দুর্নীতি : দায়ী কারা, শুধু আমলারা নাকি রেললাইন বহে সমান্তরাল?
গণমাধ্যমে দেখলাম এডিস মশার লার্ভা পাওয়ায় স্কয়ার হাসপাতালসহ নয়টি স্থাপনাকে জরিমানা করা হয়েছে। অর্থাৎ রোগ সারাবে যে প্রতিষ্ঠান সেই প্রতিষ্ঠানেই রোগের জীবানু। খুব ছোট করে অনলাইন মাধ্যমে প্রায় চোখে পড়ে না এমন জায়গায় প্রকাশ পেয়েছে খবরটি। এই খবরটির সাথে বর্তমান কালের অনেক বিষয়েরই কাকতালীয় হলেও মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
কী কী মিল? দেখুন, বেনজির সাহেব শুদ্ধাচার পুরস্কার পেলেন। কোনো সমস্যা নেই তিনি শুদ্ধাচারী হলে পাবেন সে পুরস্কার। কিন্তু দৈনিক কালের কণ্ঠ পেন্ডোরা’র বাক্স খোলার পর ক্রমান্বয়ে দেখা গেলো, শুদ্ধাচারের ‘আচার’-এ কোনোই শুদ্ধতা নেই। অর্থাৎ সেই হাসপাতালে এডিস মশার লার্ভার মতন। ভূত ছাড়ানোর সর্ষেতেই ভূত। তাহলে দাঁড়ায় কী, ভূত তো ছাড়ানো হয়ই-নি বরং ভূতেদের অনেককেই পুনর্বাসন করা হয়েছে। এখন ধীরে হলেও সেই পুনর্বাসিত ভূতদের নাম বেরিয়ে আসছে। আরো আসবে নিশ্চিত। এই রকম একজন শুদ্ধাচারী’ই একটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি করার জন্য যথেষ্ট। কর্মীদের মনোবল গুড়িয়ে দেয়ার জন্য অন্য কারো প্রয়োজন নেই। কথায় বলে মাছের পচন ধরে মাথা থেকে। মাথায় যখন এমন শুদ্ধাচারী থাকে, তখন অন্যরা সঙ্গতই বিব্রত হয়। বাংলাদেশ পুলিশে অনেক সৎ কর্মকর্তা রয়েছেন। আমি নিজেও ব্যক্তিগত ভাবে বেশ কয়েকজনকে চিনি। যারা কখনো ঘুষ দুর্নীতিকে নিজস্বার্থে প্রশ্রয় দেননি। এখানে ‘নিজস্বার্থ’ শব্দটির দিকে নজর দেবেন। অনেকে হয়তো বাধ্য হয়েছেন এবং তা অবশ্যই নিজস্বার্থে নয়।
একজন বিদায়ী সচিবের বক্তব্য শুনলাম। তিনি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পরিচালক মিজানুর রহমান। তিনি জানিয়েছেন, ঢাকায় তার নামে কোনো প্লট, ফ্ল্যাট বা বাড়ি নেই। গণমাধ্যমকর্মীরা তার সততার খবর ফলাও করে প্রচার করেছেন। এমন খবর কি আনন্দের? না, বরং বিষাদের। এমন খবর প্রমাণ করে আমাদের সৎ কর্মকর্তাদের খুঁজে বের করতে হয়। আর এই খুঁজে বের করাটা অবশ্যই সুখকর কিছু নয়। কারণ, খবর সেটাই যেটা হলো ব্যতিক্রম। একজন কর্মকর্তা নিয়ম মেনে চাকরি করবেন এবং অবসরে যাবেন, এটা স্বাভাবিক ঘটনা। নিয়ম মেনে চাকরি করলে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ আহরণের কোনো সুযোগ নেই। আর সঙ্গতই এমন স্বাভাবিক ঘটনা খবর নয়। যখন স্বাভাবিক ঘটনাকে খবর করতে হয়, তখন পরিষ্কার যে, সময়টা ভালো নয়। খবর হলো অস্বাভাবিক ঘটনা। যেমন, হাসাতালে এডিসের লার্ভা। আমাদের দুর্ভাগ্য যে স্বাভাবিক ঘটনাকে আমাদের এখন খবর হিসেবে পরিবেশন করতে হচ্ছে। মানুষকে জানাতে হচ্ছে আমাদের সৎ কর্মকর্তাও রয়েছেন। কী আজব!
রাজনীতিবিদদের কেউ কেউ বলছেন, আমলাদের একটি বড় অংশ দুর্নীতিবাজ। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোদ সংসদের বক্তব্যে এমনটা বলেছেন। মুশকিল হলো, আমলারা যদি দুর্নীতিবাজ হন তাহলে তাদের পৃষ্ঠপোষক কারা? কারা তাদের নিজের সুবিধার জন্য পদায়ন করেছেন? একজন পুলিশ পুরিদর্শকের থানার দায়িত্ব পেতে কী কী করতে হয়? কার কার শুভদৃষ্টির প্রয়োজন পড়ে? এ প্রশ্নগুলো এখন উঠছে। একবার উঠলে তাকে আর ঠেকিয়ে রাখা যায় না। একজন ওসি’র দোষ ধরতে হলে, তার ওসি হওয়ার প্রক্রিয়াটাকেও স্বচ্ছ করতে হবে। গণমাধ্যমে খুঁজে দেখলেই এমন অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার নজির পাবেন। সুতরাং শুধুমাত্র আমলাদের দায়ী করে দুর্নীতি কতটা ঠেকানো যাবে, এমন বিষয়টি এখন প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমলারা রাষ্ট্রযন্ত্রের একেকটা যন্ত্র। একে চালায় রাষ্ট্র-ব্যবস্থা। রাষ্ট্র-ব্যবস্থা চালায় কারা, প্রশ্নটা এখানেই। পরিচালক ঠিক হলে যন্ত্রের ব্যবহারও ঠিক হবে। ঠিকমত ব্যবহৃতের যন্ত্রের কাজও ঠিক হবে। সুতরাং শুধুমাত্র একটি পক্ষকে দোষ দিয়ে বা বলির পাঁঠা বানিয়ে কাজ হবে না। রাষ্ট্র-ব্যবস্থার দুটো চাকা সমানতালে সঠিক ভাবে চললে, সবকিছু ঠিক থাকবে। বেঠিক চললে লাইনচ্যুত হবে এবং লাইনচ্যুত হওয়াটাই পরিণতি। এটা খুব কঠিন কোনো তত্ত্বীয় ব্যাপার নয়। রেললাইন বহে সমান্তরাল, গানের মতন সহজ তত্ত্ব এতে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে নিহত সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের নামটা মনে করতে পারেন। তাকে নিয়ে প্রকাশিত খবরের সূত্রগুলোকে মিলিয়ে দেখতে পারেন সেগুলো কোথায় কোথায় জুড়ে আছে।
অনেকে প্রশ্ন করেন, বেনজির-মতিউর’রা যে কাণ্ড করেছেন এবং তা দীর্ঘদিন ধরে, আগে কেন তা জানা গেলো না। তাদের বলি, এই প্রশ্ন কার কাছে করেন, উত্তর তো নিজের কাছেই রয়েছে। রাষ্ট্র সম্পর্কে যার মোটামুটি ধারণা আছে, তারাই জানেন এর উত্তর। রাষ্ট্র তখনই সত্যিকার অর্থে রাষ্ট্র হয়ে ওঠে, যখন রাষ্ট্র-ব্যবস্থা ও তার পরিচালকরা নাগরিকদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকেন। যখন জবাবদিহি’র বিষয়টা বিস্মৃত হয়ে ওঠে, তখনই দুর্নীতি জাগ্রত হয় তার নিজ স্বভাবে। যার সুযোগ নেন বেনজির-মতিউর’রা। মতিউরের বিষয়টার সাথে মনে রাখবেন তার স্ত্রীর কথাও। যিনি বিনাভোটে উপজেলা চেয়ারম্যান হয়েছেন, ভোট লাগেনি। ভোট মানেই জবাবদিহিতা। অন্তত পাঁচ বছর পরে হলেও মানুষের কাছে হাত পাততে হয় ভোটের জন্য। আর যখন ভোট লাগে না, তখন জবাবদিহিতা ঘুমিয়ে পড়ে। ফলেই সেই চেয়ারম্যান জোর গলায় বলতে পারেন, ‘সাংবাদিক’দের কেনার কথা। জবাবদিহিতার আরেকটা জায়গাকে কলুষিত করার কথা। এভাবেই সমান্তরাল তত্ত্ব না মানার জন্য সব জায়গুলোই অসমান্তরাল তথা কলুষিত হয়ে উঠছে। মানুষ হারাচ্ছে তাদের নির্ভরতার জায়গা। এভাবে সব জায়গা নিয়েই যদি প্রশ্ন ওঠে, তাহলে মানুষ যাবে কোথায়?