আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগ
ব্যারিস্টার জিল্লুর রহমান
প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২৪, ১১:২১ পিএম
এক,
বাংলাদেশের আইন বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রতিটি নাগরিকের জীবন ও সম্পদ রক্ষাকল্পে তার নিজের এবং তাঁর প্রতি সহমর্মী অন্য যেকোনো নাগরিককে ক্ষমতা প্রদান করেছে। কিন্তু সার্বজনীন এই বিষয়টি আমাদের সাধারণ শিক্ষা কারিকুলামের অন্তর্ভুক্ত না থাকায় সাধারণ জনসাধারণের কেউই তা জানেন না।
কোনো সরকারি কর্মচারী হোক সে পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট, সেনাসদস্য, বিচারক এমনকি এমপি-মন্ত্রী; অসৎ উদ্দেশ্যে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো কাজ যখন সে করে করে, তখন তা আর সরকারি দায়িত্ব পালন বলে পরিগণিত না হয়ে সেই কর্মচারীর “ব্যক্তিগত দায়” হিসেবে “ফৌজদারি অপরাধ-কর্ম” বলে বিবেচিত হয়।
ফৌজদারি দণ্ডযোগ্য অপরাধ, তা যে-ই করুক না কেন তাকে আইনের আওতায় এনে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের পক্ষে সরকারের। আর সরকারের পক্ষে এই দায়িত্ব পালন করার কথা পুলিশ এবং আদালতের। কিন্তু সেই পুলিশ এবং আদালত যখন অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে নিজেরাই ব্যক্তিস্বার্থে সেই ফৌজদারি দণ্ডযোগ্য অপরাধে লিপ্ত হয়ে পড়ে, যেমনটি এখন হচ্ছে, তখনই প্রতিটি নাগরিকের নিজের এবং অপরের জান-মাল ও সম্ভ্রম রক্ষার দায়িত্ব আইন তার নাগরিকদের দেয়। যা-ই “আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার” বলে আইনে বর্ণিত।
পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট ও আদালত কর্তৃক এমন অপরাধ কার্যক্রম মূলত: ২০১৩ সাল থেকে শুরু হলেও তা আরো ভয়ঙ্কররূপে তারা শুরু করেছে সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষিতে। ইতোমধ্যেই কয়েকশ' নিরীহ-নিরাপরাধ নারী-শিশু-ছাত্র-নাগরিক হত্যা ও হাজার নাগরিকদের আহত করেছে। এরপর এখন পুলিশ নিজেরাই মামলা দিয়ে হাজার-হাজার নিরপরাধ নাগরিকদের আটক ও রিমান্ডের মাধ্যমে শারীরিক, মানসিক ও আর্থিকভাবে নির্যাতন করে তাদের বিকলাঙ্গ করে দিচ্ছে।
এখন এ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিকদের মুক্তিকল্পে ফৌজদারি অপরাধে জড়িত কথিত পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট ও আদালত পরিচালকদের বিরুদ্ধে “আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার” প্রয়োগের আর কোনো বিকল্প অবশিষ্ট নেই। কোনো ক্ষেত্রে এই অধিকার কীভাবে প্রয়োগ করতে হবে এখন থেকে সেই বিষয়ে আমরা ধারাবাহিকভাবে নাগরিকদের সচেতন করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
দুই,
দণ্ডবিধি ১০০ ধারায় বলা হয়েছে যে, কোনো নাগরিক তার নিজের এবং অপর নাগরিকের আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করতে যেয়ে আক্রমণকারী, সে যেই হোক, তার মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারেন যদি–
ক) সেই আক্রমণ এমন হয় যে, তার ফলে আক্রান্ত নাগরিকের মৃত্যু অথবা গুরুতর আহত হতে পারেন মর্মে যুক্তিসঙ্গত আতঙ্ক সৃষ্টি হয়।
খ) কোনো নাগরিককে অবৈধভাবে আটক করার ইচ্ছা নিয়ে যদি কেউ বলপ্রয়োগ করে যাতে আক্রান্ত নাগরিকের মনে এরকম আতঙ্কের সৃষ্টি হয় যে, তিনি সেই আটকাবস্থা থেকে মুক্তির জন্য বৈধ কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষের সাহায্য পাবেন না।
যেকোনো কিছুতেই ফ্যাসিস্ট সরকার যে হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টের দোহাই দিয়ে পার পেয়ে যেতে চায়। ২০১৬ সালে প্রদত্ত সেই সুপ্রিম কোর্টের একটি আদেশ যা ৫৫ ডিএলআর নামে পরিচিত। সেই আদেশে বলা হয়েছে–
১) গ্রেপ্তারকারী পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করার সময় তার নিজের পরিচয়পত্র প্রদর্শন করতে বাধ্য থাকবে।
২) গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি যদি গ্রেপ্তারকালীন সময়ে অসুস্থ থাকেন বা আহত হন, তবে তা হওয়ার কারণ উল্লেখপূর্বক গ্রেপ্তারকারী পুলিশ কর্মকর্তা তাঁকে নিকটস্থ হাসপাতালে হাজির করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও ডাক্তারি সনদ গ্রহণ করবেন।
৩) গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে যদি তাঁর নিজ আবাসস্থল বা কর্মস্থল থেকে গ্রেপ্তার না করে অন্য যেকোনো স্থান থেকে গ্রেপ্তার করা হয়, তাহলে গ্রেপ্তারকারী পুলিশ এক ঘণ্টার মধ্যে তা গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির নিকটাত্মীয়-স্বজনকে অবহিত করবেন।
৪) গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে তাঁর পছন্দমতো আইনজীবীর সাথে পরামর্শ এবং তাঁর নিকটাত্মীয়দের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ দিতে হবে।
৫) গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে অবশ্যই আটকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে প্রেরণ করতে হবে।
উল্লেখ্য যে, যখনই কোন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারকারী পুলিশ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ফেলায় সে তাঁর স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন, সেই সময় থেকেই তিনি গ্রেপ্তার বা পুলিশে আটক বলে বিবেচিত হন।
এরপরও পুলিশ যদি রিমান্ডের আবেদন করে, তাহলে সেই আবেদনের সাথে সংযুক্ত কেস ডায়েরিতে অবশ্যই সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিয়ে বলবে যে, কেন গত ২৪ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পরও গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে আরও সময়ের প্রয়োজন।
অতঃপর পুলিশি ব্যাখ্যার যথার্থতা ও যৌক্তিকতা বিবেচনায় ম্যাজিস্ট্রেট হয় গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে মুক্তি দিয়ে দিবেন, নতুবা জেল হাজতে প্রেরণ করবেন অথবা রিমান্ড দিবেন। [দ্রষ্টব্য: ফৌ:কা: ধারা-৬১, ১৬৭ এবং বিপি ফরম নং-৩৮]।
৬) উভয় পক্ষের শুনানি শেষে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট যদি প্রতীয়মান হয় যে, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার মত যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ কিংবা যথার্থ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় নাই, তাহলে গ্রেফতারকারী পুলিশের বিরুদ্ধে তিনি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। [দ্রষ্টব্য: ফৌ:কা: ধারা-১০৯(১); দণ্ডবিধি ধারা-২২০]।
৭) রিমান্ডে থাকাকালীন সময়ে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় এমন একটি কক্ষে/স্থানে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে, যেখানকার কথাবার্তা বাইরে থেকে শোনা না গেলেও দূর থেকে তাঁদেরকে দেখা যায়।
৮) পুলিশ আবেদন সন্তোষজনক বিবেচিত হওয়ায় ম্যাজিস্ট্রেট যদি রিমান্ড প্রদান করেনও, তাহলেও তার মেয়াদ কোনোক্রমেই তিন দিনের বেশী হবে না।
