Logo
Logo
×

অভিমত

রুশ অভিজাতরা যেভাবে যুদ্ধের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করেছেন

Icon

মিখাইল জাইগার

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৪, ১১:৩০ এএম

রুশ অভিজাতরা যেভাবে যুদ্ধের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করেছেন

ইউক্রেনে যখন যুদ্ধ শুরু হল, রাশিয়ান অভিজাতশ্রেণি দারুণ ধাক্কা খেয়েছিল। পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার মতো। পশ্চিমের বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা এমনকি ভ্রমণেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় রাশিয়ার ধনী নাগরিকরা নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, তাদের আগের জীবন শেষ হয়ে গেছে।

যুদ্ধক্ষেত্রের ক্ষয়ক্ষতি দ্রুত স্তূপীকৃত হয়ে উঠলে অনেক রাশিয়ান ইউক্রেন হামলাকে বিপর্যয়কর ভুল বলে মনে করেছিলেন। ‘আমরা যে রাশিয়াকে গভীরভাবে ভালবাসি তা নির্বোধদের হাতে পড়ে গেছে,’ দেশের বৃহত্তম জাহাজ নির্মাণ সংস্থার প্রাক্তন প্রধান রোমান ট্রটসেনকো বলেছিলেন একজন ব্যবসায়ীকে। ২০২৩ সালের এপ্রিলে ফোনালাপের সময় তিনি এ কথা বলেন, যা সম্প্রতি ফাঁস হয়েছে। ট্রটসেনকো বলেন, ‘এই যুদ্ধ ভালভাবে শেষ হতে পারে না। এটি বিপর্যয়ের মধ্যে শেষ হবে।’

অন্য একটি ফাঁস হওয়া কথোপকথনে, বিখ্যাত সঙ্গীত প্রযোজক ইওসিফ প্রিগোজিন (ইয়েভজেনি প্রিগোজিনের সাথে সম্পর্কিত নয়) রাশিয়ান রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন ও তার সরকারকে ‘অপরাধী’ বলেছেন। ইউক্রেনে আক্রমণের সময় বিদেশে থাকা কিছু রাশিয়ান অলিগার্ক (রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী) দেশে ফিরতে অস্বীকার করেছিলেন। তাদের মধ্যে দেশের বৃহত্তম বেসরকারি ব্যাঙ্কের মালিক মিখাইল ফ্রিডম্যানও ছিলেন।

কিন্তু পরে অভিজাতরা যুদ্ধকে সমর্থন শুরু করেন। ইউক্রেনের রুশ অধিকৃত অঞ্চলে পারফর্ম করার জন্য সংগীতশিল্পীরা ভ্রমণ শুরু করেন। ২০২৩ সালের অক্টোবর ফ্রিডম্যান লন্ডন থেকে মস্কো ফিরে আসেন, সিদ্ধান্ত নেন, নিষেধাজ্ঞার অধীনে পশ্চিমের জীবন অসহনীয় এবং রাশিয়ার পরিস্থিতি তুলনামূলক আরামদায়ক।

ইউক্রেন যুদ্ধ সম্পর্কে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের কথোপকথনের নতুন আর কোনো রেকর্ড নেই। আসলে, এ ধরনের কথোপকথন যে ঘটছে তা কল্পনা করাও কঠিন। কারণ রাশিয়ান অভিজাতরা সংঘাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া বন্ধ করতে শিখেছে। তারা উপসংহারে পৌঁছেছে যে, আক্রমণ, এমনকি যদি তারা একে সরাসরি সমর্থন না-ও করে, তবু এটি তাদের জীবনের এক সহনীয় সত্য। 

কীভাবে এই অভিজাতরা উদ্বেগ থেকে মুক্ত হতে শিখেছে

রাশিয়ান অভিজাতরা পুতিনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এর একাধিক কারণ রয়েছে। একটি কারণ হল, পুতিন ভিন্নমত দমন করায় এই অভিজাতরা আরও সতর্ক হয়ে উঠেছে। আরেকটি কারণ হল, অভিজাতরা জানে, পুতিনের বিরুদ্ধে যাওয়া বা প্রতিবাদ করা অর্থহীন।

অভিজাতদের মত-পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় কারণ সম্ভবত এই যে, তারা আগ্রাসনকে মৌলিকভাবে ভিন্ন আলোয় দেখতে শুরু করেছে। আজ তারা বিশ্বাস করছে, রাশিয়া একটি শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। মস্কো স্থির হয়ে উঠছে, যদিও ধীরে। অপরদিকে ইউক্রেন বিধ্বস্ত। তাদের জন্য পশ্চিমা সমর্থন হ্রাস পাচ্ছে।

‘বিজয়ী হিসাবে বহিষ্কৃত হওয়া খারাপ, তবে পরাজিত হিসাবে বহিষ্কৃত হওয়া আরও খারাপ,’ একজন রাশিয়ান অলিগার্ক বলছেন এ কথা। তিনি এর আগে যুদ্ধের সমালোচনা করেছিলেন। তিনিও অন্যদের মতো নিজের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেছেন। তার মতে, রাশিয়ার সবকিছু বদলে গেছে। পুতিনের প্রতি মনোভাব। ইউক্রেনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি। পশ্চিমের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি। সব বদলে গেছে। এই অলিগার্ক আমাকে (এই বিবন্ধের লেখককে) আরও বলেছেন, ‘আমাদের অবশ্যই এই যুদ্ধে জয়ী হতে হবে। অন্যথায় তারা (রাশিয়াবিরোধীরা) আমাদের বাঁচতে দেবে না। এবং, অবশ্যই, রাশিয়ার পতন হবে।’ 

