কোটা সংস্কার আন্দোলন আক্ষরিক অর্থে বিস্ফোরিত হবার পর একজন লেখক ও গণমাধ্যমের মানুষ হিসেবেও যাকে চেনেন অনেকে, সামাজিক মাধ্যমে এমনিতেই ‘সব গেল’ বলে আর্তনাদ করেননি। তিনি বুঝেই আর্তনাদ করেছেন। বিষয়টি খোলাসা করার আগে রাজনীতি এবং ক্ষমতা এ দুটো বিষয়কে বোঝাটা জরুরি। আমাদের সাধারণের ধারণা ক্ষমতা আর রাজনীতি বোধহয় একই বিষয়। না, একদম না। যদি তাই হতো তাহলে মঈন ইউ আহমেদ আর ফখরুদ্দিনদের ক্ষমতা টিকে যেত। ক্ষমতায় না হলেও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে টিকে যেত কিংবা প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকতো। তাদের কোনো রাজনীতি ছিল না বলেই তাদের ক্ষমতা টিকেনি বা দীর্ঘায়িত করা সম্ভব হয়নি এমনকি প্রাসঙ্গিকতাও তাদের নেই।
জেনারেল এরশাদের কথা বলতে গেলে তার রাজনীতি নেই বলে তার দল ক্ষমতায় নেই। রাজনীতি না থাকার কারণে ক্রমেই প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে তার অবর্তমানে তার দল। মূলত জাতীয় পার্টির ১৮ দফা, অনেকটাই কপি-পেস্ট। যাতে নতুন বা বিশেষ কিছু নেই, যা অন্যদের রয়েছে। যার ফলেই আজ জাতীয় পার্টি গৃহপালিত বিরোধী দলের ভূমিকায়। একথা আমার নয়, খোদ জাতীয় পার্টির নেতাদেরই। সুতরাং ক্ষমতা আর রাজনীতি এক বিষয় নয়। রাজনীতি হলো হারানো ক্ষমতা ফিরে পাবার পথ। রাজনীতি না থাকলে ক্ষমতায় ফেরা সম্ভব হয় না কিংবা রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকা যায় না।
সিপিবির সমর্থক এবং কর্মী সংখ্যা কম, কিন্তু তাদের সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি আছে বলেই তাদের একটা অবস্থান রয়েছে। তারা রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক। অন্যান্য বামদলগুলোও তাই। বিপরীতে জামায়াত বা অন্য ইসলামী দলগুলোর রাজনীতি হলো রাজনৈতিক ইসলাম, তারাও টিকে আছে। বিএনপির কথা যদি বলি, তাদের এক বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ দিয়েই তারা দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারবে। মূলত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের রাষ্ট্রগত কোনো বিকল্প নেই। সম্প্রদায়, গোষ্ঠী কিংবা ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তা বা জাতীয়তাবাদ যাই বলি না কেন থাকলেও রাষ্ট্রীয় ভাবে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কোনো রিপ্লেসমেন্ট নেই। এখানেই বিএনপির রাজনীতির ভিত্তি।
এখন বলবেন, তাহলে শাসকদলের রাজনীতিটা কী? সেই রাজনীতির জন্যই ‘সব গেল’ আর্তনাদটা ছিল। শাসকদলের রাজনীতি টিকে ছিল বা এখনো আছে মূলত একটি ট্যাবুর ওপর। ট্যাবু বিষয়টা হলো, মানুষের কাছে পবিত্র বা অপবিত্র একটি বিবেচনা বোধ। যা মূলত বিপজ্জনক। সেই ট্যাবুটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। যা দেশের মূল অংশের মানুষের কাছে অত্যন্ত পবিত্র, অনেকটা ধর্মের কাছাকাছি।
সংখ্যায় অতি নগণ্য কিছু মানুষের কাছে অপবিত্র এবং এই অংশটাকেই বলা হয় প্রতীকী অর্থে ‘রাজাকার’। রাজনীতিতে এই ট্যাবুটা ব্যবহার হয়ে আসছিল দীর্ঘদিন ধরেই এবং তা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে এবং এটাই বিপজ্জনক। বিরোধিতা মানেই রাজাকার। এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধেও শাসন-শোষণের বিরোধিতা করায় সেই ট্যাবু ব্যবহার করা হয়েছে। এই ট্যাবু অর্থাৎ রাজাকার বলে মানুষকে দাবিয়ে রাখাই ছিল তার মূলে। কারণ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ এখন আর খুব বেশি সমসাময়িক নয়।
এখনকার জেনারেশন জেড এর তরুণরা রাষ্ট্র বোঝে, তাদের ভাষা-গোষ্ঠীভিত্তিক জাতীয়তায় আটকে রাখা বাস্তবিক ভাবেই সম্ভব নয়। সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের মিশেলে জগাখিচুড়ি চিন্তাতেও বর্তমান প্রজন্ম বিশ্বাস করে না। বিপরীতে শাসকদলের হাতে আর কোনো সমসাময়িক রাজনৈতিক চিন্তা নেই। তারা মূলত ভর করেছিল ট্যাবুর ওপর। তাদের থিঙ্কট্যাঙ্ক এই চিন্তা থেকে তাদের বের হতে দেয়নি, নতুন কোনো চিন্তাও দেয়নি। এই ট্যাবুকেই তারা নিরাপদ ভেবেছিল। অথচ রাজনৈতিক দলগুলোকে সময়ের সাথে আপডেট হতে হয়, নতুন চিন্তার খোঁজ করতে হয়।
কোটা আন্দোলন সেই ট্যাবুটাকে গুড়িয়ে দিয়েছে। মানুষকে রাজাকার বলে দাবিয়ে রাখার মেশিনটাকে অকার্যকর করে দিয়েছে এসময়ের মেধাবী তরুণরা। তারা বুঝেছে তৃতীয় প্রজন্মে এসে রাষ্ট্রকে বিভক্ত রেখে উন্নয়ন শুধু মুখের কথা, কাজের কথা নয়। কল্যাণ রাষ্ট্র বলতে যা বোঝায় তাতে সবারই সমান অধিকার নিশ্চিত করাতেই রাষ্ট্রের উন্নতি। উন্নয়ন মানে কিছু কংক্রিটের স্থাপনা নয়। উন্নয়ন মানে মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-স্বাস্থ্য-শিক্ষা অন্তত এই পাঁচটি অধিকার নিশ্চিত করাই হলো কল্যাণ রাষ্ট্রের কাজ। আর রাষ্ট্রের নাগরিকদের বিভক্ত করে এই অধিকার নিশ্চিত করা অসম্ভব। তরুণরা মেধাবী বলেই এই বিষয়গুলো বুঝতে পেরেছে এবং তাই কোটার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছে ‘কোটা না মেধা’ এই প্রশ্ন সামনে রেখে।
এখন ‘সব গেল’ বিষয়ক আর্তনাদের কথায় আসি। অন্যকে রাজাকার আখ্যা দিয়ে নিজের আখের গুছিয়ে নেওয়ার একটি সফল মহল তৈরি হয়েছিল। যাতে করে অনেকে তাদের আখের গুছিয়ে নিয়েছে। সেকেন্ড হোম কিংবা বিদেশি ব্যাংকে হাজার কোটি টাকা এই সফলতার উদাহরণ। কিন্তু তরুণরা তথা মেধাবীরা তাদের সেই পবিত্রজ্ঞানে তৈরি করা ইউটোপিয়ান ট্যাবু ভেঙে দিয়ে তাদের আখের গোছানোর রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। যার ফলেই তৈরি হয়েছে ‘সব গেল’ আর্তনাদ।
প্রথম আলোতেই প্রকাশিত হয়েছে পঞ্চাশ হাজারেরও অধিক মুক্তিযোদ্ধার বয়স পঞ্চাশের কোটায়- এমন খবর। অর্থাৎ তাদের জন্ম স্বাধীনতার পরে। আর তারা মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে এই ট্যাবুর পবিত্র জ্ঞানে। সুতরাং এই ট্যাবু ভেঙে গেলে দলের মতন তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ এই ট্যাবুর কারণে তারা রাজনীতির ওপর ভর করে তাদের আখের গুছিয়েছে। ট্যাবুর অতিরিক্ত ব্যবহার এবং ট্যাবুর ওপর ভর করাদের কারণেই শাসকদলের রাজনীতি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ট্যাবু প্রসঙ্গে ভূতের রাজার বরের কথা এসে যায়। দুজনের একজন নিলো জাদুর দণ্ড যা ব্যবহারে ক্ষয় হয়। ট্যাবু হলো সেই জাদুর দণ্ড যাকে ক্ষমতার উৎস ভেবে ব্যবহার করা হয় এবং যা ব্যবহারে ক্ষয় হয়। আর ট্যাবুর সেই ব্যবহার হয়েছে মাত্রাতিরিক্ত। যাকে ইচ্ছে, যখন তখন ‘রাজাকার’ উপাধি দেয়া হয়েছে। যেহেতু এদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের আবেগকে পবিত্র মনে করে, তাই তারা ভয়েই সেই ট্যাবুর অতিরিক্ত ব্যবহারের বিরুদ্ধতা করার সাহস পায়নি। রাজনৈতিক দলগুলোতো রীতিমতো কোণঠাসা ছিল এই ট্যাবুর অপপ্রয়োগে। কিন্তু তরুণদের কথা আলাদা। তাদের ধারালো মগজ, তাদের অগ্রসর চিন্তা সেই ট্যাবুর অপপ্রয়োগকে মানবে কেন। যখন তারা দেখেছে এর ব্যবহার হচ্ছে শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বার্থে, রাষ্ট্রের স্বার্থে নয়। অযোগ্যরা যোগ্যকে টপকে জায়গা করে নিচ্ছে, যার ফলে রাষ্ট্রব্যবস্থা ক্রমেই ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। ব্যাংকগুলো খালি, টাকা নিয়ে গেছে সেই ট্যাবুর অপব্যবহাকারীরা। রিজার্ভ কমছে। ক্রমেই ডিজাস্টার মোকাবেলার ক্ষমতা হারাচ্ছে রাষ্ট্র।
চারিদিকে দুর্নীতি আর লুটপাটের মহামারি, এসবই বা তরুণরা মানবে কেন! যার ফলেই তারা সেই ট্যাবুকে ভেঙে দিয়েছে। যে চেতনা স্রেফ স্বার্থসিদ্ধির ট্যাবু হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তাকে আবার পবিত্র চেতনার জায়গায় নিয়ে যেতে তরুণরা রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলেছে। রাস্তায় টানিয়ে দিয়েছে ‘রাষ্ট্র সংস্কার হচ্ছে, সাময়িক অসুবিধার জন্য আমরা দুঃখিত’। তরুণদের কথা উপেক্ষা করতে পারেনি আদালতও। তরুণদের কথা আর যুক্তিই উঠে এসেছে আদালতের রায়ে। যার ফলেই ট্যাবু ভেঙে ৯৩ শতাংশ কোটা এসেছে মেধার পক্ষে। একটি কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ার পক্ষে। যে রাষ্ট্রে নাগরিক তথা মানুষের প্রথম পাঁচটি মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হবে। কেউ না খেয়ে থাকবে না। কেউ গৃহহীন-বস্ত্রহীন হবে না। চিকিৎসা নিশ্চিত হবে।
অসুস্থ একজন মানুষকে অসুস্থ হিসেবেই গণ্য করা হবে। তার কোনো ভিআইপি আইডেন্টিটি থাকবে না। একটি নম্বরে ফোন করতেই দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবে অ্যাম্বুলেন্স। একজন পিতাকে তার সন্তানের শিক্ষার জন্য ভাবতে হবে না। রাষ্ট্র সেই শিক্ষার ব্যবস্থা করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকবে না কোনো গণরুম, রাজনৈতিক টর্চার সেল। শিক্ষা শেষে থাকবে চাকরির নিশ্চয়তা এবং তা নিশ্চিত হবে মেধা আর যোগ্যতার ভিত্তিতে।
মেধার প্রশ্নেই তাই ট্যাবু নির্ভরদের অসংগত আর্তনাদ। এই আর্তনাদ স্বাভাবিক। এই আর্তনাদ যোগ্যতাহীনদের ট্যাবু নির্ভরতার। মেধা ও যোগ্যতার বিকল্পে ‘বাইপাস’ রাস্তায় গন্তব্যে না পৌঁছানোর সম্ভাব্য বেদনার। রাজনীতিকে ট্যাবু নির্ভরতার ইউটোপিয়া থেকে রিয়েলিটিতে প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে এই আর্তনাদ। এই আর্তনাদকে আপনারা ট্যাবু নির্ভর সুবিধাভোগীদের সম্মিলিত আর্তচিৎকারও বলতে পারেন।