Logo
Logo
×

অভিমত

যে কারণে বাংলাদেশের ভারত-চীন ভারসাম্যের নীতি ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে

Icon

সৈয়দ মুনির খসরু

প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৪, ১১:৩৩ পিএম

যে কারণে বাংলাদেশের ভারত-চীন ভারসাম্যের নীতি ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে

শেখ হাসিনা (বামে), শি জিনপিং (ইনসেটে মাঝে) ও নরেন্দ্র মোদি (ডানে)। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে সতর্কতার সঙ্গেই দুই আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারত ও চীনের সঙ্গে ভারসাম্যের সম্পর্ক চর্চার বিষয়টি রাখা হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কৌশলগত স্বার্থ বজায় রেখে সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক সুবিধা নেওয়ার লক্ষ্যে এই নীতি পরীক্ষা করা হয়েছে। তবে চলতি সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের ফলাফলে অবশ্য ইঙ্গিত দেয় যে ভারসাম্যমূলক ওই নীতি হয়তো প্রত্যাশিত ‍সুবিধা নাও দিতে পারে। বিশেষ করে বেইজিংয়ের কাছ থেকে প্রত্যাশা পূরণের ক্ষেত্রে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার এটি পঞ্চম এবং পাঁচ বছরের মধ্যে প্রথম চীন সফর ছিল। 

অর্থনৈতিক বন্ধন

প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক অর্থনৈতিক সহযোগিতা দিয়েই চালিত হয়েছে। টানা ১৩ বছর ধরে চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যা দেশটিকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদেশি বিনিয়োগের উৎসে পরিণত করেছে। অবকাঠামো উন্নয়নে চীনের অবদান উল্লেখযোগ্য। এই তালিকায় রয়েছে সাতটি রেল প্রকল্প, ১২টি মহাসড়ক, ২১টি সেতু এবং ৩১টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এগুলো বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে জোরদার করেছে। যাইহোক, সম্পর্কের বিবর্তন ভারসাম্যপূর্ণ সেই বৈদেশিক নীতির ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে এবং আরও জটিল চিত্রের ইঙ্গিত দেয়। 

সাম্প্রতিক উদ্যোগ

চলতি সপ্তাহের সফরের ফলে তিনটি নবায়নসহ মোট ২১টি সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে  চীনের সঙ্গে থাকা ‘কৌশলগত অংশীদারিত্ব" থেকে "বিস্তৃত কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্ব"র সম্পর্কে উন্নীত হয়েছে। যদিও উপরে উপরে বিষয়টি ইতিবাচক মনে হলেও এই অঞ্চলের আরেক পরাশক্তি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের জন্য এর প্রকৃত প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন উঠে। 

সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং বঙ্গবন্ধু শিল্প পার্কে চীনা বিনিয়োগ বৃদ্ধির আমন্ত্রণ জানান। বিশেষ করে চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য বরাদ্দ করা একটি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে। শেখ হাসিনার এই আমন্ত্রণের পরিপ্রেক্ষিত্রে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রকৃতপক্ষে তা এক বিলিয়ন চীনা ইউয়ান) অর্থনৈতিক সহায়তা ঘোষণা করেন। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি বাণিজ্য ও বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন, যেখানে টেক্সটাইল, বৈদ্যুতিক যান, সৌরবিদ্যুৎ এবং আর্থিক প্রযুক্তির মতো খাতে ১৬টি সমঝোতা স্মারক এবং চারটি চুক্তির ফলে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ পাওয়া যায়।

এ ছাড়া ২০২৬ সালের পরও ৯৮ শতাংশ বাংলাদেশি পণ্যে শূন্য-শুল্ক সুবিধা অব্যাহত রাখতে চীনের প্রতিশ্রুতি, বাংলাদেশের উন্নয়ন উদ্যোগে সমর্থন এবং বিভিন্ন খাতে চীনের উৎসাব্যঞ্জক বিনিয়োগ দেশ দুটির মধ্যে নিবিড় অর্থনৈতিক সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়। রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুতে চীনের মধ্যস্থতাসহ এসব দিক চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্রমবর্ধমান গভীরতা এবং বিস্তৃতি তুলে যা চীন ও ভারতের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক ধরে রাখতে বাংলাদেশের প্রচেষ্টায় সম্ভাব্য জটিলতা সৃষ্টি করে।

দক্ষিণ এশিয়ার জটিল ভূ-রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপের মধ্য দিয়ে চলার মাঝো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরপর দুই বার নয়া দিল্লি সফরের মাধ্যমে ভারতের দিকে উল্লেখযোগ্য ঝোঁক দেখিয়েছেন। ৯ জুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যাওয়া এবং দুই সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে আবারও দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফর প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সম্পর্কই তুলে ধরে। হাসিনার পরিকল্পিত বেইজিং সফরের আগে ভারতীয় এই তড়িৎ সংশ্লিষ্টতা বুঝেশুনে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের অগ্রাধিকারেরই ইঙ্গিত দেয়। 

আঞ্চলিক গতিশীলতা এবং পানি কূটনীতি

অধিকন্তু, বেইজিং সফরটি আঞ্চলিক বিরোধ এবং সম্পদ নিয়ে আঞ্চলিক উত্তেজনার পটভূমিতে ঘটেছে। তিস্তা নদী প্রকল্পটি এশিয়ার দুই পরাশক্তির সঙ্গে কৌশলগত অবস্থান বজায় রাখায় বাংলাদেশের সক্ষমতার একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তিস্তা নদী প্রবাহমানতা ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে চীনের করা আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তার প্রস্তাবের পটভূমিতেই সাম্প্রতিক ভারতের অর্থায়নের প্রস্তাব আসে।

এই প্রস্তাব বেইজিং এবং নয়াদিল্লির স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিযোগিতাকে আরও তীব্র অবস্থানে নিয়ে যায় এবং আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বৃদ্ধির সম্ভাব্য ক্ষেত্র তৈরি করেছে।

তিস্তা নদী বাংলাদেশ ও ভারত—উভয় দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এই বিবেচনায় বাংলাদেশ ভারতের প্রস্তাবকেই অগ্রাধিকার দেবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের এমন মন্তব্য সেই সূক্ষ্ম ভারসাম্যকে বোঝায় যা ভৌগলিক নৈকট্য ও  ঐতিহাসিক সম্পর্কের কারণে চীনের অর্থনৈতিক সুবিধার বিপরীতে গিয়ে বাংলাদেশ ধরে রাখতে হয়। প্রকল্পটি শুধু পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার বিষয় নয়, বরং আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির জটিল জলসীমায় তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষা এবং উভয় পরাশক্তির সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সক্ষমতার একটি পরীক্ষা।

অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ভূরাজনীতি

ভারতকে ‘রাজনৈতিক বন্ধু’ এবং চীনকে ‘উন্নয়নের বন্ধু’ হিসেবে চিহ্নিত করা বাংলাদেশ যে দেশ দুটির সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখার চেষ্টা করেছে তাই তুলে ধরে। কিন্তু ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সঙ্গে মিশে যাওয়া এবং কঠিন কৌশলগত বাছাইয়ের ফলে বাংলাদেশের জন্য এই পার্থক্য ধরে বজায় রাখা ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠতে পারে।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নির্বাচনের আগে, চীন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার কথা বলেছিল যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের একটি প্রচ্ছন্ন বার্তা ছিল। একইভাবে, গত সেপ্টেম্বরে আমেরিকার সঙ্গে পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের উচ্চ পর্যায়ের সংলাপের সময় ভারত বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান প্রকাশ করেছিল। সংলাপ-পরবর্তী প্রেস ব্রিফিংয়ে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা বলেছিলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং বাংলাদেশের জনগণ তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।

একভাবে, বর্তমান সরকারের প্রতি সমর্থনের ব্যাপারে চীনা অবস্থানও ফুটে উঠেছে। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির সহায়ক ঘোষণাগুলোও আঞ্চলিক স্বার্থ ঘিরে প্রতিযোগিতা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।

সামনে কঠিন পথ

বাংলাদেশের ভারত-চীন ভারসাম্য নীতি ক্রমশ অপ্রত্যাশিত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। যদিও চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা উন্নয়নে কিছুটা সুবিধা দিয়েছে। তবে তা ঋণ নির্ভরতা এবং কৌশলগত দুর্বলতার বিষয়ে উদ্বেগও সামনে নিয়ে এসেছে। দক্ষিণ এশিয়া এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের বিকাশমান ভূ-রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপ বাংলাদেশের নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখাকে ক্রমশ কঠিন করে তুলেছে। বাংলাদেশকে আঞ্চলিক নিরাপত্তা, পানির অধিকার এবং অর্থনৈতিক একীভূতকরণের মতো জটিল সমস্যাগুলিকে মোকাবিলা করে পথ চলতে গিয়ে এই দুই পরাশক্তির সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের শঙ্কা রয়েছে। 

সামনে এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশকে বৈদেশিক নীতির কৌশল পুনর্বিবেচনা করতে হতে পারে। কারণ ভারত ও চীনের মধ্যে নিখুঁত ভারসাম্য বজায় রাখা তার জন্য ক্রমশ নাগালের বাইরে বলে প্রমাণিত হতে পারে। একটি সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গি যা ইস্যু-ভিত্তিক পরম্পরা বজায় রেখে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয় তা আরও কার্যকর হতে পারে। পরাশক্তিগুলোর মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রভাব যে অঞ্চলে আধিপত্য চালায় বা বেশি হয় সেখানে ছোট দেশগুলির যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে বাংলাদেশের দ্বিধা ও অভিজ্ঞতা তাই সামনে এনেছে। অন্যসবে মধ্যে একবিংশ শতাব্দীতে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির জটিল জলে পথ চলতে হলে সূক্ষ্ম কূটনীতি, অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য এবং জাতীয় স্বার্থের একটি স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন।

সৈয়দ মুনির খসরু, আন্তর্জাতিক থিংক ট্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর পলিসি, অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড গভর্নেন্সের (আইপিএজি) চেয়ারম্যান। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে অনুদিত। 

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন