Logo
Logo
×

অভিমত

ঢাকাকে গরিবের নরক, ধনীর স্বর্গ বানানোর মহাউদ্যোগ

Icon

আহমেদ খিজির

প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২৪, ০৬:৩৮ পিএম

ঢাকাকে গরিবের নরক, ধনীর স্বর্গ বানানোর মহাউদ্যোগ

করোনার আগে পাওয়া তথ্যেই জানা যায় যে, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ১০ শতাংশ ধনীর আয় শহরের অধিবাসীদের মোট আয়ের ৪২ শতাংশ। সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশের আয় মোট আয়ের ১ শতাংশেরও কম। আর সাড়ে তিন শতাংশ মানুষ তিন বেলা খাবার জোটাতে পারে না। করোনার পরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে সন্দেহ নাই। 

আর অবস্থা খারাপ করার পেছনে দেশের সরকার ও কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা রয়েছে। ঢাকা শহরে যারা বসবাস করেন তাঁরা চোখ কান খোলা রাখলেই দেখতে পাবেন যে, এই শহরটা দিনকে দিন গরিবদের জন্য অসহনীয় করে তোলা হচ্ছে। 

এর সাম্প্রতিক উদাহরণ দেখা গেলো, মিরপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনে ঢোকার জন্য জনপ্রতি ১০০ টাকা প্রবেশমূল্য নির্ধারণ। ঢাকা শহরে এখন সবুজের ভীষণ সংকট। প্রকট বায়ুদূষণ, প্রচণ্ড ট্র্যাফিক জ্যাম ও অর্থনৈতিক চাপ সামলে একটুখানি খোলা জায়গায় সময় কাটানো হয়তো অসহনীয়। তাই এই শহরের মানুষদের কিছুটা অক্সিজেন ও স্বস্তি দিতে পারে। কিন্তু, সেই সামান্য চাহিদাও যাতে পূরণ না হয় সেই পরিকল্পনাই নেওয়া হয়েছে। ঢাকায় আগে যেইসব পার্ক বা খেলার মাঠ ছিল সেসবের বেশিরভাগই এখন গেট দেওয়া, সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। অন্যদিকে, ঘণ্টায় কয়েক হাজার টাকা ভাড়ার বিনিময়ে ধনী লোকের ছেলে-মেয়েরা মাঠ ভাড়া করে খেলছে। 

শুধু বড়দের জন্য না, গরীব ঘরের বাচ্চাদের জন্যও এই শহর হয়ে উঠছে নরক। স্বাভাবিক শৈশব বঞ্চিত এসব শিশুদের অপরাধ জগতে ঠেলে দেওয়াই যেন শাসকদের পরিকল্পনা। লুটেরা আর মাফিয়া শাসকদের নোংরা কাজগুলো নিশ্চিত করার গ্যারান্টি দেয় এই পরিকল্পনা। গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করে ধনী মালিকদের বিপুল বিত্ত অথবা অপরাধ করে রাজনীতিবিদদের ক্ষমতা আরও পোক্ত করা, এই যেন গরিবের ভবিতব্য। 

এই ব্যাপারটা তথাকথিত উন্নয়নের সবখানে চোখে পড়ে। হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে মেট্রোরেল করা হলো, তবে নানাভাবেই সেইখানে দরিদ্র ও অশিক্ষিত মানুষদের জন্য ব্যারিয়ার তৈরি করা হয়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি কিংবা আধুনিকতা থাকবে, কিন্তু তা সহজ করার জন্য, দরিদ্রদের আকর্ষণ করার কোন উদ্যোগ নাই। শুধু তাই না, উন্নয়নের পরিকল্পনায় প্রাধান্য পায় উড়াল সড়ক, প্রাইভেট কার বন্‌ধ ব্যবস্থা। আর, এর বাইরে থাকে লক্কড়-ঝক্কর বাস। জঘন্য রকম গনপরিবহন। বার্তাটা পরিষ্কার। উন্নয়ন কেবল ধনীদের। বাকিরা এই শহরে থাকবে কেবল ধনীদের সেবা করার জন্য।

মধ্যবিত্তও অবশ্য ধনী হবার খায়েশে এই ফাঁদে পা দেয়। মেট্রোরেল বিষয়ে আলাপে ভাড়া বাড়ানোর অন্যায্য প্রস্তাবেও একটা অংশ খুশী হয়, নিজের ক্ষতি হলেও। প্রায় বিকল একটা পরিবহন ব্যবস্থায় রিকশার জরুরত থাকলেও মধ্যবিত্ত অনেক সময় এর বিরোধিতা করে। দরিদ্রের বিরুদ্ধে শ্রেণি যুদ্ধ করে। অথচ, হরেদরে এতে মধ্যবিত্তেরই ক্ষতি। 

যেমন, গুলশান, বনানী বা বসুন্ধরার ‘ভদ্রলোকীকরণ’ শুরু হয়েছে বহু আগেই। আগে গ্রামীণ বাস, বনানী ট্রান্সপোর্ট, আর ৬ নম্বর বাস ছিল। এগুলো সরিয়ে দিয়ে এখন মাত্র দুটি অভিজাত কোম্পানির এসি বাস চলে। সাত বছর আগেও নতুন বাজার থেকে কাকলি পর্যন্ত (২ কিলোমিটার) ভাড়া ছিল মাত্র ৫ টাকা। এখন হয়েছে ৩০ টাকা! অথচ ২০২২ সালের সরকার–নির্ধারিত ভাড়ার হার কিলোমিটারপ্রতি ২.৪৫ টাকা! অর্থাৎ চাপিয়ে দেওয়া এসি বাসের ভাড়া প্রায় ৬ গুণ বেশি! উন্নয়নের নামে, নিম্ন তো বটেই, মধ্য আয়ের মানুষকে ছেঁটে ফেলার মহা উদ্যোগই বটে। 

যুক্তরাষ্ট্রে কালো মানুষদের অচ্ছুত করে রাখার নগর পরিকল্পনা কুখ্যাত। পার্ক, গণপরিবহন এর অংশ। জমি ও আবাসনের দাম আকাশছোঁয়া করাও আরেকটা উদ্যোগ। ঢাকা শহরে আমরা আশঙ্কাজনকভাবে দেখছি দরিদ্র লোকদের বস্তি উচ্ছেদ করে সেখানে মার্কেট কিংবা বাণিজ্যিক ভবন করার হিড়িক পড়েছে। এসব মার্কেট মূলত ধনীদের জন্য। 

অন্যদিকে দরিদ্র মানুষের সস্তায় পণ্য পাবার রাস্তার পাশে থাকা ভাসমান দোকান বা বাজারগুলো উচ্ছেদ করা হচ্ছে। এমনকি ভাতের হোটেলগুলো পর্যন্ত নাই করে দেয়া হচ্ছে। গরিবেরা ভাতে মরবে, পানিতে মরবে, আগুনে পুড়ে মরবে, জ্যামে বসে থাকতে থাকতে পাগল হয়ে যাবে, খোলা হাওয়ায় পর্যন্ত দম নেওয়ার সুযোগ পাবে না। ঢাকা শহরকে পরিকল্পিতভাবে নরকে পরিণত করা হয়েছে। 

যেহেতু দেশে ভোটের বালাই নেই, ফলে দরিদ্র মানুষদের মতামতের কোন মূল্য নেই। ধনীদের তুষ্ট করে, তাঁদের আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা আরো তুষ্ট করে নিজেদের গদি সুসংহত করাই সব পরিকল্পনার মূল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই শহরে দরিদ্ররা এখন কেবলই ধনীদের চাহিদা মেটানোর যন্ত্রমাত্র। ধনীদের বাড়ির কাজের লোক, পরিচ্ছন্নকর্মী, হোটেলের বেয়ারা, গাড়ির ড্রাইভার না লাগলে হয়তো ঢাকা শহরে কোন গরীব লোকের স্থানই হতো না। উন্নয়নের বয়ান দেওয়াদের স্বপ্ন পূরণ হইতো। 

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন