কিন্তু এর চেয়ে বহুগুন উত্তাপে মানুষ আসছে, পরস্পরকে জড়িয়ে ধরছে। অনেকের চোখে আনন্দের অশ্রু। সবার চোখে মুখে স্বাধীনতার আনন্দ। কেউ কেউ প্রিয়জন হারানোর বিষাদে ডুকরে কাদছেন।
এরপর মিছিলগুলোর অভিমুখ পরিবর্তন হলো। গণভবনের উদ্দেশ্যে হাটতে লাগলো মানুষ। সেখানে পৌছে বাধনহারা হয়ে গেলো। যে যা পারলো তুলে নিলো। ব্যাপারটা ন্যাক্কারজনক হলেও, এতোদিনের প্রবল শ্বাসবন্ধ অবস্থা থেকে তা কিছুটা স্বস্তি আনলো। আবার, এও দেখালো, স্বাধীনতা অর্জন হলো কেবল, একে রক্ষা করতে হবে। দেশে অতি দ্রুত শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।
বিকেলে গোটা শহরের মানুষ যেন রাস্তায় নেমে এলো। সবাই হাঁটছে, স্লোগান দিচ্ছে, কোলাকুলি করছে। পতপত করে উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা। সবার চোখে-মুখে কি দারুণ উচ্ছ্বাস আর গর্ব। যে মানুষগুলো দুই দিন আগেও জড়োসড়ো হয়ে থাকতো, কথা বলার বদলে ফিসফিস করতো, ভয়ে থাকতো প্রবল স্বৈরাচারের, তারা মাথা উঁচু করে হাঁটছে। জোরে উল্লাস করছে, গান গাইছে, ভয়ডরহীনভাবে।
স্বপ্ন দেখছে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার।