Logo
Logo
×

অভিমত

পুলিশ কর্মকর্তা মাসরুফ, তার ‘বনখেকো পিতা’ এবং সামাজিক মাধ্যমে ‘নীতি পুলিশির’ বুমেরাং

Icon

হারুন উর রশীদ

প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৪, ০৮:০৬ পিএম

পুলিশ কর্মকর্তা মাসরুফ, তার ‘বনখেকো পিতা’ এবং সামাজিক মাধ্যমে ‘নীতি পুলিশির’ বুমেরাং

২০১৩ সালে আমি একটি জাতীয় পত্রিকায় কাজ করতাম। আমার সেই পত্রিকার সম্পাদক তখন আমাকে একজন তরুণ পুলিশ অফিসার মাসরুফ হোসেনের ওপর একটি লেখার জন্য অ্যাসাইনমেন্ট দেন। আমি কিছুটা অবাক হয়েছিলাম, কারণ মাসরুফ তখন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদে দায়িত্বে ছিলেন। সাধারণত সংবাদপত্রে এমন পদের ব্যক্তির ওপর অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয় না, যদি না তারা অসাধারণ কিছু অর্জন করেন।

তাই সাক্ষাত্কারের সময় নির্ধারণের আগে তার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করি। এবং আমি জানতে পারি, মাসরুফ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উত্তরা জোনের জন্য একটি অ্যাপ চালু করার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। ওই অ্যাপে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। যদিও সেখানে অভিযোগ খুবই কম পড়েছিল। তারপরও মাসরুফের প্রচেষ্টাটি ব্যতিক্রম। কারণ পুলিশ বাহিনীকে প্রায়ই পুরানো এবং আমলাতান্ত্রিক হিসাবে দেখা হয়। 

এছাড়া মাসরুফ ফেসবুকে সক্রিয় ছিলেন। তিনি পুলিশিং পরামর্শ এবং বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য শেয়ার করতেন। এর মাধ্যমে তিনি অনেকের মনোযোগ অর্জন করেছিল।


মাসরুফ নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছেন। তবে সাধারণত এই ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ে তেমন কেউ সরকারি চাকরিতে আসতে চান না। প্রায় সবাই সরকারি চাকরির বাইরে ক্যারিয়ার গড়েন। 

মাসরুফ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে পাবলিক সার্ভিসে কর্মজীবন বেছে নিয়েছিলেন। এর জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে তাকে যারা ফলো করেন তারা তার প্রশংসা করতেন। আর তিনি শীঘ্রই "ডিজিটাল কপ" ডাকনাম অর্জন করেন।

পরে, মাসরুফের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়। সাক্ষাৎকারের সময় তাকে ভদ্রলোক বলে মনে হয়েছে। তিনি নরম কিন্তু ব্যারিটোন ভয়েসে কথা বলেছিলেন। তার কথায় বাংলার সঙ্গে ইংরেজি মিশ্রিত ছিল। বাংলাদেশের একজন পুলিশ অফিসারের জন্য একটি অপ্রত্যাশিত বৈশিষ্ট্য। তিনি সত্যিকার অর্থে পুলিশ পরিষেবাগুলোকে উন্নত করার পরামর্শের প্রতি সহানুভূতি এবং ইচ্ছুকতা প্রদর্শন করেছিলেন।

মাসরুফ সাক্ষাৎকারে বেনজীর আহমেদকে তার রোল মডেল হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর তখন  ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পুলিশ কমিশনার ছিলেন। মাসরুফ সেদিন বেনজীরের অনবদ্য চেহারা এবং একজন চৌকস পুলিশ হিসেবে খ্যাতির প্রশংসা করেছিলেন। যদিও তখন বেনজীরের দুর্নীতির বিষয় নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা ছিল না।

মাসরুফ কর্মজীবনের পাশাপাশি একাডেমিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। তিনি টোকিও ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুটি অতিরিক্ত স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