একই পরিপ্রেক্ষিতে অলিগার্করা এখন আলোচনা করছে, কোন পরিস্থিতিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার বিজয় হতে পারে। তাদের মতে, যেকোনো বড় সফল আক্রমণই যথেষ্ট হবে। তাহলে এ ধরনের বিজয় পুতিনকে সন্তুষ্ট করবে এবং ইউক্রেনের আরও অঞ্চল মুক্ত করার ইচ্ছা ভঙ্গ করবে (ইউক্রেনের কয়েকটি অঞ্চল দখল করে রেখেছে রাশিয়া)।

রাশিয়ান অলিগার্করা মনে করছে, আক্রমণের সম্ভাব্য লক্ষ্য হওয়া উচিত ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভ। খারকিভের উপর সর্বাত্মক হামলা হবে ভয়াবহ। ১৯১৯ থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত ইউক্রেনের রাজধানী শহরটি যুদ্ধ শুরুর আগে ইউক্রেনীয় ও রাশিয়ান সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও শিক্ষার একটি প্রাণবন্ত কেন্দ্র ছিল। যদি রাশিয়া এটি নেওয়ার চেষ্টা করে, খারকিভ তার অবশিষ্ট অবকাঠামোর প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংসের অভিজ্ঞতা অর্জন করবে, যার ফলে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। কারণ ইতিমধ্যে স্বল্প প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলি (জন্মনিরোধক সরঞ্জাম ইত্যাদি) বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছে সেখানে। এই লোকদের তখন রাশিয়ার দখলে টিকে থাকতে হবে।

মস্কোর অনেকেই এখন বিশ্বাস করেন, এবার রাশিয়ান সামরিক শক্তি বৃদ্ধি পাওয়া এবং ইউক্রেনের মজুদ দুর্বল হওয়ায় রাশিয়া জিততে পারে। রাশিয়ান অভিজাতদের দৃষ্টিতে, ইউক্রেনীয়রা আরেকটি দৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে অক্ষম, কারণ তারা এখন খুব ক্লান্ত।

এই যুদ্ধ কি শেষ হবে?

রাশিয়ান অভিজাতরা এখন যা নিয়ে বেশি আলোচনা করছে তা হল, কীভাবে এই যুদ্ধ শেষ হতে পারে। 

তাদের সামনে বিভিন্ন উত্তর আছে। কেউ কেউ মনে করেন, যুদ্ধক্ষেত্রে একটি বড় জয় হয়েছে। তাই যুদ্ধ থামিয়ে দেওয়া যায়। অন্য অনেকে মনে করেন, পুতিন কিয়েভের সব পথ বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত থামবেন না। কেউ কেউ নিশ্চিত যে, পুতিনের কাছে প্রকৃতপক্ষে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হল পশ্চিমের সাথে সংঘর্ষ, ইউক্রেনে বিজয় নয়, এবং বর্তমান সংঘাতের সাথে যা-ই ঘটুক না কেন, পুতিন একইভাবে ইউরোপের অন্য একটি রাষ্ট্রে আক্রমণ করবেন। অনেকে আবার মনে করেন, যেহেতু যুদ্ধটি পুতিনের রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য উপযুক্ত, তাই তিনি যত দিন বেঁচে থাকবেন তত দিন লড়াই চালিয়ে যাবেন।

পুতিন সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে এমন একজন ব্যবসায়ী আমাকে বলেছেন, পুতিন ইউক্রেনের উত্তর-পূর্বে জয়ী হয়ে সন্তুষ্ট হবেন না। একমাত্র ফলাফল হিসেবে পুতিন মেনে নেবেন কিয়েভ দখল করে। পুতিন ইউক্রেনের রাজধানীর সাথে একটি বিশেষ, প্রায় রহস্যময় সংযোগ স্থাপন করেছেন, যাকে তিনি (পুতিন) রাশিয়ান সভ্যতার দোলনা হিসাবে দেখেন। কিয়েভ-পেচেরস্ক লাভরার প্রতি পুতিনের একটি বিশেষ অনুরাগ রয়েছে।

‘কিয়েভ-পেচেরস্ক লাভরা’ হচ্ছে একটি পুরনো অর্থোডক্স মঠ যেখানে পুতিন ২০১৩ সালে সরকারি সফরে গিয়ে প্রায় পুরোটা সময় কাটিয়েছিলেন। লাভরা হচ্ছে বেশ কিছু সম্মানিত রাশিয়ান সাধু ও ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের বিশ্রাম-স্থান, সাম্রাজ্যিক রাশিয়ান প্রধানমন্ত্রী পিওত্র স্টোলিপিনও সেই ব্যক্তিত্বের তালিকায় আছেন। স্টোলিপিনকে পুতিন গভীরভাবে প্রশংসা করেন। পুতিন এমনকি স্টোলিপিনের একটি মূর্তিও বানিয়েছেন যা এখনও ক্রেমলিনের কাছে দাঁড়িয়ে আছে।

এই ব্যবসায়ী বলছেন, লাভরা সংরক্ষণে পুতিনের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে তা বোঝা যায় এই ব্যাখ্যা থেকে: রাশিয়া ইউক্রেনের অন্য শহরগুলির মতো কিয়েভে ভারী বোমা ফেলেনি। রাশিয়ার নতুন প্রতিরক্ষামন্ত্রী আন্দ্রেই বেলোসভ, যিনি গভীরভাবে ধার্মিক, তারও লাভরার সঙ্গে গভীর সখ্য রয়েছে।

সেই লাভরা তথা কিয়েভের সঙ্গে রাশিয়ার স্থায়ী সংযোগ (সহজ কথায় দখল) স্থাপনের স্বপ্ন রয়েছে পুতিনের, যা সহসা সম্ভব নয়।

(দ্য ফরেন অ্যাফেয়ার্স ডটকম থেকে সংক্ষেপিত)

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন