Logo
Logo
×

অভিমত

হে নিরপেক্ষ নির্বাচন : পেট পুরেদ্দে তোঁয়ার লাই

লুৎফর রহমান

লুৎফর রহমান

প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৪, ১১:১৭ এএম

হে নিরপেক্ষ নির্বাচন : পেট পুরেদ্দে তোঁয়ার লাই

বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল পাকিস্তানের শাসক ইয়াহিয়া খান কর্তৃক নির্বাচনের ফলাফল মেনে না নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতেই। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান নামীয় দুই প্রদেশের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে না দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ক্র্যাকডাউন করা হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। 

এর পরের কাহিনি আমাদের অজানা নয়। শেখ মুজিবর রহমান গ্রেপ্তার হন, কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা আসে মেজর জিয়ার কণ্ঠে। সারাদেশে যুদ্ধ ছড়িয়ে পরে। সে যুদ্ধ ছিল স্বাধিকার আন্দোলনের। সে যুদ্ধ ছিল হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর  বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে স্বাধীন ও মুক্ত করার যুদ্ধ। সে যুদ্ধ ছিল মুক্তিযুদ্ধ '৭১। 

পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্য ছিল সীমাহীন। কিন্তু যুদ্ধ ও স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট তৈরি করে মূলত; নির্বাচনী ফলাফল মেনে না নেওয়ার ঘটনাই। কিন্তু সেই নির্বাচনের এখন কি হাল হকিকত ?

নির্বাচন ব্যবস্থার অনিয়ম আর এরশাদীয় স্বৈরশাসনের অবসান কল্পে দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলে দেশবাসী। বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন অবৈধ এরশাদ শাসনের বিরুদ্ধে এক আপোষহীন নেত্রী। যদিও শেষ মুহূর্তে শেখ হাসিনা এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব  দিয়েছিলেন। কিন্তু ৮৬ সালে এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশ গ্রহণের বিষয়টি ছিল সেই সময়ে স্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পিঠে ছুরিকাঘাতের মত। এরশাদের শাসনকাল দীর্ঘায়িত হওয়ার এটিই ছিল মূল কারণ। 

এরশাদের পদত্যাগে ৯১ এ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কনসেপ্টটি দেশবাসী বাস্তবিক অর্থে গ্রহণ করে নজিরবিহীন নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে দেখে। 

৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয় নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে। এই সংসদ বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আইন পাশ করে আনুষ্ঠানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রক্রিয়ার অভিযাত্রা শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় ৯৬ সালে ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ এবং ২০০১ এ ৮ম জাতীয় সংসদে বিএনপির নেতৃত্বে চার দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ক্ষমতা লাভ করে। এই নির্বাচনগুলো ছিল যথার্থই নিরপেক্ষ ও প্রশ্নবিদ্ধহীন। আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত। 

এরপরে ছন্দপতন ঘটে। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন গংদের ক্ষমতাগ্রহণ ছিল এদেশের প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক রূপ বদলে দেওয়ার জন্যেই। নিয়মবহির্ভূতভাবে দুই বছর ক্ষমতায় থেকে তারা বিএনপি নেতা-কর্মীদের জেলে পুড়ে ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক নামক প্রশ্নবিদ্ধ সরকারের অধীনে সম্পন্ন করে আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা দিয়ে সেফ এক্সিট গ্রহণ করে। 

আওয়ামী লীগ চিরস্থায়ী ক্ষমতা বন্দোবস্থের অভিপ্রায়ে জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইনটি বাতিল করে। ফলশ্রুতিতে পরপর তিনটি জাতীয় নির্বাচনকে দেশ এবং বিদেশে কোন নিরপেক্ষ নির্বাচন বলে স্বীকৃতি দেয়নি কেউ। কার্যত; এই নির্বাচনগুলো ছিল একদলীয় নির্বাচন। কোনো অংশগ্রহণমূলক নিরপেক্ষ নির্বাচন ছিল না। 

একটি সরকারের বৈধতা শুধুমাত্র ধারাবাহিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমেই একটি সরকারের নৈতিক অবস্থান সৃষ্টি হতে পারে। সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় জনপ্রিয় সরকারের মাধ্যমে। বিতর্কিত ভোট, রাতের ভোট বা ডামিভোটে অনৈতিকতাই শুধু নয় প্রতিষ্ঠিত হয় কুশাসন। 

দুর্নীতির মচ্ছব, অর্থপাচার, অনাচার, সমগ্র দেশ সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণ কিন্তু সার্বজনীন ভাবে অগ্রহণযোগ্য সরকারের কার্যকলাপ। নৈতিক স্খলন, অনৈতিক, অনিয়ম, অন্যায়, ঘুষ দুর্নীতি অর্থপাচারসহ সকল অপকর্মের প্রেক্ষাপট রচনার মূলেই কিন্তু নিরপেক্ষহীন নির্বাচিত সরকারের কারণেই সৃষ্টি হয়েছে। সকল অনৈতিকতার মানদণ্ড বা রেফারেন্স আসে ভোটারবিহীন সরকার প্রতিষ্ঠার কারণে। এই মূল অনিয়ম হাজারো অনিয়ম আর দুর্নীতির বাহ্যিক রূপমাত্র। 

বাংলাদেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের রেওয়াজ ছিল একটি উৎসবের মত। সারাদেশের মানুষ নির্বাচন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ত। সহনশীল আচরণে অনুষ্ঠিত নিরপেক্ষ নির্বাচনের ফলাফলের দিকে চাতক পাখির মত তাকিয়ে থাকতো দেশবাসী। আর এখন কে নির্বাচিত হবে এ বিষয়টি আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই দেশবাসী বুঝে ফেলে। সুস্থ নির্বাচন, নিরপেক্ষ নির্বাচন, অংশগ্রহণ মূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এখন সুদূর পরাহত মাত্র। 

জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া প্রেমের জন্যে সকলই কাঁদে। মন কাঁদায় হারানো প্রেম। নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্যে আমাদের যে প্রেম, যে আহাজারি তাকি চট্টগ্রাম অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার এই গানের কথাগুলোর মত নয় ?

ও কালাচান গলার মালা

পেট পুরেদ্দে তোঁয়ার লাই

কইলজা জ্বলে তোঁয়ার লাই। 

হে নিরপেক্ষ নির্বাচন, একদা তুমি ছিলে আমাদের গলার মালা, আজ মন কাঁদে তোমার জন্যে, আজ কলিজা জ্বলে যায় তোমার জন্যে। 

লেখক: লুৎফর রহমান, রাজনীতিবিদ ও লেখক। 

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন