Logo
Logo
×

অভিমত

মুক্তিযুদ্ধ কোটা : কিছু মূল আলাপ

Icon

আহমেদ খিজির

প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৪, ০১:৪৯ পিএম

মুক্তিযুদ্ধ কোটা : কিছু মূল আলাপ

চলতি কোটা আন্দোলনের একটি ছবি

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত দুইদিন ধরে আন্দোলনে উত্তাল দেশের তরুণ সমাজ। এর আগে তরুণদের আন্দোলনের মুখে সরকার কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে পরিপত্র জারি করলেও সম্প্রতি হাইকোর্ট আবারও সেই পরিপত্র বাতিল করায় কোটার ব্যাপারটি ফিরে আসে। 

বর্তমানে সরকারি চাকরিতে ৫৫ ভাগই কোটা, এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা ৩০ শতাংশ (ছেলে-মেয়ে ও নাতি-নাতনি), নারী ১০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ। এই ৫৫ শতাংশ কোটায় পূরণযোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সেক্ষেত্রে ১ শতাংশ পদে প্রতিবন্ধী নিয়োগের বিধান রয়েছে। এর বাইরে বাকি ৪৫ শতাংশ সাধারণদের জন্য বরাদ্দ।

অন্যসব কোটা নিয়ে খুব বেশী আপত্তি না থাকলেও মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়েই কোটার পক্ষ-বিপক্ষে দুই দলই সোচ্চার। কোটার পক্ষে যারা তারা বলছেন,  মুক্তিযোদ্ধাদের কারণেই আমরা দেশ পেয়েছি, তাদের সম্মান করা আমাদের একেবারে প্রাথমিক কর্তব্য। তাদের প্রতি ৩০ শতাংশ বরাদ্দ সেই কর্তব্যর অংশ। অন্যদিকে কোটাবিরোধীরা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশ নিয়েছিলেন তাদের নাতিদের এই সুযোগ দেওয়া অন্যায়। তদুপরি ৩০ শতাংশ অনেক বেশি, যা দেশে সংবিধানের পরিপন্থী। 

এই কোটার ব্যাপারে কিছু সংক্ষিপ্ত কিন্তু মূল আলাপ করা যাক। 

যারা যুদ্ধ করে দেশের স্বাধীনতা বা নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন, সারা দুনিয়ায় তাদের সম্মান করার বিধান আছে। মার্কিন মুলুকে ভেটেরানদের জন্য অনেক ধরনের সুবিধা আছে, ইউরোপে আছে, ভারতে আছে। মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারে প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব তো আছেই, দেশের সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে অনগ্রসর শ্রেণীর মানুষদের সামাজিক নিরাপত্তা দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। 

সেই অনুসারে দুইটা প্রশ্ন আসে। এক, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি দায়িত্ব কি কেবল চাকরি দেওয়া? সরকারি চাকরি একধরনের বিশেষায়িত কাজ, এইখানে দক্ষতা জরুরি। মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা দিয়ে রাষ্ট্র আসলে একই সাথে উনাদের সঙ্গে দুই ধরনের ফাঁকি দিচ্ছেন। প্রথমত, প্রতিটা মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের যেই আর্থিক ও সামাজিক সুবিধা পাবার কথা তার বদলে কোটার মুলা ঝুলিয়ে দিচ্ছেন, দ্বিতীয়ত, কোটার মাধ্যেমে ৩০ শতাংশ চাকরি আলাদা করে ফেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তরুণদের একধরনের উষ্মা সৃষ্টি করছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করার সুযোগ তৈরি করা হচ্ছে। 

দ্বিতীয় যে প্রশ্নটা উঠে আসে, মুক্তিযোদ্ধাদের কি অনগ্রসর শ্রেণি হিসেবে দেখানো যায়? দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বহু অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তাদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে রাষ্ট্র অতি অবশ্যই খেতাব দেবে, পুরস্কার দেবে, কিন্তু যাদের সামাজিক নিরাপত্তা দেওয়ার কথা তাদের বঞ্চিত করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তা বরাদ্দ করা কি খোদ মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার বিপরীত হয়ে গেলো না? 

যুক্তি হিসেবে বলা হয়, ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযোদ্ধাদের এই উপহার দিয়েছিলেন। এই কারণে সেই উপহার ফেরত নেওয়া যাবে না। কিন্তু, এই যুক্তি হাস্যকর। দেশের সেসময়ের প্রেক্ষাপটে ৮০ শতাংশই ছিলো কোটা (জেলা-৪০, মুক্তিযোদ্ধা-৩০ আর নারী ১০)। সময়ের সাথে সাথে সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এর চেয়েও বড় কথা, সেই আইনটাকে বলা হয়েছিলো ইন্টেরিম রিক্রুটমেন্ট রুলস বা অস্থায়ী নিয়োগ নিয়মাবলী। দেশের ক্রান্তিলগ্নে, নতুন দেশ গড়ার উদ্যগে যে জরুরি আইন করা হয়েছিলো তা কি ৫৩ বছর পর খাটে? এখন কি দেশে জরুরি অবস্থা চলে?

আরেকটা বড় প্রশ্ন হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিদের সুযোগ পাওয়ার অধিকার কি আছে? কয় প্রজন্ম ধরে রাষ্ট্র এই সুবিধা দেবে। কোটার মূল কথাই হচ্ছে, যারা পিছিয়ে আছে রাষ্ট্র তাদের সুবিধা দিয়ে একটা লেভেলে নিয়ে আসবে। মুক্তিযুদ্ধে যেসব পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যাদের স্বজন মারা গেছেন বা পঙ্গু হয়েছেন, তাদের সহায়তা দেওয়ার জন্যই ৭২ সালে চাকরির ক্ষণস্থায়ী বিধান করা হয়েছিলো। সেই পরিবার কি দুই প্রজন্ম পরেও এই সুবিধা পেতে পারে? দুনিয়ার সব দেশে ভেটেরান বা যুদ্ধফেরতদের চাকরি বা অন্য সুবিধা এক প্রজন্মেই দেওয়া হয়। এরপরে যুক্তি বা নৈতিকতা অনুসারে এই সুবিধা দেওয়া অনুচিত। 

এখানেই চলে আসে আরেকটা রাজনৈতিক ব্যাপার। এই সরকারের আমলে রেজিস্টার্ড মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বহুগুনে বেড়েছে। তালিকায় জায়গা পেয়েছে প্রচুর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। কোটা বহাল রাখার মাধ্যেমে মুক্তিযুদ্ধের তালিকা করা নিয়ে চলছে ব্যাপক দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি। সরকারি চাকরিতে অর্থ আর দলীয় প্রভাবে বড় অংশের নিয়োগ হচ্ছে। মহান মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে রেখে চলছে এই মহা দুর্নীতির যজ্ঞ। 

ফলে, কোনো যুক্তিতেই বর্তমানে ৩০ শতাংশ যে মুক্তিযুদ্ধ কোটা আছে তা যৌক্তিক নয়। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারদের চাকরি নয় বরং উপযুক্ত আর্থিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সম্মান দেওয়া জরুরি। 

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন