Logo
Logo
×

অভিমত

নানা সেক্টরের ক্ষোভকে কি রাজনীতিকরণ করতে পারবে বিরোধী দল?

Icon

আহমেদ খিজির

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৪, ০৮:৫৯ পিএম

নানা সেক্টরের ক্ষোভকে কি রাজনীতিকরণ করতে পারবে বিরোধী দল?

বাংলাদেশের অন্যতম প্রথিতযশা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান তাঁর সুলিখিত “পাকিস্তান ফেইলিওর ইন ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন’ বইয়ে দেখান যে, পাকিস্তান ভেঙে বাঙালিদের আলাদা রাষ্ট্র পাওয়ার পেছনে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল নব্য শিক্ষিত শ্রেণির চাকরি-বাকরিতে সুযোগ-সুবিধা না পাওয়া এবং বৈষম্য। এই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে রাজনীতিবিদরা একে জাতীয়তবাদী ইস্যুতে রুপান্তর করেন এবং দেশের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেন। 

আওয়ামী লীগের বয়ানে মুক্তিযুদ্ধ ব্যাপারটা বায়বীয় চেতনার হলেও, এর পিছনে মূল কারণ ছিল বাস্তব চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষা। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের এই জীবনমুখী চাহিদা ও রাজনীতি কোনো অর্থে দোষেরও না। গণমানুষ স্বার্থ থাকলেই রাজনীতির মাঠে সোচ্চার হয়, কেবল নীতি আদর্শের বুলি দিয়ে তা হয় না। এমনকি ঘোরতর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও তাই হয়। রাজনীতিবিদরা যদি জনগণের স্বার্থরক্ষার বিন্দুতে মিলিত হতে পারেন তবেই আন্দোলন দানা বাঁধে। এদেশে আইয়ুব বা এরশাদবিরোধী আন্দোলন হোক বা বিশ্ব ইতিহাসের উদাহরণগুলো হোক, সবই হরেদরে সমান। 

কথাগুলো মনে হলো সার্বজনীন পেনশন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উষ্মা দেখে। সরকার সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করে ২০২৩ সালের আগস্টে, সেসময় এই নিয়ে শিক্ষকদের প্রতিবাদ তো ছিলই না, কোনো কোনো সরকারদলীয় শিক্ষক যথারীতি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। কিন্তু, যখনই সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে, তখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিগুলো প্রতিবাদী হয়ে উঠছে। ১ জুলাই থেকে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন কর্মবিরতিতে যাওয়ার কর্মসূচি দিয়েছে। 

প্রশ্ন উঠতে পারে, শিক্ষকদের জাতির বিবেক বলা হলেও উনারা তো কেবল নিজেদের স্বার্থে আঘাত লাগাতেই সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। এখন তাঁরা সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন। অভিযোগটা সত্য হলেও, রাজনীতির সমীকরণ এমন এক ব্যাপার, যেখানে নানারকম ক্ষুব্ধ গোষ্ঠীকে জোটবদ্ধ করাই রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তির কাজ। যুগে যুগে যুদ্ধ বা আন্দোলনের কৌশলে তাই দেখা গেছে। কেবল নীতি আর বায়বীয় আবেগ দিয়ে আন্দোলন হয় না। মুক্তিযুদ্ধের কথাও যদি বলা হয়, সেখানে নানা মতের, নানা পথের, সাধু থেকে তস্কর পর্যন্ত এক হয়েছিল বলেই সাফল্য এসেছিল। এরশাদ বিরোধী আন্দোলন বা অন্য বড় রাজনৈতিক সাফল্যেও তাই। 

ফলে, বিরোধী দলগুলোর উচিত যে কোনোভাবে এই ক্ষোভকে রাজনীতিকরণ করা। শিক্ষকদের একটা বড় অংশই সরকারের সুবিধাভোগী, পদলেহীও। কিন্তু, তাঁদের এই ক্ষোভকে সরকার বিরোধিতায় পরিণত করাটাই রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। একইভাবে, যেসব চাকরিপ্রত্যাশী ছাত্ররা কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে তাঁদেরকেও সমর্থন দেওয়া দরকার। দ্রব্যমূল্য নিয়ে জনগণের অসন্তোষ বাড়ছে, আমজনতা তো বটেই, ব্যবসায়ীরাও অর্থনৈতিক মন্দা আর লুটপাটে বেদিশা। শুধু অসীম ক্ষোভে গণতন্ত্র ফিরবে না, এর জন্য দরকার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, জোটবদ্ধ করার কৌশল ও পরিকল্পনা। 

প্রশ্ন আসতে পারে, এই সরকার তো অত্যাচার আর নিপীড়নের নতুন রেকর্ড করছে। কীভাবে সম্ভব এদের রুখে দাঁড়ানো। ইতিহাস শেখায় যে, সংগঠিত জনতার শক্তির চেয়ে কিছুই শক্তিশালী না। আর রাজনীতিবিদরা যেহেতু ক্ষমতার পালাবদলে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পান, ঝুঁকিটাও তাঁদেরই নিতে হবে। 

এমনকি তথাকথিত শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে এখন বিপুল সমালোচনা ও ক্ষোভ থাকলেও আমাদের মনে রাখতে হবে, সেখানে বেশিরভাগ মানুষ জড়ো হয়েছিলেন সরকার আঁতাত করেছে এই অভিযোগে। তবে, জনতা যখন দেখলো সেই মঞ্চ সরকারপন্থীদের দখলে, তাঁরা সরে গেলো। কিন্তু সরকারবিরোধী শক্তিরা সেই জন্য তাঁকে, সেই ক্ষোভকে কোনোভাবেই একত্রিত করতে পারলেন না। রাজনীতি আদর্শের বুলি দিয়ে হয় না, মাঠ ও জনতার ক্ষোভের দখল না রাখা এখানে ব্যর্থতা। 

ফলে, গণতন্ত্রের উদ্ধারে যেসব বিরোধী দল মরিয়া, তাঁদের কৌশল নিতে হবে, নানারকম বঞ্চনা ও অন্যায়ের শিকার হওয়া ক্ষুব্ধ গোষ্ঠীগুলোকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। মঙ্গোলিয়ার বিরূপ পরিবেশে নানারকম বিবাদে থাকা বহুগোত্রকে একজোট করে চেঙ্গিস খান এমন এক বাহিনী তৈরি করেছিলেন, যারা দুনিয়ার ঐ রুক্ষ প্রান্ত থেকে দুনিয়ার অনেকটাই দখলে নিয়েছিলো। ইতিহাসে চেঙ্গিসকে দারুণ দক্ষ, আগ্রাসী ঘোড়াসওয়ারদের এক ভয়ংকর বাহিনীর নেতা বলা হলেও, সেই অভাবনীয় সাফল্যের পিছনে ছিল, পরস্পর বিরোধী গোত্রদের বৃহৎ স্বার্থে এককাট্টা করতে পারার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা। 

আর বাংলাদেশ তো ছোট একটা দেশ। এই দেশের মানুষের পরস্পরের মধ্যেও বৈচিত্র্য তো একে অনেক কম, তায় এই জনপদের আছে বড় বড় আন্দোলনের ইতিহাস। এখানে শত ক্ষোভের বৈচিত্র্যময় ফুল দিয়ে মালা গাঁথার রাজনৈতিক গৌরব খুব কঠিন কিছু নয়। 

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন