Logo
Logo
×

অভিমত

ট্রানজিট-করিডোরের বিষয়টি খোলাসা করুন আমজনতার কাছে, আমজনতার ভাষায়

কাকন রেজা

কাকন রেজা

প্রকাশ: ২৭ জুন ২০২৪, ০৫:৪৫ পিএম

ট্রানজিট-করিডোরের বিষয়টি খোলাসা করুন আমজনতার কাছে, আমজনতার ভাষায়

একটা লাইভ শোতে অর্থনীতিবিদ মনোয়ার মোস্তফার সাথে কথা বলতে গিয়ে তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, এই যে আমরা ‘জিডিপি, ‘পুঁজিবাদ’ এসব নিয়ে মানুষের সামনে কথা বলি, আমাদের সাধারণ মানুষেরা সত্যিকার অর্থেই এই শব্দগুলোর মানে বোঝে কিনা? সহজ এবং সোজা উত্তর, বোঝে না। 

অর্থাৎ আমরা নিজেরা যা বুঝি সাধারণ মানুষকে তা বুঝতে সহায়তা করি না। যার ফলে সাধারণ মানুষ থাকে নানা বিভ্রান্তিতে। তাদের সত্যিকার অর্থেই তেমন কোনো ধারণা জন্মায় না, আসলে দেশের অর্থনীতিতে কী হচ্ছে। কী কারণে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাচ্ছে। এর জন্য দায়ী মুদ্রাস্ফীতি কিংবা মূল্যস্ফীতি এই শব্দগুলোও কিন্তু মানুষ বোঝে না। তারা বোঝে শুধু তাদের জীবনযাত্রা কঠিন হচ্ছে এবং জিনিসের দাম বেড়ে যাচ্ছে। সুতরাং এসব শব্দ না বোঝার কারণে তারা অর্থনীতির ক্রমশ শ্মশান যাত্রার বিষয়টি বুঝতে অপারগ থেকে যাচ্ছে।

অথচ এই ব্যাপারগুলো তাদের ভাষাতেই বোঝানো যেত। বোঝানো যেত, একটি দেশকে দেহের সাথে তুলনা করে। বলা যেতে পারতো, মানুষের শরীর যেমন রক্ত না থাকলে অচল হয়ে পড়ে, মানুষটি ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। তেমনি দেশের জন্য সেই রক্ত হলো অর্থনীতি, মানে টাকা-পয়সা। একটি দেশের যদি টাকা-পয়সা না থাকে, তাহলে তার অবস্থা হবে সেই রক্তহীন দেহের মতন। সুতরাং রক্ত চলাচল যেমন জরুরি মানুষের শরীরে জন্য, তেমনি দেশের রক্ত হচ্ছে টাকা। এই টাকার চলাচল থেমে গেলে দেশ মৃত। আমাদের দেশের রক্ত অর্থাৎ টাকাও ক্রমশ কমে যাচ্ছে, বিদেশে পাচার করছে একশ্রেণির লুটেরা। এভাবে বললে সাধারণ মানুষ নিশ্চয়ই বুঝবে। বইয়ের ভাষায় নয় মানুষের ভাষায় কথা বলতে হবে। 

এই যে এখন আমাদের আলোচিত কথা ট্রানজিট। এই ট্রানজিটটা কী, তা কি কেউ দেশবাসীকে খুলে বলেছেন? আমজনতা কি জানে ট্রানজিটের মানে? অপরদিকে বিরোধীরা একে করিডোর বলছেন। কিন্তু তারাও খোলাসা করছেন না ট্রানজিট আর করিডোরের পার্থক্যটা কী। সাথে দুটোরই লাভ-লোকসান কী। তাহলে মানুষ বুঝবে কীভাবে! সাধারণ মানুষ তো আর বিশেষজ্ঞ নয় যে ‘ইশারা কাফি’ হবে। খুলে বলুন ট্রানজিট কাকে বলে। বলুন করিডোর কী। বলুন ট্রানজিট দেওয়া হচ্ছে না করিডোর দিচ্ছি। 

আসি সংজ্ঞাতে। প্রথমে করিডোরের কথা বলি, করিডোর হলো সেই ব্যবস্থা, যে ব্যবস্থায় একটি দেশ অন্য আরেকটি দেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে তার নিজের দেশেরই আরেকটি অংশে যেতে পারে। যে দেশের মধ্যে দিয়ে যাওয়া হয়, যে দেশের মাটি ব্যবহার করা হয়, সেই দেশটিকে বলা হয় করিডোর। যেমন ভারতের সাথে রেল চুক্তির ব্যাপারে কথা হচ্ছে। একটি রুট নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। যে রুটে ভারত বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে তাদের দেশের আরেকপ্রান্তে যাবে। এবং সেটা যাবে তাদের নিজস্ব পরিবহনে, রেলে। সুতরাং এই প্রক্রিয়াটাকে ট্রানজিট বলাটা সংজ্ঞা অনুযায়ী সঠিক নয় এবং এর সঠিক সংজ্ঞা হলো করিডোর। বলেছেন কি বিরোধীরা এভাবে? 