৯) রিমান্ড আদেশ প্রদানের পূর্বে ম্যাজিস্ট্রেট গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি এবং তার আইনজীবীর বক্তব্য গুরুত্ব সহকারে শুনে তা বিবেচনায় নিবেন। তারপরও যদি তিনি রিমান্ড প্রদানের আদেশ দেনও তবে পুলিশ হেফাজতে পুনরায় দেয়ার পূর্বে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির মেডিকেল চেকআপ করিয়ে নেবার আদেশ দিবেন। অত:পর সেই মেডিকেল চেকআপ রিপোর্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দাখিল করে পুলিশ সেই ব্যক্তিকে রিমান্ডে নিবে।
রিমান্ডে নেওয়ার পর শুধুমাত্র মামলার তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তাই তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে, অন্য কেউ নয়।
রিমান্ড শেষে আদালতে উপস্থাপনের পর যদি গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি রিমান্ডকালীন তাঁর ওপর কোনো শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ করেন, তবে ম্যাজিস্ট্রেট উক্ত ব্যক্তিকে সেই ডাক্তারের নিকট পরীক্ষার জন্যে প্রেরণ করবেন যিনি রিমান্ড প্রদানের পূর্বে তাঁকে পরীক্ষা করেছিলেন। এরপর সেই ডাক্তারি রিপোর্টে যদি রিমান্ডকালীন নির্যাতনের কোনো প্রমাণ বা চিহেৃর বিবরণ পাওয়া যায়, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট বিলম্ব না করে গ্রেপ্তারকারী পুলিশের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ৩৩০ ধারা অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
সুপ্রিম কোর্টের যেকোনো আদেশ একটি আইন-তুল্য পালনীয় বিষয়। সুতরাং এর বরখেলাপকারী পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট বা অন্য যেকোনো সরকারি কর্মচারীর কার্য সম্পূর্ণভাবেই বেআইনি বা অপরাধ কর্ম হিসেবে গণ্য হবে।
আর আইনের বিধান মতে যেকোনো বেআইনি বা অপরাধ কর্মের বিরুদ্ধে মানুষের আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগ কোনো অপরাধ নয়, বরং প্রতিটি নাগরিকের তা অবশ্য করণীয় কর্তব্য।
তিন,
অনেকে বলতে পারেন, বলে থাকেনও– আরে ভাই! এসব আইন কানুনের কথা বলে কি লাভ? কে শুনে এসব! কথা সত্য। কিন্তু তার জবাব হলো– আমরা হর-হামেশা মুখে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা বললেও ‘আইন না মানার বেআইনি কার্যক্রম’ বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেওয়ার যে সংস্কৃতি গত ১৬ বছরে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলা হয়েছে, তারই ফল আজ দল-মত, ধর্ম-বর্ণ, শিশু-কিশোর-নারী নির্বিশেষে সকলে ভোগ করছি। এই অনাচার থেকে মুক্তি শুধু আর্তনাদ করে মিলবে না! যে কোন মূল্যে আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতেই হবে। না হলে স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
আবারও বলছি– এই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব যে রাষ্ট্রের, সেই রাষ্ট্র পরিচালনাকারীরাই যেহেতু অপরাধ কর্মে জড়িত হয়ে পড়েছে, তাই নাগরিকদেরকেই নিজ জান-মাল, সম্ভ্রম ও অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতেই হবে। তাই আসুন উল্লেখিত আইনি বর্ণনা-ব্যাখ্যা মনোযোগ সহকারে পাঠ করে আমাদের ওপর অন্যায়-অবিচারকারীদেরকে চিহ্নিত করত: তার ওপর আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগকল্পে সকলে মিলে আজ থেকেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করি।
চলবে. . .
ব্যারিস্টার জিল্লুর রহমান, প্রাক্তন পুলিশ কর্মকর্তা।