ছাত্র আন্দোলন নিয়ে সরকারের বয়ান কি কেউ বিশ্বাস করছে?
আবু জাকির
প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২৪, ০৯:৪৬ পিএম
সম্প্রতি বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়া আন্দোলন শুধুমাত্র সরকারি চাকরিতে এবং ভিন্নমত সহ্য না করা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ক্ষোভের প্রতিফলন। আর এই আন্দোলন হাসিনা সরকারের সহিংস দমনের ফলে অন্তত ২০০ মানুষ নিহত হয়েছেন। এর অধিকাংশই ছাত্র এবং সাধারণ মানুষ—যা এখন পর্যন্ত ক্ষমতায় থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। কারণ তিনি কিছুদিন আগেই কেবল ত্রুটিপূর্ণ এক নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়ের মাধ্যমে টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।
২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন হাসিনাকে কোটা ব্যবস্থা বাতিলে চাপ তৈরি করে। পরে কোটার জায়গায় সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ পদ্ধতি জায়গা পায়। কিন্তু চলতি বছরের জুনে শেখ হাসিনার ‘আজ্ঞাবহ’ আদালত পুরোনো কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল করে।
আদালতের এই রায়কে হাসিনার রাজনৈতিক ভিত্তিকে খুশি করার প্রচেষ্টা হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। বিশেষ করে অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার আলোকে সহায়তার অন্যান্য উপায় সীমিত থাকায়। দৃশ্যত এই অবিচারের প্রতিক্রিয়ায় জুলাইয়ের শুরুর দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এবং সদ্য পড়াশোনা শেষ করা শিক্ষার্থীরা হাইকোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের ভিন্ন মত জানাতে রাস্তায় নামেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রথম দিকে এই আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলপূর্বক হ্যান্ডলিংয়ে কারণে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি বাহিনী এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা মিলে কঠোরভাবে কোটা আন্দোলনকারীদের দমন করেন। যার ফলে ব্যাপক মাত্রায় সহিংসতা সৃষ্টি হয়। সামরিক কারফিউ জারি করা, যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া এবং গণগ্রেপ্তার সংকটকে আরও তীব্র করে আশঙ্কাজনক অবস্থায় নিয়ে যায়।
এই দমন-পীড়ন সাম্প্রতিক দশকগুলোতে দেখা যায়নি। যা বাংলাদেশিদের মধ্যে ক্ষোভ ও আতঙ্ক তৈরি করেছে। নিহতের সংখ্যা ইতোমধ্যে দুইশোর কাছাকাছি পৌঁছেছে, যদিও আন্দোলনের নেতারা নিহতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলে শঙ্কা করছেন। তবে সরকারি হিসাবে নিহতের সংখ্যা কম দেখানো হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এত বেশি নিহত অনেকে মানতে পারেননি যা চলমান ক্ষোভ ও অসন্তোষকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
আন্দোলন দমাতে হাসিনা তার কাছে থাকা সব শক্তি মাছে নামিয়েছেন। এর মধ্যে একটি ভয়ঙ্কর আধা সামরিক ইউনিটও রয়েছে যার শীর্ষ কর্তারা পূর্বে নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের অভিযোগে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় পড়েছিলেন। এছাড়া, এখন হাসিনার নিয়ন্ত্রণে থাকা এককালের অভ্যুত্থানপ্রবণ সেনাবাহিনীও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি মোতায়েন করা হয়। তার সমালোচকরা বলছেন, নিজের কর্তৃত্বকে আরও শক্তিশালী করতে এসব পদক্ষেপ।
আন্দোলন সহিংস দমনের প্রতিক্রিয়ায় বিদেশি একদল রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে রাষ্ট্রদূতদের ওই আলোচনায় ছিলেন এমন একজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক জানিয়েছেন, ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে চালানো অভিযানে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের সাঁজোয়া যান এবং হেলিকপ্টার ব্যবহারের বিষয়গুলো বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা সামনে এনেছেন।
বৃহস্পতিবারও কারফিউয়ের কারণে পরিবহন বিঘ্ন হওয়ায় রাজধানী ঢাকায় প্রয়োজনীয় সরবরাহের ঘাটতি অব্যাহত রয়েছে।নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, বিমেষ করে শাক-সবজির মূল্য প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় মানুষজন তাদের প্রিপেইড মিটার রিচার্জ করতে পারেনি এবং ফলে বিদ্যুৎ ও গ্যাস অফিসে মানুষের দীর্ঘ সারি দেখা যায়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার এই ঘটনার বয়ান ‘নিহতের সংখ্যা’ থেকে অর্থনৈতিক ক্ষতির দিকে নেওয়ার চেষ্টা করছে। আর এই অর্থনৈতিক ক্ষতির জন্য সরকার প্রধান বিরোধী রাজনৈতিকদল বিএনপি ও জামায়াত ইসলামকে দায়ী করছে। সরকারের দাবি, ছাত্রদের আন্দোলন বিরোধীদের মাধ্যমে ‘ছিনতাই’ হয়েছে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিজেদের স্বার্থে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে দেশের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের বিষয়টি স্বীকার করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেছেন, হ্যাঁ, ছাত্র আন্দোলন বলপ্রয়োগ করে দমনের কারণে বিশ্বের কাছে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। কিন্তু দেশের ধ্বংস সাধন এবং নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা লক্ষ্যে সমস্যা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
সহিংসতায় নিহতরা ছাত্র—এই দাবি দ্য ডিপ্লোম্যাটকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রত্যাখ্যান করেছেন হানিফ। বরং তারা বিএনপি-জামায়াতের সশস্ত্র সদস্য বলে দাবি করেন এবং তারা সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর করছিল বলে জানান। তিনি বলেন, ‘যারা আইন প্রয়োগকারী সদস্যদের টার্গেট করেছে তাদের ছাত্র বলা যায় না; তারা সন্ত্রাসী, পুলিশ সন্ত্রাসীদের লক্ষ্য করেছে, ছাত্রদের নয়।’
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান এই ব্যাপারে ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তার মতে, সব ইস্যুতে বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করার ক্ষমতাসীন দলের কৌশল হয়তো আর কার্যকর হবে না। দ্য ডিপ্লোম্যাটকে তিনি বলেন, তাদের নিজেদের অন্যায়কে রাজনৈতিক বিরোধীদের দায়ী করার অভ্যাস বাঘ ও রাখাল বালকের গল্পের মতো হয়ে গেছে। বাংলাদেশের অল্প কিছু সুবিবেচক মানুষও এখন এটা বিশ্বাস করেন না।
এ ছাড়া, সরকার ভুল তথ্যের বিস্তার ঠেকানোর খাতিরে ইন্টারনেট বন্ধ করছে বলে আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করেছে। কিন্তু এটি সহিংসতার পুরো মাত্রাকে আরও অস্পষ্ট করেছে। মোবাইল ফোনে নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকাণ্ড ধারণ করা ভিডিওতে দেখা যায়, তারা বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালানোর পাশাপাশি রাস্তায় মৃতদেহগুলিকে নির্মমভাবে ফেলে দিচ্ছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)–এর সম্পাদক, বিশিষ্ট নাগরিক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সরকারের অস্বীকার করলেও, যোগাযোগ ব্ল্যাকআউট করে দেওয়াটা তাদের ভুল পদক্ষেপ ছিল।
দ্য ডিপ্লোম্যাটকে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এটি শুধু কেবল রাগ, গুজব এবং ভুল তথ্যই বাড়ায়নি বরং বিশ্ব মঞ্চে সরকারের সুনামও কলুষিত করেছে। ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভ দমনে সরকারের এ কঠোর প্রতিক্রিয়া নজিরবিহীন এবং কোনো ধরনের ব্ল্যাকআউট সেটি খুব বেশি আড়াল করতে পারে না।
বর্তমানে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ। তাদের দাবি মেনে না নিলে পুনরায় সংগঠিত হওয়ার প্রতিজ্ঞা করছেন। আন্দোলনকারীদের কোনো কোনো অংশ বলছেন, আন্দোলন আর কোটার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, আন্দোলনে যাদের হত্যা করা হয়েছে সেই হত্যার বিচারের দাবিতে পৌঁছেছে।
আন্দোলনকারীদের একটি অংশ সরকারকে ৯ দফা দিয়েছে। এই ৯ দফার মধ্যে শেখ হাসিনাকে ক্ষমা চাওয়া এবং তার কয়েকজন প্রধান সহায়কের পদত্যাগ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা চোখ বেঁধে নির্যাতনের অভিযোগ করা আন্দোলনে সমন্বয়কারীদের একজন নাহিদ ইসলাম জোর দিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো থেকে নিরাপত্তারক্ষীদের প্রত্যাহার এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা খুলে দেওয়ার আগপর্যন্ত কোনো আলোচনা নয়।
দ্য ডিপ্লোম্যাটকে নাহিদ বলেন, আমাদের কয়েকজন সহ-আন্দোলনকারীকে সাদা পোশাকের পুলিশ তুলে নিয়েছে। যদি এই ধরনের নির্যাতন এবং ভয়ভীতি চলমান থাকে, তবে আমরা কি করে বিশ্বাস করবো আন্দোলন বন্ধের ঘোষণা আরও দমন-পীড়নের দিকে যাবে না?
আবু জাকির ঢাকা ভিত্তিক সাংবাদিক। তার মূল নিবন্ধটি ইংরেজিতে দ্য ডিপ্লোম্যাটে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা আউটলুক পাঠকদের জন্য তা ভাষান্তর করে দেওয়া হলো।
পাদটীকা : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে ফের গত ২৬ জুলাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থা থেকে সাদা পোশাকে ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়। ধারণা করা হচ্ছে, ডিবি তুলে নেওয়ার আগে তিনি দ্য ডিপ্লোম্যাটের সঙ্গে কথা বলেছিলেন।