এক্ষেত্রে সঙ্গতই প্রশ্ন উঠবে ট্রানজিট তাহলে কী? আমজনতাকে জানান, ট্রানজিট হলো এককথায় বহুদেশের সাথে সংযুক্ত হওয়ার ব্যবস্থা। যেমন আমাদের মধ্যে দিয়ে ভারত বার্মা যেতে পারে, বার্মা হয়ে চীন যেতে পারে। আমরা ভারতের ভেতর দিয়ে ভূটান, নেপাল, পাকিস্তান, আফগানিস্তান যেতে পারি। কিংবা ইরানকেও সংযুক্ত করতে পারি ট্রানজিটে। আমাদের উৎপন্ন জিনিসপত্র পাঠাতে পারি, ব্যবসা করতে পারি এসব দেশের সাথে। কিন্তু করিডোরে তা সম্ভব নয়। বহু দেশের সাথে যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়ার নামই হলো ট্রানজিট। সেটা সড়ক বা রেল যে পথই হোক না কেন। যেমন রয়েছে ইউরোপে। 

সুতরাং সংজ্ঞার শুদ্ধতা অনুযায়ী ভারত আমাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে চাইছে যে প্রক্রিয়ায় সেটা হলো করিডোর। পরিষ্কার কথা হলো, আরেকটি দেশকে ব্যবহার করে নিজের দেশের আরেক প্রান্তে যাওয়া এবং তা নিজস্ব পরিবহনে। এই প্রক্রিয়ায় মূলত করিডোর প্রদানকারী দেশটি করিডোরের মূল্য দাবি করতে পারে। যেহেতু করিডোর ব্যবস্থায় করিডোর প্রদানকারী দেশটির তেমন কোনো লাভ নেই। 

যেমন, আমাদের দেশের ওপর দিয়ে ভারতীয় ট্রেন চললো, তাতে আমাদের কতটা লাভ? বলতে গেলে তেমন কোনো লাভই নেই। ভারতীয় যাত্রী কিংবা মালামাল ভারতেই যাবে, এক্ষেত্রে শুধুমাত্র বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার হবে। আর বাঁচবে ভারতের সময় এবং টাকা। অন্য ভৌগোলিক ব্যাপারগুলো যেমন, চিকেন নেকসহ অন্যান্য যেসব স্পর্শকাতর ব্যাপার আছে সেগুলো না হয় নাই তুললাম। চীনের সাথে ভারতের কনফ্লিক্টে আমাদের চিড়েচ্যাপ্টা হওয়ার সম্ভাবনার কথাও না হয় নাই বললাম। শুধু আমজনতার মনে রাখার জন্য তাদের ভাষাতেই বললাম, ‘শিলে-পাটায় ঘষাঘষি মরিচের জান শেষ’ এই কথাটি। শিল কে, পাটা কে, আর কেই বা মরিচ, তা এ কথাতেই বুঝে নেবে আমজনতা। কারণ এটা তো তাদেরই ভাষা। 

মূলত যারা বিজ্ঞের মত আলাপ পারছেন, তাদের এই আলাপ অর্থহীন। আপনারা যে যুক্তি দিয়ে, কঠিন ভাষার প্যাঁচে নিজেদের প্রতিপক্ষের কাছে পণ্ডিত প্রমাণ করতে চাইছেন, তা সত্যিকার অর্থেই অর্থহীন। কারণ আপনি যাদের বোঝাতে চাইছেন করিডোর আর ট্রানজিটের পার্থক্য। আমাদের লাভ-ক্ষতি। তারা সবই বোঝে। কিন্তু তাদের ভর করে আছে ডগমাটিজম। তারা মূলত ডগমাটিক। তারা ‘ডগমা’য় আচ্ছন্ন। সুতরাং যারা ইনফ্লুয়েন্সারের দায়িত্ব নিয়েছেন, তাদের উচিত এসব ডগমাটিকদের বোঝানোর ব্যর্থ চেষ্টা না করে বরং সাধারণ মানুষকে বোঝাতে চেষ্টা করুন এবং তা করুন সেই সাধারণ মানুষদের ভাষাতেই। দেখবেন তাহলে মিরাকল ঘটে যাবে, যা আপনাদের চিন্তাতেও নেই। সামাজিক মাধ্যমে হোক, সভা-সেমিনারেই হোক, প্রয়োজনে মাঠে নেমে এসে মানুষকে বোঝান। তাদের সামনে তুলে ধরুন ট্রানজিট করিডোরের পার্থক্য এবং এতে আমাদের লাভ-লোকসান। দেখবেন, সাধারণ মানুষই তাদের পথ ঠিক করে নেবে, যেমন নিয়েছিলো অতীতে। 

ফুটনোটে বিজ্ঞদের জন্য প্রশ্ন রেখে শেষ করি। ভারত সম্ভবত ব্যাপারটিকে করিডোর হিসেবেই নিয়েছে। না হলে আমরাও নিজস্ব পরিবহনে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোতে যেতে পারতাম। বিশেষ করে ভুটান তো আমার বাড়ির কাছেই। এক্ষেত্রে ২০১৫ সালের ৯ জুনের প্রথম আলোর একটি খবরের শিরোনাম মনে করিয়ে দিই। ‘চুক্তির খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদন, বাংলাদেশ ভুটান ভারত ও নেপালের মধ্যে যান চলবে সড়কপথে’, এমনটাই ছিল শিরোনাম। 

খবরের শুরু হয়েছিলো এভাবে, ‘বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের (বিবিআইএন) মধ্যে সড়কপথে যাত্রীবাহী, ব্যক্তিগত ও পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল করবে। এ-সংক্রান্ত চুক্তির খসড়া গতকাল সোমবার অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। ১৫ জুন ভুটানে মন্ত্রিপর্যায়ের বৈঠকে এই চার দেশের মধ্যে এই ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি সই হতে যাচ্ছে। সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা সাংবাদিকদের বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানিয়ে বলেন, এই চুক্তির ফলে চার দেশের মধ্যে যোগাযোগ বাড়বে।’ আমরা জানি, ট্রানজিট হলে যোগাযোগ বাড়বে, বাড়বে ব্যবসা-বাণিজ্য ও সম্পর্ক। কিন্তু প্রশ্ন হলো ২০১৫ থেকে আজ ২০২৪ এর জুন, ট্রানজিট হয়েছে কি? এবারের চুক্তি কি ট্রানজিটের? 

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন