২০১৯ সালে ১২ আগস্ট চীনের ইউনান প্রদেশের স্বায়ত্তশাসিত কাউন্টির একটি মসজিদে সকালের নামাজে এক শিশু। ছবি: ফরেন পলিসি
চলতি বছরে ১৫ মার্চ পবিত্র রমজান মাসের তৃতীয় দিনে চীনের ইউনান প্রদেশের ইউক্সিতে শহর বসবাসকারী মুসলমানরা হঠাৎ তাদের উইচ্যাট থ্রেডে একটি অস্বাভাবিক বার্তা পান। চীনের প্রিফেকচারাল ব্যুরো অব এথনিক অ্যান্ড রিলিজিয়াস অ্যাফেয়ার্স থেকে ওই ‘জরুরি পাবলিক নোটিশ’ জারি করা হয়। বার্তাটিতে রমজানে শহরটিতে বসবাসকারীদের স্কুল শিক্ষার্থীদের উপবাসের উপর নজরদারির অনুমোদন দেওয়া হয়।
নোটিশে বলা হয়, রমজানে উপবাসসহ অন্যান্য ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে অপ্রাপ্তবয়স্কদের অংশগ্রহণের বিষয়টি পার্টি কমিটি, সরকার, শিক্ষা এবং সব স্তরের ক্রীড়া ব্যুরোগণের তদন্ত করা উচিত। এছাড়াও নোটিশে শিক্ষা এবং ধর্মের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার নীতির তাগিদে এবং শিক্ষক, ছাত্র এবং অধিকাংশ তরুণদের শিক্ষা নির্দেশিকাকে শক্তিশালী করতে এসব বিস্তৃতভাবে মেনে চলতে বলা হয়।
ইউক্সিতে রাষ্ট্র-স্বীকৃত হুই নামে মুসলিম জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্যের বসবাস। এরা সিল্ক রোড আমলের আরব এবং পারস্য ব্যবসায়ীদের বংশধর। তারা মান্দারিন ভাষায় কথা বলে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ হানদের থেকে তাদের জাতিগতভাবে আলাদা করা যায় না। আত্তীকরণের এই দীর্ঘ ইতিহাস সত্ত্বেও, আজ তারা দেশব্যাপী চীনাকরণের কর্মসূচির কেন্দ্রবিন্দুতে নিজেদেরকে দেখতে পাচ্ছেন। ২০১৬ সালের এপ্রিলে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ধর্মীয় কাজের ওপর গঠিত ফোরামের পরিপ্রেক্ষিতে এই চীনাকরণ শুরু হয়েছিল। ফোরাম চলাকালীন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলিকে কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) নেতৃত্বকে এবং ‘চীনা সংস্কৃতির সঙ্গে (নিজেদের ধর্মীয় মতবাদগুলো) একীভূত করা মেনে নিতে নির্দেশ দেন।
জাতীয় পুনরুজ্জীবনের শির বহুদিনের স্বপ্নে সোভিয়েত সময়ের সাংস্কৃতিক বিশেষত্বের জন্য খুব একটা পাত্তা নাই। সেসময় সংখ্যালঘুদের রীতিনীতি এবং ভাষাগুলি স্বীকৃত ছিল। বরং বর্তমানে আধুনিক সিসিপি ক্রমবর্ধমানভাবে সব জাতিগত সংখ্যালঘুদেরকে একক পরিচয়ে নিতে চাচ্ছে এবং তাকে হান চীনা সংস্কৃতি দিয়ে সংজ্ঞায়িত করার প্রচার চালাচ্ছে।
এখন পর্যন্ত চীনের এই কর্মসূচির মূলে আছে খাবারে আরবি ভাষায় লেখা হালালের বার্তা বা চিহ্নগুলি অপসারণ এবং মসজিদগুলির ‘বিদেশি স্থাপত্য’ সংশোধন করা। এই কাজগুলোকে চীনা কর্তৃপক্ষ হুই গোষ্ঠীরে মধ্যে তথাকথিত ‘সৌদিকরণ এবং আরবকরণ’ প্রবণতাকে রোধে ন্যায়সঙ্গত বলে মনে করে। তাই এখন অধিকাংশ মসজিদ থেকে গম্বুজ এবং মিনার ছেটে ফেলা হয়েছে। ইউক্সির ওই নোটিশ সেই কর্মসূচির আরও বেশি কঠোরতাকে সামনে নিয়ে আসে: যেখানে ধর্ম এবং শিক্ষার মধ্যে বিচ্ছিন্নতার নামে হুই মুসলিম যুবকদের মানসিক ও আচরণগত অবস্থা সংরক্ষণ করে।
হুইদের উপর এখন যে কৌশলগুলি ব্যবহার করা হচ্ছে বেইজিং প্রথমে তা উইঘুর এবং জিনজিয়াংয়ের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বসবাসকারী অন্যান্য তুর্কি মুসলিম সংখ্যালঘুদের উপর ব্যবহার করেছিল। গত এক দশকে এই অঞ্চলে অভূতপূর্ব নিরাপত্তাকরণ দেশটিকে একটি উচ্চ-প্রযুক্তিগত নজরদারি রাষ্ট্রের বিকাশের দিকে নিয়ে গেছে। যেখানে কার্যত মুসলিম আচরণের প্রতিটি দিক পর্যবেক্ষণ করে। ফাঁস হওয়া পুলিশ ফাইলগুলিতে দেখা যায় যে, রমজানে রোজা রাখা, মাথার স্কার্ফ পরা বা কোরআন তেলাওয়াতের জন্য লোকজনকে গণহারে বন্দি করা হচ্ছে। বেইজিংয়ের দাবি ‘জনগণের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ নামে অভিহিত করা এই পদক্ষেপগুলি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এবং জিনজিয়াংকে পুরো চীনের সঙ্গে একীভূত করতে কার্যকর।
ইউক্সির ওই নোটিশে থেকে বুঝা যায়, ‘মডেল মুসলিম সংখ্যালঘু’র প্রতি চীনের আচরণ ক্রমশ জিনজিয়াংয়ে করা আচরণে পরিণত হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা যায়, জিনজিয়াং জুড়ে প্রতি কয়েকশ ফুট পর পর পরস্পরের আচরণ পর্যবেক্ষণের জন্য তথাকথিত ‘সুবিধাজনক পুলিশ স্টেশন’ স্থাপন করা হয়েছে। এখন সেগুলো প্রতিবেশী গানসু এবং কিংহাই প্রদেশেও ছড়িয়ে পড়ছে।
খুব বেশিদিন আগে নয়,২০১৫ সালের রমজানে জিনজিয়াংয়ে সেই কুখ্যাত ‘তরমুজের ঘটনা’ ঘটেছিল। যেখানে মেডিসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা মুসলমানদের রোজার সময় দিনের বেলায় ছাত্রদের হাতে তরমুজের টুকরো তুলে দিয়েছিলেন। যারা তরমুজ প্রত্যাখ্যান করেছিল তাদের ডিপ্লোমা না দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এই ঘটনায় তুরস্কে সহিংস বিক্ষোভ হয়। পরে বেইজিংয়ের উপর এত বেশি কূটনৈতিক চাপ তৈরি হয় যে জিনজিয়াং পার্টির প্রধান ঝাং চুনশিয়ান স্থানীয় মুসলিম প্রতিনিধিদের সঙ্গে রমজানের শেষ দিন উদযাপনের জন্য একটি ইফতারের যোগ দেন। ঘটনাটি আধুনিক জিনজিয়াংয়ের ইতিহাসে প্রথম কোনো অনুষ্ঠান।
বৈশ্বিক প্রতিবাদের পাশাপাশি আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়াও ছিল নজিরবিহীন। কিন্তু হুই যখন তরমুজের ঘটনার মতোই কোনো ঘটনার গল্প শুনতে পায়, তখন তারা মনে করে, তরমুজ ঘটনা যেমন উইঘুরদের মধ্যে নিবিড় নজরদারি ব্যবস্থার পূর্ব ঘটনা ছিল, হুইদের এখানেও আত্তীয়করণের নামে তাই ঘটবে।
