কেয়ার স্টারমার: ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে আমরা যা জানি
তিনি কিভাবে নেতৃত্ব দেবেন?
জো আদেতুনজি
প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২৪, ১০:৫৬ এএম
কিয়ার স্টারমার (সামনে মাঝখানে)
ব্রিটেনের সব প্রধানমন্ত্রীই তাদের নিজস্ব ব্যক্তিত্ব ও স্বতন্ত্র কর্মপদ্ধতি নিয়ে কাজ করেন। প্রত্যেকের নেতৃত্বের আলাদা শৈলী রয়েছে, যা প্রশাসনযন্ত্রকে বলে দেয় কি করতে হবে, কি করা উচিত, এবং কিভাবে তা করতে হবে। হার্বার্ট অ্যাসকুইথ তাৎপর্যপূর্ণভাবে যা সংক্ষেপে বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিষয়টি হল তিনি কি পছন্দ করেন যা তিনি করতে সক্ষম।’
কেয়ার স্টারমার ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কোন পথ বেছে নেবেন সে সম্পর্কে জানার জন্য খুব বেশি মাথা ঘামাতে হয়নি। একটি সাম্প্রতিক পডকাস্টে সরাসরি জিজ্ঞাসা করা হলে যে উত্তর মেলে তা হল: স্টারমার একজন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন যিনি জানেন জনগণ কি চায় এবং অবশ্যই কি করা দরকার।
এই ঘোষণা খুবই স্বাভাবিক। কেউ এর বিপরীত কথা বলবে না। কিন্তু আমরা যা জানি তার বাইরে যা ভাবতে পারি তা হল, অন্তত কিছু ধাঁধা একত্রিত করতে পারি।
ব্যক্তিত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে স্টারমারকে ‘পদ্ধতিগত ও পেশাদার’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। একই সঙ্গে, চমৎকারভাবে কাজ করতে তার দক্ষতার অভাব রয়েছে বলেও বর্ণনা করা হয়ে থাকে। প্রয়াত এমপি ও ইতিহাসবিদ ডেভিড মারকুয়ান্ডের ভাষায় ‘প্র্যাগম্যাটিক অপারেটর’। মানে বাস্তবসম্মতভাবে কাজ করতে সক্ষম স্টারমার। তিনি টনি ব্লেয়ার বা হ্যারল্ড উইলসনের মতো বাগ্মী নন বা আতশবাজির খেলাও দেখান না। আবার তিনি যান্ত্রিকও নন।
স্টারমার একজন শান্ত, অভিজ্ঞ রাজনীতিক। তিনি মূল্যবোধের কথা বলেন এবং একজন সমাজতান্ত্রিক হওয়ার কথা বলেন। যদিও জনসাধারণ নিশ্চিত নয়, স্টারমার আসলেই সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী কিনা বা কী ধরনের সমাজতন্ত্র তিনি চান। আবার এ-ও নিশ্চিত করে বলা যায় যে, স্টারমার তার পূর্বসূরিদের তুলনায় বেশি খাঁটি এবং তার শ্রমিকশ্রেণির জন্য কাজ করার পটভূমি রয়েছে।
আমরা জানি, স্টারমার মাত্র ২০১৫ সালে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। ৫২ বছর বয়সে তিন রাজনীতিতে এসেছেন, যা খুব কমই দেখা যায়। তিনি তার রাজনৈতিক জীবনের পুরোটা সময় বিরোধী দলে কাটিয়েছেন। তার পূর্বসূরিদের মধ্যে থেরেসা মে একজন যিনি মন্ত্রী হওয়ার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু তার সেই অভিজ্ঞতা খুব একটা কাজ করেনি।
সংসদে স্টারমারের সময়টি খুব উত্তেজনাকর ছিল। তিনি ব্রেক্সিটের সাথে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন এবং তারপর মহামারি চলাকালে দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিরোধী দলের নেতা হিসেবে তিনি দুই প্রধানমন্ত্রীকে দ্রুত পরপর অপসারণ করতে দেখেছেন। সেখানে স্টারমার তার আইনি পদ্ধতিতে অপসারকের ভূমিকা পালন করেছেন। আর এখন তিনি নিজেই সেই প্রধানমন্ত্রীর পদে বসলেন।
পাবলিক প্রসিকিউশনের পরিচালক (ডিপিপি) হিসেবে স্টারমার পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়েছেন। অস্বাভাবিকভাবে, রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করার আগেই তিনি একটি রাষ্ট্রীয় সংস্থা পরিচালনা করেছেন।
ডিপিপি হিসাবে স্টারমারের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা আশা করতে পারি, তিনি সমস্যা ও সমাধান খুঁজে বের করতে মনোনিবেশ করবেন। আমরা সম্ভবত পূর্ববর্তী প্রশাসনের বৈশিষ্ট্যযুক্ত আমলা-যন্ত্রের রাজনীতিকরণের অবসান আশা করতে পারি।
বলা হচ্ছে, স্টারমারের সরকার হবে একটি মিশনের নেতৃত্বদানকারী সরকার, যা নিশ্চয়তা দেবে, টেকসই পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে নির্দিষ্ট পথে কাজ করবে এবং দীর্ঘমেয়াদি মিশনগুলির একটি সেট তৈরি করবে। এ ধারণাটি নতুন না, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলির আপাতবিশৃঙ্খলা এবং স্বল্পমেয়াদি সরকারগুলির পর এসব এখন গুরুত্বপূর্ণ।
কিভাবে এবং কত দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন সেটা হবে স্টারমারের জন্য একটা নিষ্ঠুরতম পরীক্ষা। কারণ, আমাদের জানা আছে, স্টারমার একজন পদ্ধতিগত পেশাদার যেখানে তিনি সবকিছু ব্যাপক-বিস্তৃতভাবে দেখেন, যে-কারণে সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য তিনি কয়েকজন আত্মবিশ্বাসী ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেন। উল্লেখ্য, স্টারমার নিজেকে একজন পরামর্শদানকারী নেতা হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় স্টারমারের দল লেবার পার্টির আইন পরিবর্তন-প্রবর্তনের ক্ষমতা রয়েছে। সেখানে একজন স্ব-বর্ণিত সমাজতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল নেতা হিসাবে স্টারমার আইন পরিবর্তন বা প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা এড়াতে পারেন না। কিন্তু তিনি কতটা পরিবর্তন বা প্রবর্তন করতে পারবেন?
একজন প্রাক্তন শ্রমমন্ত্রী বলেছেন, স্টারমার একজন চিত্তাকর্ষক ব্যক্তি, কিন্তু তিনি কখনোই সীমানার বাইরে খুব বেশি দূরে যাননি। এমনকি যখন তিনি একজন র্যাডিক্যাল আইনজীবী ছিলেন তখনও তিনি প্রথাগতই ছিলেন। বিপ্লবী কিছু করেননি।
স্টারমার ঠিক কি চিন্তা করছেন তা একটি রহস্য। অথবা বলা যায়, ধাঁধায় মোড়ানো রহস্য। তিনি কিভাবে তার দলকে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিজয়ী করেছেন তা এখনও রহস্য। তেমনই কিছু তিনি তার দেশের জন্যও করবেন—এমন আশা তার সমর্থকদের।
কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটি সত্যতা হল, যা শক্তি হিসেবে শুরু হয় তা দুর্বলতায় শেষ হয়। শিশুদারিদ্র্য থেকে গাজা পর্যন্ত লেবার পার্টির মধ্যে অনেক ফল্ট লাইন ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান। অন্যান্য সমস্যা দূরে বুদবুদ করছে।
অ্যাসকুইথের সতর্কবার্তাটি পুনর্বিবেচনা করার মতো: প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মানে হল একজন নেতা কি করতে সক্ষম তা বুঝতে পারা ও করতে পারা। একেকটা ঘটনা একেকটা সরকারকে বিতাড়িত করে। বিভিন্ন সংকটের মধ্যে উপেক্ষিত হয় অসংখ্য সমস্যা। স্টারমার ভাল করবেন বক্সার মাইক টাইসনের সতর্কবার্তায় মনোযোগ দিলে, ‘সবারই পরিকল্পনা থাকে যতক্ষণ না তারা মুখে ঘুষি খায়!’
বিজয়ের পর স্টারমারের উপর প্রত্যাশার বোঝা চেপেছে। প্রধানমন্ত্রী স্টারমার কী করতে পারেন তার সত্যিকারের পরীক্ষা হবে যখন তার পদ্ধতিগত দৃষ্টিভঙ্গি বিভিন্ন অগোছালো পরিস্থিতির সামনে পড়বে। (দ্য কনভারসেশন থেকে অনুবাদ)
* জো আদেতুনজি, সম্পাদক, দ্য কনভারসেশন, ইউকে