ছবি: সংগৃহীত
‘হাজার টাকার বাগান খাইলো দশ টাকার ছাগলে’, অবস্থাটা এমনই, এই প্রবচনের মতন। ছাগলকাণ্ডের রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর বিষয়ে গণমাধ্যমগুলো সরব। সরব তার দুই স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে। কোনো খবরের অনুসন্ধান তো তাদের অপরাধের পোস্টমর্টেম করতে গিয়ে বিশাল কিছু ব্যাপার আবিষ্কার করে ফেলেছে। যেমন, মতিউর ছাত্র জীবনে শিবির করতেন, তার উত্থান বিএনপির আমলে। কী বিশাল আবিষ্কার! কী ভয়াবহ অনুসন্ধান! বিএনপি জোট ক্ষমতা হারিয়েছে সেই কবে যা মানুষ প্রায় ভুলতে বসেছে। আজকে যারা এসএসসি বা এইচএসসি দিচ্ছে, সেই তরুণরা জানেই না বিএনপির ক্ষমতাকাল কেমন ছিলো। অথচ ততদিনে মতিউরের সম্পদ পাহাড় সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং ধর্মের কল বাতাসে নড়ার আগেও সে বহাল তবিয়তে রাজত্ব চালিয়েছে। এখন তার দুর্নীতির পোস্টমর্টেম না করে, কার বা কাদের মদতে সে এতটা কর্মযজ্ঞ করার সুযোগ পেয়েছে তার আলাপ না তুলে, কবে বিএনপি ক্ষমতায় ছিলো, সেই সময়ে তার উত্থান ঘটেছে এমন গল্প হাজির করা হয়েছে খবরের অনুসন্ধানে! বলিহারি সেই অনুসন্ধানকে।
যে অনুসন্ধানীরা এত বছর আগের উত্থান চিত্র বের করতে পারে, সেই তারা গত এক দশকের অনুসন্ধানে ব্যর্থ কেন? না, এই প্রশ্ন করা যাবে না, করলেই কেলো। তবে এ ব্যাপারে একটি ‘জোক’ মনে পড়ে গেলো। স্ত্রীর হাত লেগে একটি দামি ফুলদানি পড়ে গিয়ে ভেঙে গেলো। তখন স্ত্রী আবিষ্কার করলেন, তার স্বামী তিন বছর আগে ভুল জায়গায় ফুলদানিটি রেখেছিলেন বলেই, আজ তার হাত লেগে সেটা পড়ে গিয়ে ভেঙে গেছে। ফুলদানি ভাঙলেন স্ত্রী, দোষ হলো স্বামীর। আবিষ্কার হলো, তিন বছর আগের ভুল জায়গায় রাখার কাহিনী। এমন অনুসন্ধানের অবস্থাও ঠিক তাই।
রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকী। আওয়ামী লীগের নেত্রী এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান। অঢেল সম্পদের মালিক। যার হিসেব করা আমাদের মতন ছা-পোষাদের দুঃসাধ্য। কিন্তু আবিষ্কার হলো, তার নানা বা দাদা রাজাকার এবং তার আত্মীয়-স্বজন সব বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত। অথচ তার সাথে এ কথা বলা হলো না যে, বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত তার আত্মীয়রা কেন লায়লা কানিজ লাকীর মতন অঢেল সম্পদের মালিক হলেন না? তাহলে কী আত্মীয়-স্বজনের ধারার বাইরে রাজনীতি করেন বলেই লাকী এতটা অঢেল সম্পদের মালিক? প্রশ্নগুলো সঙ্গত ছিলো, কিন্তু যাদের করার কথা তারা তা করতে ভুলে গেছেন। শুধু মনে আছে, লাকি’র আত্মীয়-স্বজন বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত সে কথাটুকুই।
চুরি-বাটপারি-লুটতরাজ লুকানোর এই যে অদ্ভুত চেষ্টা। দুর্নীতিবাজদের দুর্নীতি আড়াল করার জন্য কিংবা কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের ইমেজ রক্ষার্থে অন্যকে দোষারোপের যে চেষ্টা, সে চেষ্টার কারণেই আজ দেশে দুর্নীতি মহীরুহ হয়ে উঠেছে। আগেও দেখেছি, দুর্নীতি হতে দেখলেই, সে আগে কোন দল করতো, কোন রাজনীতির সাথে তার পরিবার যুক্ত ছিলো এসব এক্সপোজ করার মাধ্যমে তাদের দুর্নীতিকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করেছে অনেক গণমাধ্যম। অথচ তাদের উচিত চিলো দায়িত্বশীলদের কাছে দুর্নীতির চিত্রটা পরিষ্কার করা, যাতে তারা তা রোধ করতে পারে। কিন্তু করেছে উল্টো কাজ। যার ফলেই দুর্নীতির লাগাম টানা সম্ভব হয়নি, বরং দুর্নীতিবাজরা নিশ্চিন্তে তাদের কাজ করে গেছে। এখন কিন্তু তাদেরই শুনতে হচ্ছে সময়কালে খবর না করার অপারগতার খোঁটা। এই গণমাধ্যমগুলো আরেকটু পেছনের উদাহরণ টানতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা দেখেনি, একসময়ের মুসলিম লীগের রাজনীতি করা অনেকেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন! মুসলিম লীগ থেকে এসে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়েছেন। সেসময় আওয়ামী লীগের রাজনীতি করা অনেকের পরিবারের সদস্যরাই মুসলিম লীগের সাথে জড়িত ছিলেন। এখনো অনেক আওয়ামী লীগের আত্মীয় বিএনপির সাথে জড়িত, অনেক বিএনপি নেতা-কর্মীর আত্মীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন। কিন্তু কেউ যদি দুর্নীতি করে তাহলে তার দুর্নীতিকে জাস্টিফাই করার জন্য বিপরীত পরিচয় টেনে আনাটা অসততা্। শুধু অসততা নয়, দুর্নীতিকে এভাবে লিবারাইজ করার চেষ্টা একটা নৈতিক অপরাধও।
ক্যাসিনো কাণ্ডের হোতারা যখন ধরা পড়তে লাগলো, তখনও দেখেছি ভুলে যাওয়া কালের রাজনৈতিক পরিচয় তুলে এনে ক্যাসিনো নামক জুয়ার অপরাধকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা। যেন তারা সেই বিএনপির ক্ষমতায় থাকার সময় জুয়ার টাকা উপার্জন করে লুকিয়ে রেখেছিলো। রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর বিএনপির সময়, অর্থাৎ গণমাধ্যমের ভাষায় তার উত্থানকালেই এই সম্পদ বানিয়েছেন। আর এই দেড় দশকে তারা ছিলেন ধোয়া তুলশী পাতা। যা পাপ করেছেন বিএনপির সময়ই। কী অদ্ভুত যুক্তি! কী আশ্চর্য মেধা! এমনসব মেধাবীরা গত দেড় দশকে আমাদের বিভিন্ন মাধ্যমে যুক্ত হয়েছেন। যাদের শুধু চোর গেলে বুদ্ধি বাড়ে। আর চোরের খোঁজ জানলেও চোরের ভয়ে তা প্রকাশ করতে পারেন না। ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের বক্তব্যে অন্তত তাই মনে হয়েছে।
মতিউর কাণ্ডকে কেন্দ্র করে সাহিত্যিক সাংবাদিক মাহবুব মোর্শেদ সামাজিকমাধ্যমে ‘দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আসিবার পূর্বেই সে দেশ ছাড়িয়া চলিয়া গেল’ এই কথা ইংরেজিতে অনুবাদ করতে বলেছেন। এই স্যাটায়ারের মানে বোঝার চেষ্টা করুন। অনুসন্ধান করুন কেন কীভাবে নিষেধাজ্ঞার আগেই দুর্নীতিবাজরা দেশ ছেড়ে চলে যান। এটাই মূলত দায়িত্ব। কিন্তু তা না করে, একটি রেখার পাশে, আরেকটি রেখা টেনে দুটো রেখাকে সমান করার চেষ্টা একেবারেই অসঙ্গত এবং যুক্তিহীন।
এই যুক্তিহীনতাই আজকে দেশের অর্থনীতিকে এই অবস্থায় টেনে এনেছে। একটা দেশের মোট টাকার চেয়ে ঋণের পরিমাণ বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটা দেশের অর্থনীতি খাদের কিনারায় পৌঁছে গেছে। পাচার হয়ে গেছে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা। রিজার্ভ নিয়ে কথা হচ্ছে। যার ফলেই তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে ডলার সংকটের। টাকার দরপতন ঘটেছে। ব্যাংকগুলো ধুঁকছে। খবরে দেখলাম, পাঁচটি ব্যাংকের ব্যাপারে তদন্ত করবে আইএমএফ। এক সময় এসব কথা বলাও যেত না। বললে, সেই পুরানো কালের ইতিহাস টেনে এনে, মিথ্যা ও গুজব বলে আখ্যা দিয়ে অর্থনীতির সর্বনাশ ঢেকে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। উল্টো যারা বলেছে তাদের পর্যুদস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। ডেভিড কপালফিল্ডের জাদুর মতন স্মোক-স্ক্রিন সৃষ্টি করে সাময়িক ভাবে দুর্নীতির ট্রেনটাকে লুকিয়ে ফেলা হয়েছে। অথচ যে ট্রেনের লক্ষ্য ছিলো হাজার-লক্ষ কোটি টাকা নিয়ে দেশ ছেড়ে ভেগে যাওয়া। সেই ট্রেনকে এসব ঢেকে রাখার প্রয়াসকারীরাই পার করে দিয়েছে। এখন, সদ্য সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী খোদ বলছেন, দেশ থেকে বছরে ৮১ থেকে ৯২ হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচার হয়ে যায়। সদ্য সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমলাদের একটা অংশ দুর্নীতির সাথে জড়িত হয়ে পড়েছে। সুতরাং, যখন চেরাগ ও চেরাগের দৈত্য দৃশ্যমান, তখন আপনারা খবরে আর কোন টুইস্ট আনবেন, কাকে কাকে আড়াল করার চেষ্টা করবেন!
যাকগে লেখা শেষ করার আগে দেখলাম, রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউরের স্ত্রী, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যন লায়লা কানিজ লাকীর বক্তব্য। লাকী নাকি বলেছেন, বড় বড় সাংবাদিকদের কেনার কথা। তিনি সব কিনে নিয়েছেন। এতে অনেকে রাগ করেছেন। অনেক গণমাধ্যম খবরও করেছে। আমি তো রাগ করার কিছু দেখি না। সাংবাদিকদের যখন কুত্তা পোষার সাথে তুলনা করা হয়েছে, তখন তো রাগ করেননি, বরং হাতে হাত ঘষেছেন। এখন আর রাগ-অভিমান করে লাভ কী, তেলাঞ্জলির কালে তো রাগ ভাঙাতে কেউ আসবে না। আর রাগ অভিমানের পেছনে যুক্তিও তো খুব একটা নেই, নাকি আছে?