সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে গিয়ে বেশকিছু চুক্তি করে এসেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি চুক্তি হচ্ছে, বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারতের ট্রেন চলাচল। এর আগেও ভারতের ট্রেন বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যেতো কিন্তু তা সরাসরি যেতে পারতো না। সীমান্তে এসে ট্রেনগুলো বাংলাদেশের চালক তথা কর্তৃপক্ষের আওতায় থাকতো ভারতের অপর সীমান্ত পর্যন্ত যাওয়া পর্যন্ত। অর্থাৎ, প্রতিবেশী দেশকে সুবিধা দিলেও নিজ দেশে নিয়ন্ত্রণটা বাংলাদেশেরই থাকতো। এখন আর তা থাকবে না।
প্রধানমন্ত্রীসহ এই চুক্তির পক্ষের লোকেরা দাবি করছেন, কানেকটিভিটির স্বার্থে এই চুক্তি করা হচ্ছে। এতে বাংলাদেশের মানুষের লাভ হবে। তাঁরা সহজে ভারতে আসা যাওয়া করতে পারবে এবং ব্যাবসা বাণিজ্য করতে পারবে। এই ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী ইউরোপের উদাহরণও টানেন।
প্রথমত, ইউরোপের সঙ্গে তুলনাটা একেবারেই যায় না। কারণ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো অভিন্ন আইনের আওতায় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। এতে সব দেশই পারস্পরিক সার্বভৌমত্বকে শ্রদ্ধা করে একে অপরের সুবিধা ব্যবহার করে। এমনকি এদের মুদ্রাও এক। কিন্তু, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের ট্রেন চললেও ভারতের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের ট্রেন কিন্তু চলতে দিবে না। স্পষ্টতই দুইটা দেশের মর্যাদা যে এক নয় তা এইখানে স্পষ্ট।
দ্বিতীয়ত, নামে ট্রানজিট হলেও ভারত যে করিডোর সুবিধা পাবে তা কেবল তাঁদের স্বার্থেই। এর মাধ্যমে এতোদিন তাঁরা সহজেই উত্তর পূর্বের সাতটি রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে। এইসব এলাকা দিয়ে বাংলাদেশের তুলনামূলক যোগাযোগ কম, কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ২৩টি স্থলবন্দর আছে। আর এই অঞ্চলের রেলের অবকাঠামোও বাংলাদেশে বেশি নাজুক।
ভারতীয় ভারী ভারী মালগাড়িগুলো অবস্থা আরও খারাপ করবে। সম্ভাবনা আছে এই অবকাঠামো নির্মাণে ভারত ঋণ দেবে, কিন্তু এই ভারতের স্বার্থে করা প্রকল্পের এই ঋণ শোধ করতে হবে বাংলাদেশিদেরই, যাদের এই প্রকল্পে তেমন ফায়দা নেই। অন্যদিকে, বাংলাদেশ যদি শিলিগুড়ি করিডোর দিয়ে নেপাল ও ভূটানের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে পারতো তবে কিছু লাভ হতো। কিন্তু, ভারত তাও দেবে না। তাঁরা বলছে ভূটানের রেল অবকাঠামো নির্মাণ হলে তবে তাঁরা এই বিষয়ে চিন্তা করতে পারে। আবারো, বুঝিয়ে দেওয়া যে, বাংলাদেশ থেকে তাঁরা কেবল নেবেই, দেবে না।
তৃতীয়ত, সম্ভবত সবচেয়ে ভয়ের বিষয় হচ্ছে ভবিষ্যতে চীনের রোষের শিকার হওয়া। ১৬ জুন টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক খবর থেকে দেখা যাচ্ছে, ১৪টি নতুন রুটের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করা হবে, যার দৈর্ঘ্য হবে ৮৬১ কিলোমিটার। টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখেছে, ভারতের সামরিক ও বেসামরিক পণ্য পরিবহনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘চিকেন নেক’ রেলপথ নিয়ে ২০১৭ সালে দোকলাম অঞ্চল ঘিরে ভারত ও চীনের মধ্যকার বিরোধে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল ভারত।
কারণ, চিকেন নেক করিডোর এই বিরোধপূর্ণ অঞ্চলের কাছেই অবস্থিত। এই কারণেই উত্তরপূর্ব ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে চিকেন নেক করিডোরের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করার জন্য বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বিকল্প রেল নেটওয়ার্ক তৈরি করবে ভারত। (নিউ রেললাইনস ফর নর্থ ইস্ট ভায়া বাংলাদেশ টু বাইপাস ‘চিকেনস নেক’, টাইমস অব ইন্ডিয়া, ১৬ জুন, ২০২৪)”। এই করিডোর দিয়ে ভারত সামরিক মালামাল ও সেনা পরিবহন করবে।
ফলত, কোনো কারণে যদি ভারতের সঙ্গে চীনের বিবাদ বাঁধে তাঁর জের টানতে হবে বাংলাদেশকেও। রাজায় রাজায় যুদ্ধ করবে আর প্রাণ যাবে উলুখাগড়ার। এছাড়াও, সেভেন সিস্টার্সে বিদ্রোহ দমন করতে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতীয় সেনা পরিবহন করায় বিদ্রোহীরাও বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকাকে লক্ষ্যবস্তু বানাতে পারে।
সব মিলিয়ে এক রেল চুক্তিই বাংলাদেশকে নানাদিকদিয়ে মহাবিপদে ফেলতে পারে। আর সার্বভৌমত্ব তো বিকিয়ে দেয়াই হলো। নানা তরিকায় ক্ষমতায় থাকার জন্য দেশ ও দেশের মানুষকে সর্বনাশ করার আরো উদাহরণ তৈরি হলো।