এই পুরো সময়জুড়ে, তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে সক্রিয় ছিলেন। তার ব্যক্তিগত জীবনের অনেক কিছু শেয়ার করেছেন  যার মধ্যে তার বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ এবং দ্বিতীয় বিয়ে রয়েছে। এছাড়া বই, চলচ্চিত্র এবং তাদের সুপারিশগুলোর প্রতি তার আবেগ এবং সেগুলোর জন্য তার অকৃত্রিম প্রশংসা। যারা একাডেমিক সাফল্য অর্জন করেছে।

অনলাইন উপস্থিতি জনসাধারণের সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক বাড়িয়েছে। তার বিভিন্ন আগ্রহ এবং অভিজ্ঞতা সম্পর্কে শেয়ার করেছেন। তবে তিনি এর মধ্যে তার বাবার বিপুল সম্পদের উৎসের বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। 


একজন ধনী ব্যক্তির সন্তান হওয়ার মধ্যে কোনো লজ্জা নেই। বিশেষ করে যখন সেই সম্পদ নৈতিক উদ্যোক্তা বা সমাজে ব্যতিক্রমী অবদানের মাধ্যমে অর্জিত হয়। প্রকৃতপক্ষে, এই ধরনের ব্যক্তিরা প্রায়শই তাদের কৃতিত্ব এবং তাদের সম্প্রদায়ের ওপর তাদের ইতিবাচক প্রভাবের জন্য প্রশংসা অর্জন করে। তবে মাসরুফের বাবার সম্পদ এত সম্মানজনকভাবে অর্জিত হয়নি।

তার বাবর অবৈধ কার্যকলাপ এতটাই জঘন্য ছিল যে, বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক সমকাল সম্প্রতি তার দুর্নীতির বিষয়টি উন্মোচন করে একটি প্রথম পৃষ্ঠায় নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। তাকে সেখানে "আরেক 'বন ভক্ষক' মোশাররফ" বলে অভিহিত করেছে। যা বন সম্পদের তার অবৈধ শোষণের বিষয়টি উল্লেখ করে। 

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্ত অনুসারে, মোশাররফ হোসেনের প্রায় ১১২ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। তবে তিনি এই সম্পদ অর্জনে ব্যবসা বা উত্তরাধিকার সূত্রে পাননি। একজন সরকারি কর্মচারী হিসেবে তিনি এই সম্পদ অর্জনের  ব্যাখ্যা করতে হিমশিম খাবেন। তাছাড়া দুর্নীতিতে মোশাররফের জড়িত থাকার বিষয়টি হঠাৎ করে প্রকাশ্যে আসেনি। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের জবাবে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এর আগে মোশাররফকে দ্রুত অবসর নেওয়ার নির্দেশনা জারি করেছিল।

ছেলে হিসেবে পুলিশ অফিসার মাসরুফ তার বাবার দুর্নীতি ও বেআইনিভাবে অর্জিত সম্পদের বিষয়ে নিশ্চয়ই অবগত ছিলেন। তারপরও তিনি এগুলো আড়াল রেখে, মাসরুফ মানুষকে বই পড়তে, নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ এবং বৈধ উপার্জনের ওপর সৎ ক্যারিয়ার গড়ার জন্য উত্সাহিত করে চলেছেন। 

তবে একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে আমি মাসরুফের চলমান মেয়াদে কোনো দুর্নীতিতে জড়িত থাকার কথা শুনিনি এবং আমি তার বাবার অন্যায়ের জন্য তাকে দোষারোপ করা নৈতিকভাবে অন্যায় বলে মনে করি।

যাইহোক, যখন কেউ ভালো নাগরিকত্বের বিষয়ে নৈতিক শিক্ষা এবং পরামর্শ দেওয়ার ভূমিকা নেয়, তখন তাদের অবশ্যই নিজের নিশ্চিত করতে হবে যে তাদের নিজস্ব ভিত্তি শক্ত এবং এমন নীতির ওপর নির্মিত যা সময়ের সাথে সাথে যাচাই-বাছাই সহ্য করতে পারে।

তবে তাদের ভিত যদি অবৈধ সম্পদ এবং উপায়ে হয় তাহলে এটি শীঘ্রই ধসে পড়বে। অভূতপূর্ব অসম্মান নিয়ে আসবে।

আমি আশা করি অফিসার মাসরুফ আপনি এখন বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন।

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন