গুলিবর্ষণের কথিত আগাম আদেশ আসলে কী বিষয়
ব্যারিস্টার জিল্লুর রহমান
প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০২৪, ০৫:১৩ পিএম
এক
বেআইনি, ভুয়া এবং অজ্ঞতায় ভরা একটি কথন! দেশে ঘোষিত যুদ্ধাবস্থা ছাড়া কখনোই কোনো অবস্থাতেই কেউ কাউকে আগাম গুলির আদেশ দিতে পারে না। হোক সে মন্ত্রী, ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ বা যেকোনো পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তা। অথচ অবলীলায় সেই কথাগুলো আমরা অনর্গল বলতে শুনি এই সকল ব্যক্তিবর্গের মুখ থেকে।
আরেকটি ভণ্ডামির বয়ান– “দেখামাত্র গুলির আদেশ দিয়ে কারফিউ জারি করা হয়েছে!” আরে ভাই! দেখামাত্রই যদি গুলির আদেশ হয়ে থাকে তাহলে তোমরাই যারা তথাকথিত কারফিউ পাস ইস্যু করছো, পাসধারীরা তো তা দেখানোরই সুযোগ পায় না, তার আগেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মরে যেতে হয়! তাহলে বুঝুন, এদেশের সরলপ্রাণ জনগণকে কতভাবে ধোঁকাবাজি করে চলেছে তাঁদেরই ট্যাক্সের পয়সার বেতনভোগী এই সকল কৃতঘ্নরা!
আসলে দেখা মাত্রই গুলি (shot at sight) এটি শুধুমাত্র দেশের যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করলে সেনাবাহিনী কর্তৃক এমন নির্দেশ প্রদান করা হয়ে থাকে। যেহেতু বাংলাদেশ কোনো দেশের সাথে যুদ্ধ করছে না অথবা কোন পক্ষ থেকেই গৃহযুদ্ধের কোনো ঘোষণা দেওয়া হয় নাই, সুতরাং দেখা মাত্রইগুলির নির্দেশ এটি বেআইনি ও অসাংবিধানিক। দুর্ভাগ্য এ জাতির যে, এমন ব্যক্তিবর্গ দ্বারা তাঁদের শাসিত হতে হচ্ছে!
দুই
শুধুমাত্র তিনটি ক্ষেত্রে ঘটনাস্থলে উপস্থিত রাষ্ট্রীয় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারকারী কোনো সদস্য পরিস্থিতি-পরিবেশ বিবেচনায় তা ব্যবহার করতে পারেন–
প্রথমত: তাঁর নিজের ও অপরের আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগকল্পে। যে অধিকার শুধুমাত্র সরকারি কর্মচারী হিসেবে নয়, যেকোনো সাধারণ নাগরিকও নিজের এবং অপরের আত্মরক্ষায় পরিস্থিতি-পরিবেশ বিবেচনায় এ অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। এমনকি তা বেআইনিভাবে কার্য সম্পাদনকারী সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধেও।
দ্বিতীয়ত: বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার জন্য। সেই বেআইনি সমাবেশে অংশগ্রহণকারীরা যদি এতটাই মারণাস্ত্র দ্বারা সুসজ্জিত থাকে যে, তাদেরকে হত্যা করা ছাড়া কোনোভাবেই নিজের এবং অপরের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে।
তৃতীয়ত: মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডপ্রাপ্ত কোনো পলাতক আসামিকে গ্রেপ্তারকালে সেই গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য ওই আসামি যদি এতটাই বল প্রয়োগ করে যে, গুলিবর্ষণ ব্যতিরেকে তাকে নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছেই না। সেই ক্ষেত্রে।
[সূত্র: পিআরবি-১৫৩; ডিএমপি রুলস-৯; দণ্ডবিধি: ৯৬-১০৬ এবং ফৌ: কা: ৪৩৩ ১২৭ ও ১২৮ ধারা]
আইন প্রয়োগকারী সদস্যদের আইন প্রয়োগের বিচার-বিবেচনা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হলে তার ব্যাখ্যা দিয়ে আদেশ জারি করে থাকে হাইকোর্ট ও সুপ্রীম কোর্ট। যা-ই “ডিএলআর” নামে পরিচিত। আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন সময় যে ডিএলআরগুলো ইস্যু হয়েছে এখন তা ভুক্তভোগী পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু উল্লেখ করছি– কোটা আন্দোলনে ঘটে যাওয়া ঘটনা পঞ্জির সাথে মিলিয়ে সেই মতে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণের জন্যই।
(১) আক্রমণকারী যখন পরাজিত, ভূপাতিত এবং অস্ত্রচ্যুত, তখন তাকে খুন করা ব্যক্তিগত আত্মরক্ষার মধ্যে পড়ে না। আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগ করে কোন ব্যক্তি অন্যের প্রাণ তখনই আইনগতভাবে হরণ করতে পারে যখন তার নিজের জীবনহানি বা গুরুতর জখম অত্যাসন্ন হয়। [88 DLR 444 SC].
(২) পুলিশ তার উপর মারণাস্ত্র সজ্জিত আক্রমণকারীকে একটি গুলি করায় আক্রমণকারী তার আক্রমণ ক্ষমতা হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। কিন্তু এরপরও পুলিশ ক্ষান্ত না হয়ে দ্বিতীয় গুলি করল। প্রথম গুলিটি পুলিশের আত্মরক্ষার অধিকার হিসেবে বিবেচিত হলেও দ্বিতীয় গুলি নিক্ষেপ তার আত্মরক্ষার অধিকার হিসেবে বিবেচিত হবে না। বরং তার বিরুদ্ধে দন্ডবিধি-৩০৪ (নরহত্যা) ধারার অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। [23 DLR 13 Pesh; 18 DLR 34 (WP)]।
(৩) আক্রমণকারীরা যখন পালাতে আরম্ভ করেছে, তখন তাদের পিছু ধাওয়া করে হত্যা করা বৈধ নয়; সেটি নরহত্যা। [AIR 1963 SB (621) 158)।
(৪) আশ্রয় গ্রহণ করেছে এমন ব্যক্তিকে ঘিরে ফেলে আক্রমণ করা হলে তা ব্যক্তিগত আত্মরক্ষামূলক কর্মের মধ্যে পড়ে না। [1976 DLR 341 (DB)].
(৫) আঘাত করে আক্রমণকারীকে সংজ্ঞাহীন করে ফেলার পর পুনরায় তাকে আঘাত করা বৈধ নয়। কারণ তখন আর আক্রমণকারীর আক্রমণ করার ক্ষমতা থাকে না। [AIR 1944 Lahore 748]।
(৬) সরকারি কর্মচারী যদি সীমা অতিক্রম করে তাহলে তার কাজকে সাধারণভাবে সদ্বিশ্বাস প্রণোদিত বলা যায় না। এমতাবস্থায়, সরকারি কর্মচারীর কাজের বিরুদ্ধেও আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার পাওয়া যায়। [AIR 1969 Rajshatan 121].
এসকল আইন ও বিধির আলোকে এটি স্পষ্ট যে, আইন এবং রাষ্ট্র আইন রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দিয়ে সুনির্দিষ্ট করে বলে দিয়েছে যে, তা কখন কি পরিস্থিতিতে কোথায় কতটা ব্যবহার করা যাবে। তার ব্যত্যয় করে যখনই কেউ তা ব্যবহার করবে তা আইনের দৃষ্টিতে পরিগণিত হবে অবৈধ বা অন্যায় ব্যবহার হিসাবে। আগ্নেয়াস্ত্রের অবৈধ বা অযৌক্তিক ব্যবহারের ক্ষতির পরিণতি কত ভয়াবহ সহজেই অনুমেয়। সেই ক্ষতির উপর নির্ভর করেই নিরূপিত হয় শাস্তি– মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নাকি অন্য কোনো কিছু।
উপরন্তু আইন রক্ষাকারী বাহিনীর কারণে-অকারণে গুলি ছোড়া এবং সেই গুলিতে সরাসরি কেউ আঘাতপ্রাপ্ত না হলেও দণ্ডবিধি ৩০৭ বা ৩০৮ ধারার আলোকে হত্যা প্রচেষ্টার অভিযোগ ভুক্তভোগীরা আনয়ন করতে পারেন। যার শাস্তি ১০ বছরের কারাদণ্ড। কেননা আইনের ব্যাখ্যা হলো– কোন অপরাধের প্রচেষ্টার জন্য মূল অপরাধটি সংঘটিত হওয়ার প্রয়োজন হয় না। শুধু প্রস্তুতি আর তা করার উদ্যোগ গ্রহণ করলেই ‘প্রচেষ্টার-অপরাধ’ হয়ে যায়।
তিন
এদেশের নিরীহ ও সরলপ্রাণ নাগরিকদের ধোঁকা দেওয়ার জন্য এই সকল হত্যাকারী সরকারি বাহিনী তথাকথিত শটগানকে প্রাণনাশক (Lethal/ Deadly) অস্ত্র হিসেবে বিবেচনা না করে টিয়ার গ্যাস-গানের সমতুল্য উল্লেখ করে থাকে। এর কারণ হলো পুলিশ কর্তৃক প্রাণনাশক অস্ত্র দ্বারা গুলিবর্ষণ করা হলে তাতে কেউ হতাহত হোক বা না হোক আইনানুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেরিয়াল বা জুডিশিয়াল ইনকয়ারির মাধ্যমে তার যথার্থতা নিরূপণ করতে হয়। সেই বিধানকে পাশ কাটানোর লক্ষ্যেই এই শটগানকে প্রাণনাশক অস্ত্র বলে স্বীকার করতে চায় না স্বৈরাচারী সরকারের এই খুনি বাহিনীগুলো। বর্ণিত এই অস্বীকার সম্পূর্ণ মিথ্যা, প্রতারণা তথা হত্যাকাণ্ডে সহায়তা দেবার শামিল। কেননা যে বন্দুকের গুলি বা কার্তুজের আঘাতে মানুষ মৃত্যুবরণ করে বা গুরুতর আহত হয়, সেটাই সংজ্ঞা অনুযায়ী প্রাণনাশক অস্ত্র বলে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত।
২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে এতিম-মাদ্রাসা ছাত্রদের উপর ভয়াবহ গণহত্যা চালানোর পর থেকেই চলে আসা এই শটগানের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হলেও সেই গানের কার্তুজের আঘাতে এবারের কোটা আন্দোলনে আবু সাঈদসহ শত শত শিশু-নারী-যুবক নিহত ও চক্ষু হারানোর মতো গুরুতর আহত হওয়াই প্রমাণ করেছে যে, এটি একটি ভয়ংকর প্রাণনাশক অস্ত্র!
যাহোক এ পর্যন্ত অতি সংক্ষিপ্ত এই আইনি আলোচনার প্রেক্ষিতে আপনারাই বলুন, এই কোটা আন্দোলনকারীরা তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে রাজপথে যে আচরণ করেছে, তাতে কি মিনিমাম একটি গুলি করার মতো কোনো ঘটনা তারা ঘটিয়েছিল?
সুতরাং শুধু এই শটগানই নয়, স্থল এবং আকাশ হতে যে সকল অস্ত্র দিয়ে যত গুলি করা হয়েছে, প্রত্যেকটি গুলিবর্ষণয়ের ঘটনার যৌক্তিকতা ও যথার্থতা আইন বর্ণিত ইনকোয়ারির মাধ্যমে নিরূপণ করে যার যা উপযুক্ত শাস্তি তা পেতেই হবে। আজ না হয় আগামীকাল! যে শাস্তি একমাত্র অস্ত্র ব্যবহারকারীর মৃত্যু ব্যতীত কখনোই তামাদি হবে না।
ব্যারিস্টার জিল্লুর রহমান; প্রাক্তন পুলিশ কর্মকর্তা।