চীন সংবিধানে ধর্মীয় বিশ্বাসের স্বাধীনতার বজায় রেখেছে দাবি করলেও দেশটিতে সংগঠিত ধর্ম অত্যন্ত সীমিত। ইসলাম ধর্মকে বিশেষ কঠোরতায় দেখা হয় : জিনজিয়াংয়ে মুসলিমদের জানাজা বা কবর সংক্রান্ত বিষয়াদি পরিচালনা করা নিষিদ্ধ। অথচ দাওবাদী ক্ষেত্রে চীন জুড়ে মৃতদের যথাযথ বিদায় দেওয়ার জন্য অর্থ পর্যন্ত দেওয়া হয়। হান বাবা-মা এবং বাচ্চারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় সাফল্যের জন্য প্রার্থনার জন্য বৌদ্ধ এবং কনফুসিয়ান মন্দিরে ঢল নামাতে পারে।কিন্তু হুই শিশুদের ধর্ম বিষয়ে পড়তে বাধা দেওয়া হয়। 2016 সালে, উদাহরণ স্বরূপ, গানসু প্রদেশের নার্সারি স্কুলে ইসলাম শেখানো নিষিদ্ধ করা হয়েছিল একটি কিন্ডারগার্টেন মেয়ের কুরআন তেলাওয়াতের ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ার পর। কর্তৃপক্ষ বলেছে যে অনুশীলনটি "ধর্ম এবং শিক্ষার মধ্যে পৃথকীকরণের নীতি" লঙ্ঘন করে। হেনান, নিংজিয়া এবং ইউনানে হুই-চালিত শিশু যত্ন কেন্দ্র এবং ধর্মীয় বিদ্যালয়গুলি বন্ধ করার জন্য একই কারণ উল্লেখ করা হয়েছিল।
সংখ্যালঘু শিশুদের তাদের বাবা-মায়ের বিশ্বাস ও সংস্কৃতি থেকে আলাদা করার সরকারি প্রচেষ্টার সর্বশেষ লক্ষ্য হলো হুই শিশুরা। চীনের ভেতরের মঙ্গোলিয়া স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের যুবকদের তাদের ভাষা এবং ইতিহাস শেখা নিষিদ্ধ করা হয়েছ। অথচ তিব্বতের শিশুদের তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে এবং মান্দারিন শেখার জন্য তাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে বোর্ডিং স্কুলে পাঠানো হচ্ছে। জিনজিয়াংয়ের উইঘুরে অভিভাবকদের বন্দিদশায় রেখে এবং তাদের বন্দি শিশুদে ‘এতিম’ অবস্থায় চীনা হওয়ার অর্থ কী তা বোঝানোর জন্য স্কুলে বা তথাকথিত কল্যাণ কেন্দ্রে পাঠানো হয়।
আজ শিশুদের মধ্যে ইসলামের ব্যাপক খবরদারি করা হয়। শিশুদের ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়া থেকে বিরত রাখা হয়েছে এবং মাদ্রাসাগুলিকে আর পড়ানোর অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। ইসলামিক পাঠ্যক্রমকে ধর্মনিরপেক্ষ করার জন্য হান শিক্ষকদের মাদ্রাসায় আনা হচ্ছে। এর মাধ্যমে মাদ্রাসাগুলোকে কঠোর নজরদারিতে রাখা হয়েছে বলে মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকরা বলছে।
রুসলান ইউসুপভ, কর্নেল ইউনিভার্সিটির সোসাইটি ফর দ্য হিউম্যানিটিজ-এর পোস্টডক্টরাল ফেলো। ফরেন পলিসিতে প্রকাশিত নিবন্ধের সংক্ষেপিত অনুবাদ।