সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে গিয়ে বেশকিছু চুক্তি সই করে এসেছেন। গত জানুয়ারি মাসে ভারতের সরাসরি হস্তক্ষেপে আরও একবার ক্ষমতা নিশ্চিত করার পর এই সফরটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ভারতের প্রেক্ষাপট অবশ্য বেশ খানিকটা পরিবর্তিত হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি আবারও ক্ষমতায় আসলেও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাননি। ফলে, তাঁকে প্রথমবারের মতো কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হয়েছে। অন্যদিকে কংগ্রেসেরও পুনরুত্থান ঘটেছে শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে।
অবশ্য, বৈদেশিক নীতিতে ভারতের নীতি সরকার ভেদে তেমন একটা পরিবর্তন হয় না। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকে সুসংহত করতে কংগ্রেসের সরকারও বিজেপির মতোই সমর্থন দিয়েছে। ভারত জানে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার জন্য দেশের স্বার্থ ভারতের কাছে বিকিয়ে দিতে রাজি, এই কারণে সব সরকারই দলটিকে সমর্থন দিয়ে যায়।
এবারও দেখা গেলো, ভারতের স্বার্থে রেলচুক্তি হলো, সামরিক ও সমুদ্রবন্দর নিয়েও কিছু চুক্তি হলো, কিন্তু বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের দাবি নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা বণ্টন, বিশেষত তিস্তা চুক্তি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসা গেলো না।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদী রয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হল তিস্তা। ভারতের পার্বত্য রাজ্য সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশের মধ্যদিয়ে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে এই নদী রংপুর বিভাগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তিস্তা বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহত্তম নদী এবং এর উত্তরাঞ্চলীয় অংশগুলোর জন্য প্রধান নদীও বটে। ফলে তিস্তা কৃষির নিরিখে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এক কোটিরও বেশি মানুষ ও দেশের মোট ফসল উৎপাদনের ১৪ শতাংশ উপকৃত হয় এই তিস্তা নদী থেকেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই নদীর ধারে ভারত যে বাঁধ নির্মাণ করেছে তা উজানের সময় পানির প্রবাহকে বাধা দেয় এবং বাংলাদেশে পানির নিষ্কাশনকে প্রভাবিত করে। তার ফলে ১০০০০০ হেক্টরের বেশি জমির সেচ ব্যাহত হয়। বাংলাদেশ ভারতের কাছে বলে আসছে যে, বাংলাদেশের জন্য ৫০০০ কিউসেক (কিউবিক ফুট প্রতি সেকেন্ড) পানির প্রবাহ প্রয়োজন, যা বাঁধ নির্মাণের আগে দেশে প্রবাহিত ৬৭১০ কিউসেক দ্বারা পর্যাপ্ত পরিমাণে পূরণ করা যেত। অথচ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ তিস্তা থেকে মাত্র ১২০০-১৫০০ কিউসেক পানি পায়, মাঝে মাঝে এমনকি সেই পরিমাণ ২০০-৩০০ কিউসেকেও নেমে যায়। অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে গত বছরের মার্চ মাসে, তিস্তার প্রবাহ বদলের জন্য ভারত আরো দুইটি বাঁধ নির্মাণ করেছে।
অবশ্য ২০২২ সালে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে একটি বহুমুখী ব্যারেজ নির্মাণ এবং তিস্তার কিছু অংশ ড্রেজ ও বাঁধ নির্মাণের জন্য একটি একক ব্যবস্থাপনাযোগ্য চ্যানেল তৈরি করতে কাজ শুরু করে, যেখানে পানির স্তর অনেক বেশি হবে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হিসেবে তিস্তা চিনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাংলাদেশ চিনের এই মহাপ্রকল্পের সদস্য।
তবে, ভারতের এই আশঙ্কার কারণে প্রকল্পটির কাজ স্থগিত হয়ে গিয়েছিল যে, এই প্রকল্পটি কেবল চীনকে তার সীমান্তের ১০০ কিলোমিটারের মধ্যেই এনে দেবে না, বরং তার সংকীর্ণ শিলিগুড়ি করিডোরের কাছেও পৌঁছে দেবে – যা রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল উত্তরপূর্ব অঞ্চলের সঙ্গে ভারতের একমাত্র স্থল সংযোগ।
ভারত সফর শেষে হাসিনার বক্তব্যে এ কথা স্পষ্ট যে, চীনকে আপাতত সে সুযোগ দেবে না ভারত। হাসিনা দাবি করছেন, ভারতই এই সমস্যার সমাধান করবে। কিন্তু, সে বিষয়ে কোনো কার্যকর প্রতিশ্রুতি নেই। ভারতের দীর্ঘদিনের আচরণেও সেইরকম ইঙ্গিত নেই। বরং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির কারণেই এই চুক্তি হচ্ছে না বলে একই সুরে বলছেন হাসিনা আর মোদি। ব্যাপারটা নেহায়েতই অজুহাত। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের চুক্তি হবে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে, আঞ্চলিক নেত্রী মমতাকে রাজি করানোর দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। এই অজুহাত দিয়ে আরেক দেশের ন্যায্য হিস্যা পাওয়া বন্ধ হতে পারে না।
তিস্তার পানির অভাবে বাংলাদেশে সেচের খরচ ও ঝামেলাই কেবল বহুগুণে বাড়েনি, তিস্তার আশেপাশে এখন সেচ দিতে মাটির অনেক গভীর থেকে পানি তুলতে হয়। এইভাবে পানি তুলতে থাকলে একসময় সেই অঞ্চল পানিশূন্য হয়ে পড়বে। দেশের জন্য তা হবে মহাবিপর্যয়। বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে তিস্তাসহ বাংলাদেশ ভারতের যে ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদী আছে তাঁদের ন্যায্য হিস্যা জরুরি।
কিন্তু, ভারতকে অকাতরে সব দিলেও আমাদের ন্যায্য পানি পাওয়ার কোনো আশা দেখা যাচ্ছে না।